আমার কেস সমাধান করার ধরন হলো:
- প্রথমে আমি সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করি।
- যা পর্যবেক্ষণ করলাম, সেটা থেকে কিছু উপসংহারে আসি।
- তারপর, সেখান থেকে অসম্ভব উপসংহারগুলো বাদ দিয়ে দেই এবং যেটা বাকি থাকে, সেটা যতই অভাবনীয় মনে হোক না কেন, ওটাই সত্য।
শার্লক হোমস তার ব্যক্তিগত ব্লগে নিজের কাজের ধারাগুলো ঠিক এভাবেই বর্ণণা করেছেন। কী, অবাক হচ্ছেন? শার্লকের আবার ব্লগ কোথা থেকে আসলো! আসছি সে কথায়।
পৃথিবীর বয়স বাড়ছে ঠিক, তবে শার্লক হোমস আজীবনই ছিলেন আধুনিক, চিরতরুণ। আর এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি ফিরে এসেছেন নতুন রূপে- তীক্ষ্ম, সমকালীন, জটিল মস্তিষ্ক সম্পন্ন এবং আগের চেয়ে আরো বেশি ভয়াবহ! সাথে আছেন জন ওয়াটসন- ডাক্তার এবং একজন বীরযোদ্ধা। খুব সহজ করে বলতে গেলে তিনি এমন একজন ডাক্তার, যিনি প্রতিটা হাড়ের নাম বলতে বলতে সেগুলো ভাঙতে জানেন। আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেই শার্লকের সঙ্গে দেখা হয় তার- একাকী, সত্যান্বেষী এক জিনিয়াস।
উপন্যাসের জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্র হচ্ছেন স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের অমর সৃষ্টি এই শার্লক হোমস। তবে বইয়ের শার্লক বিচরণ করেছেন উনিশ শতকের লন্ডনে। একবারও কি ভেবে দেখেছেন, উপন্যাসের সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ যদি বর্তমান সময়ে লন্ডন শহরে থাকতেন, তাহলে কেমন হতো? পাইপের বদলের তিনি ব্যবহার করেন ‘নিকোটিন প্যাচ’, টেলিগ্রামের বদলে তিনি বার্তা প্রেরণ করেন এসএমএসের মাধ্যমে, অপরিচিত জায়গায় চলাচলের জন্যে তিনি ব্যবহার করেন গুগল ম্যাপ; এই কল্পনাগুলোকেই যেন বাস্তবতায় রূপ দিতে ২০০৯ সালে দুই স্বপ্নবাজ মার্ক গ্যাটিস আর স্টিভেন মোফাট শুরু করেন তাদের ‘শার্লক’ ধারাবাহিক।
গত বিশ বছর ধরে বেশ কিছু দর্শকপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক প্রযোজনা করে আসছেন বাফটা পুরস্কার বিজয়ী নাট্যকার স্টিভেন মোফাট। তাছাড়া কিছুদিন আগে পঞ্চাশের দশকের নামকরা টিভি শো ড. হু নতুন করে শুরু করার পর ক্যারিয়ারের দারুণ সময় পার করছিলেন তিনি।
অনেকটা ড. হু এর সাফল্য দেখেই তার মাথায় আসে শার্লকের সমসাময়িক আপডেটের ধারণা। অন্য কেউ সেটা শুরু করার আগেই তাই এই নিয়ে কথা বলা শুরু করেন তার সহকর্মী মার্ক গ্যাটিসের সাথে। বেশ কিছুদিন ধরে তারা দুজনেই ড. হু এর বিভিন্ন এপিসোডের চিত্রনাট্য লিখছিলেন, তাছাড়া দুজনেই শার্লক ফ্যান হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে ভালো সখ্যতা ছিল। লন্ডন থেকে কার্ডিফে যাওয়ার পথে ট্রেনে তারা প্রায়ই সেটা নিয়ে আলোচনা করতেন।
তারপর একদিন বিবিসি স্টুডিওর সাথে কথা বলে ঠিক হলো, প্রতি সিজনে তিন পর্ববিশিষ্ট একটি মিনি সিরিজ তৈরি করা হবে। তারপর এলো চরিত্রের জন্যে কাস্ট খোঁজার পালা। আসুন তাহলে এবার পরিচিত হয়ে নেই বিবিসির শার্লকে অভিনয় করা তারকাদের সাথে।
শার্লক/বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ
শার্লক হোমস, যার পরিচয়- বিশ্বের একমাত্র কনসাল্টিং ডিটেকটিভ। অপরাধজগৎ নিয়ে চিন্তাভাবনায় মগ্ন সে সবসময়। অন্য কোনো বিষয়ে তার তেমন আগ্রহ নেই। এমনকি পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে- এই সামান্য তথ্যটিও যেন তার জানার প্রয়োজন নেই। তার বসবাস লন্ডন শহরের বেকার স্ট্রিটের ২২১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। বাড়ির মালিক মিসেস হাডসনের স্বামীর ফাঁসি কার্যকর করতে সহায়তার কারণে মহিলা তাকে থাকতে দিয়েছেন সেখানে। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরার মতো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপারে উদাসীন হলেও, অপরাধ আর অপরাধীদের সম্পর্কে তার জ্ঞান এতটাই সুগভীর যে, স্থানীয় পুলিশ বিভাগ জটিল কোনো কেসের সুরাহা করতে হাজির হয় শার্লকের দোরগোড়ায়। এছাড়াও শার্লকের রয়েছে নিজস্ব একটি ব্লগ। সেখানে তিনি নিজের সম্পর্কে লিখেছেন ঠিক ওপরের বর্ণনার মতো করে। তার সহায়তার জন্যে যে কেউ চাইলে সেখানে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
বইয়ের জগতের কিংবদন্তি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ঠিক করা হয় ব্রিটিশ অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচকে। প্রথম দিন অডিশনে বেনেডিক্টকে দেখেই পছন্দ হয়েছিল নাট্যকারদের। তিনি যখন ভেতরে এসে তাদের নাটকের লাইন পড়ে শোনাতে শুরু করেছিলেন, তখন তারা মনে মনে তার দেহভঙ্গিমা, বাচনভঙ্গি এবং তার প্রভূত মেধার তারিফ করছিলেন। তার অনন্যসাধারণ চেহারা, চমৎকার চোখ এবং চোয়ালের হাড় মিলিয়ে তাকে বেশ আকর্ষণীয় প্রতিভাত হচ্ছিল। মার্কের মতে, শার্লকের আধুনিক অবতারের অবয়বে প্রয়োজন আধুনিকতার ছাপ, যা বেনেডিক্ট আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্যুট ও স্টাইলিশ ওভারকোট পরিহিত বেনেডিক্টের আলোর বিপরীতে পাওয়া অন্ধকার প্রতিচ্ছবি সত্যিই দারুণ। কাজেই তিনি ছিলেন তাদের প্রথম ও একমাত্র পছন্দ।
ড. ওয়াটসন/মার্টিন ফ্রিম্যান
সিরিজের গল্পটিতে এমন দু’জনের কথা রয়েছে, যাদের মধ্যে কোনোভাবেই ঠিক বন্ধুত্বটা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। অথচ দু’জনে মিলে গল্পটিতে সৃষ্টি করেছেন অসম্ভব মাদকীয় এক দ্যোতনার; একসঙ্গে তাদের দৃপ্ত পদচারণা, তাদের রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা মাথায় রাখলে ডক্টর ওয়াটসনের গুরুত্ব বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাই তিনি হয়ে যান শার্লকের সাথে একই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এবং পাশাপাশি বনে যান শার্লকের সহকারী। লন্ডনের ফিরে আসার আগে সামরিক সেবায় নিয়োজিত ছিলেন আফগানিস্তানে। এত বছর সামরিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার পর, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা ওয়াটসনের পক্ষে সাধারণ জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। একঘেয়ে সময় কাটানো ওয়াটসন শার্লকের কেসগুলোতে খুঁজে পান নতুন করে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ।
স্টিভেন তাকে বিশ্লেষণ করেছেন দারুণ কাব্যময় একটি উক্তির মাধ্যমে,
“বেনেডিক্ট একটি শীতল এবং অনেকাংশেই ভিনগ্রহী একটি চরিত্রের চরিত্রায়ন করেছেন, যাতে মানবীয় রূপ এনে দিয়েছেন জন ওয়াটসন- একসাথে দু’জনে হয়ে উঠেছেন অভিন্ন। আমরা এই দুটো চরিত্রের সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছি। তাদেরকে নিয়ে লিখতে আনন্দ, দেখতে আনন্দ, থাকতেও আনন্দ। হোমস এবং ওয়াটসনকে আপনি যখন একত্রিত করবেন, তাদেরকে একসঙ্গে কাজ করতে দেখার অনুভূতিটা তখন দারুণভাবে অনুভব করতে পারবেন।”
এই চরিত্রের জন্য তাদের পছন্দ ছিল আরেক ব্রিটিশ অভিনেতা মার্টিন ফ্রিম্যান। ফ্রিম্যান বিবিসির নতুন ড্রামা শার্লকে ডক্টর জন ওয়াটসনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। এই ড্রামাটিতে আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত উপন্যাসগুলোকে একটি আধুনিক পটভূমিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মার্টিন স্বীকার করেন যে, শুরুতে তিনি শার্লক হোমসের আধুনিক এই সংস্করণের জনপ্রিয়তার সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন।
শার্লকের বড় ভাই এবং তাদের দুজনের মধ্যে ছিল সহোদরীয় দ্বন্দ্ব। ব্রিটিশ সরকারের খুব প্রভাবশালী পদে নিযুক্ত মাইক্রফট। শার্লক তার সম্পর্কে মজা করে বলে, “সে-ই তো ব্রিটিশ সরকার।” চরিত্রটির জন্যে প্রয়োজন ছিল শক্তিশালী একজন অভিনেতার, আর সেই গুরুদায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেন নাট্যকার মার্ক গ্যাটিস নিজে। এছাড়াও শার্লক ও ওয়াটসনের ২২১ বেকার স্ট্রিটের বাড়িওয়ালীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন উনা স্টাবস।
অ্যা স্টাডি ইন পিঙ্ক
স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক নিয়ে লেখা প্রথম গল্প স্টাডি ইন স্কারলেটকে ঘিরে রচনা করা হয়েছে এই সিরিজের প্রথম এপিসোড। এর গল্পটি স্টাডি ইন স্কারলেটেরই আধুনিক প্রতিচ্ছবি। হঠাৎ করে লন্ডন শহরে ঘটতে শুরু করে একের পর এক রহস্যময় হত্যাকাণ্ড। পুলিশ সেগুলোকে উপস্থাপন করেছে আত্মহত্যা হিসেবে। কিন্তু প্রত্যেকটি আত্মহত্যার ধরন একই হতে পারে? না, তাই মিডিয়াও সেগুলোকে আত্মহত্যা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তবে রহস্যময় যোগসূত্র নিয়ে পুলিশও তাদের ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছে, তবে কোনো সমাধান করতে পারছে না। এমতাবস্থায় ঘটে আরেকটি হত্যকাণ্ড। শেষমেষ এর কোনো সুরাহা না পেয়ে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর লেস্ট্রাড শরণাপন্ন হন শার্লকের।
প্রথম এপিসোড হিসেবে শুরুটা ভালোই ছিল। প্রথমদিকে হয়তো অনেকেরই শার্লক চরিত্রে কাম্বারব্যাচকে একটু তরুণ মনে হতে পারে। তবে তার অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী পার্ফরমেন্স দিয়ে খুব সহজেই চরিত্রটির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি জন ওয়াটসন চরিত্রে মার্টিন ফ্রিম্যান ছিলেন অনবদ্য। যদিও অনেকেরই সন্দেহ ছিল শার্লক হোমস সিনেমায় ওয়াটসন চরিত্রে অভিনয় করা জুড ল’র পার্ফরমেন্স তিনি অতিক্রম করতে পারবেন কিনা। এপিসোডটি পরিচালনা করেছেন পল ম্যাকগুইগান। চিত্রনাট্য লিখেছেন স্টিভেন মোফাট।
IMDb রেটিং: ৯.১/১০
দ্য ব্লাইন্ড ব্যাংকার
অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একের পর এক খুন করে যাচ্ছে গোপন এক অপরাধ সংঘ। সূত্র বলতে আছে তাদের ব্যবহার করা চাইনিজ সাইফারের সতর্কবাণী। শুধু এই সামান্য ক্লু থেকে শার্লক কীভাবে রুখবে গোপন এই খুনে সংগঠনকে? সেই রহস্য উদঘাটনের গল্প নিয়ে সাজানো এই পর্বটি। এর পরিচালনায় ছিলেন ইউরোস ল্যিন এবং রচনা করেছেন স্টিফেন থম্পসন।
এপিসোড সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, সিরিজের সবচেয়ে দুর্বল এপিসোড এটি। তবে অন্যান্য এপিসোডগুলোর কাহিনী আর্থার কোনান ডয়েলের গল্পগুলোর ছায়া অবলম্বনে হলেও, এই এপিসোডের কাহিনীটি ছিল মৌলিক।
IMDb রেটিং: ৮.১/১০
দ্য গ্রেট গেইম
এবারের পর্বে ‘এম’ নামের এক রহস্যময় চরিত্র শার্লকের সাথে মেতে উঠেছে অদ্ভুত এক খেলায়। টাইম-অ্যাটাক গেমগুলোর মতো সে শার্লককে ধরিয়ে দিচ্ছে একের পর এক ইনভেস্টিগেশন কেস এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাধান না করলে ঘটবে মারাত্মক দুর্ঘটনা!
মার্ক গ্যাটিসের চিত্রনাট্য ও পল ম্যাকগুইগান পরিচালিত এই পর্বটি ছিল নিঃসন্দেহে এই সিজনের সবচেয়ে অসাধারণ এপিসোড। একদম শুরুর মুহূর্ত থেকে শেষ পর্যন্ত এই পর্বটি আপনাকে উত্তজনার মধ্যে রাখতে বাধ্য। পুরো এপিসোড জুড়ে বেনেডিক্ট এবং ফ্রিম্যানের পার্ফরমেন্স ছিল নজরকাড়া।
IMDb রেটিং: ৯.৩/১০
শার্লকের একটি অনন্য বিশ্লেষণী মন রয়েছে, যা খাটিয়ে নানান অপরাধ প্রতিহত বা এর সুরাহা করাটা তার উপার্জন এবং একঘেয়েমি কাটাবার উপায়। রহস্য যত অদ্ভুত ও প্যাঁচালো হবে, ততই যেন তা তার জন্য উপাদেয়। দু’জনের মধ্যে বিন্দুমাত্র মিল নেই, তবু শার্লকের তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধির সঙ্গে ওয়াটসনের বিচারবুদ্ধি মিলিয়ে যেন সৃষ্টি হয় অভেদ্য এক মৈত্রীর।
রোমাঞ্চকর, ভীতিকর, অ্যাকশনে ভরপুর এবং অত্যন্ত বিনোদনময় তিনটি পর্বজুড়ে শার্লক এবং জন সত্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন লুকোনো সূত্র ও খুনীদের ভিড়ে সাজানো এক গোলকধাঁধায়। পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত এই গোয়েন্দার আবির্ভাব- চমৎকার স্ক্রিপ্ট এবং শার্লক ও জন চরিত্র দুটোয় অভিনেতাদের অনবদ্য অভিনয় থেকে বলাই যায়- এই ‘শার্লক’ নতুন প্রজন্মের জন্যই।
Sherlock is a British crime television series based on Sir Arthur Conan Doyle's Sherlock Holmes detective stories. Created by Steven Moffat and Mark Gatiss, it stars Benedict Cumberbatch as Sherlock Holmes and Martin Freeman as Doctor John Watson. 13 episodes have been produced, with four three-part series airing from 2010 to 2017, and a special episode that aired on 1 January 2016. The series is set in the present day, while the one-off special features a Victorian period fantasy resembling the original Holmes stories. Sherlock is produced by the British network BBC, along with Hartswood Films, with Moffat, Gatiss, Sue Vertue and Rebecca Eaton serving as executive producers. The series is supported by the American station WGBH-TV Boston for its Masterpiece anthology series on PBS, where it also airs in the United States. The series is primarily filmed in Cardiff, Wales, with North Gower Street in London used for exterior shots of Holmes and Watson's 221B Baker Street residence.
Featured Image © Posterskart