Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিরিয়ানি: বিদীর্ণ দর্পণে সমাজের প্রতিবিম্ব

কোনো সমস্যার মূলে প্রবেশ করতে না পারা, স্বল্প জ্ঞান নিয়েই কোনো বিষয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলা বা ভ্রান্ত ধারণাকে আরো বাড়িয়ে তোলা; আজকাল মূলধারার নানা চলচ্চিত্রই এ ধরনের নানা দোষে দুষ্ট। প্রায়শই দেখা যায় এ ধরনের সিনেমাগুলো যে বিষয়ে নির্মিত হয়েছে, ঐ বিষয় সম্পর্কিত আলোচনায় নতুন কোনো দিক বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারে না। ‘বিরিয়ানি’তে পরিচালক সাজিন বাবু মূলধারায় বহুল চর্চিত এমন একটি বিষয়কেই দেখেছেন সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে, যার ফলে এই বিষয় সম্পর্কিত আরো নানা তথ্য-উপাত্ত উঠে এসে গল্পে নানা স্তর যুক্ত হয়েছে; যেসকল বিষয় আমাদের এবং সমাজের দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে যাচ্ছিল। 

গল্পে বাবু অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেছেন জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় উগ্রবাদীতাকে। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কেরালার বেশ কিছু তরুণ জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এ যোগ দিতে দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু এ সকল তরুণ বা জঙ্গিবাদ গল্পের কেন্দ্রবিন্দু না। বরং গল্পের কেন্দ্রবিন্দু তাদের পরিবার। তাদের উগ্রপন্থার কারণে পরিবারের সদস্যদের কতটা কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেই সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে চেয়েছেন পরিচালক। এই তরুণদের চরিত্র হিসেবেও দেখতে পাবেন না এখানে আপনি, তারা কেবল ভেসে উঠবে সংবাদের প্রতিবেদন হিসেবে; থেকে যাবে গৌণ। 

সিনেমার শুরুতেই ভেসে ওঠে- কেরালার লোকেরা যে বহুকাল ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে কাজ করতে যাচ্ছেন সেই সম্পর্কিত কথা। তারা কীভাবে ভারতের প্রায় ধ্বংস হতে বসা অর্থনীতিকে নিজেদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে রক্ষা করেছেন, সেটিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরো বলা হয়েছে ঐ অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় আর উপাদেয় খাবার বিরিয়ানির কথা। তবে সাথে এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, প্রকৃত কেরালা বা বিরিয়ানি, কোনোটিরই প্রতিনিধিত্ব করে না এই সিনেমা। 

খাদিজা আর তার অনুভূতিশূন্য দুই চোখ; Image Credit : Filmcompanion.com

আসুন এবার সিনেমার গল্পের দিকে এগিয়ে যাই। আর সেক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হবে মূল চরিত্র খাদিজার কথা। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন কানী কাসরুতি। খাদিজার চোখ দুটি যেন ঊষরতার অতিকায় নিধি। তাকে দেখে মনে হয় সে এমন এক মানুষ যার ভেতর অনুভূতির লেশমাত্র নেই। নাকি আছে? একটু মিথ্যা হাসির আনাগোনা, ক্ষণিকের নিখাদ উষ্ণতা, ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষার মৃদু ঝলকানি, ভয়, মনস্তাপ- এই মানবিক অনুভূতিগুলো তার এমনিতে শূন্য, বিবশ মুখাবয়বে আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

খাদিজার এই অনুভূতিশূন্য চেহারা ছাড়াও সাজিন বাবুর বিরিয়ানি নিয়ে আরো অনেক কথা বলার আছে। যেমন, সিনেমার নামের কথাতেই আসা যাক। এর পুরো নাম ‘বিরিয়ানি: দ্য ফ্লেভার্স অফ ফ্লেশ’; বিরিয়ানির মাংস কে না ভালোবাসে? এখানে মাংসের ব্যাপারটি উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ গল্পের উপস্থাপনে পরিচালক বার বার দেখিয়েছেন একজন মানুষ কীভাবে আরেকজন মানুষকে অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন স্বজাতি ভাবে না। কীভাবে বিরিয়ানি মাংসের মতোই নিজের নানা ক্ষুধা মেটাতে অন্যকে ব্যবহার করে। এই ব্যবহার হতে পারে খবরের ক্লিপিংয়ের অংশ বা কোনো মামলার সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে। বিরিয়ানিতে দেওয়া পশুর মাংসের মতো অন্যকে ব্যবহার আর তার মাংস খেয়েই চলেছে যেন মানুষ। 

প্রথম দৃশ্যে খাদিজা আর তার স্বামী নাজিরের (জয়চন্দ্রণ) মধ্যকার রতিক্রিয়ার দৃশ্যটি যেভাবে দেখানো হয়েছে; সেরকম বিশদভাবে এ ধরনের দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নয় উপমহাদেশের দর্শকরা। এই দৃশ্য দেখে দর্শক অস্বস্তিতে পড়তে পারেন। কিন্তু দর্শকের অস্বস্তির ব্যাপারে খুব একটা বিচলিত নন পরিচালক। তিনি সমাজ আর তার দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলতে চান, তুলে ধরতে চান সভ্য মানুষদের কালো দিকগুলো। এর আগেও এ ধরনের সিনেমা নির্মাণ করেছেন তিনি। আর এই সূচনা দৃশ্যের মাধ্যমেই পুরো গল্পটি কীভাবে বর্ণিত হবে, সেটি ঠিক করে দিয়েছেন বাবু।

কাহিনীর পুরোটা জুড়েই নানাজনের কাছে এমন নির্মম আচরণ পাবে খাদিজা। নাজিরকে দেখে মনেই হয় না সে তার স্ত্রীকে ভালোবাসে। নিজের পরিতৃপ্তির পরপরই সে খাদিজার উপর বিরক্ত হয়। কারণ সে আরো চায়। এই আরো চাওয়ার মধ্যেই আছে তার ভেতরকার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ, যা সিনেমার বাকি অংশেও দেখবে আমরা। নাজিরের বিরক্তির পর সে রাখঢাক না রেখে যে অবাধ্যতা প্রদর্শন করে, সেটিই কেন্দ্রীয় চরিত্রের মূল বোধকে প্রকাশ করে স্পষ্টভাবে। এই নারীকে বহুভাবে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু দমানো যায়নি। 

এতটুকু পড়ার পর এটা তো আলাদা করে বলতে হবে না যে, এই সিনেমা অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নয়। এর মুক্তি নিয়ে পরিচালককে বেশ কয়েকবার ঝামেলায় পড়তে হয়েছে, মুক্তির তারিখ পেছাতে হয়েছে। এমনকি কিছু প্রেক্ষাগৃহ প্রথমে রাজি হলেও পরে এটি প্রদর্শন করেনি। 

খাদিজার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় তার ভাই ইসলামি স্টেটে যোগ দিয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর। একদিকে তার সমাজ তাকে পরিত্যাগ করে, স্বামী মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েই তালাক দেয়। অন্যদিকে পুলিশ তথ্য সংগ্রহের নামে কারণে-অকারণে জ্বালাতন শুরু করে। কপর্দকশূন্য অবস্থায় মানসিকভাবে অসুস্থ মায়ের (শৈলজা) সেবার চিন্তাসহ নানা বিষয় মাথায় করে সে শুরু করে এক অনিশ্চিত যাত্রা। এই যাত্রাই শেষ পর্যন্ত তাকে নিজেকে খুঁজে পেতে এবং প্রাপ্য স্বীকৃতি অর্জনের পথে নিয়ে যায়। 

মায়ের সাথে খাদিজা; Image Credit : Timesofindia.com

এর আগে আমরা নারী স্বাধিকার বিষয়ক যেসকল ভারতীয় সিনেমা দেখেছি, সেগুলোতে বেশিরভাগ সময়েই মূল উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে পরিবারে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আর এসব সিনেমায় সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মূল চরিত্রগুলো ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা এবং কুসংস্কারমুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী বা গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে তাদেরকে সমাজের ভ্রুকুটির সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু ‘বিরিয়ানি’র খাদিজা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর দরিদ্র নারী চরিত্রের প্রতিভূ, যাকে একইসাথে বৃহত্তর সমাজ এবং নিজের গোষ্ঠীর ভেতর হওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়। 

দারিদ্র্যের মাঝেই তার জন্ম, ১০ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয়। এরপর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বয়ষ্ক এক লোকের সাথে সংসার করতে হয়। বাবা জেলে হওয়ার কারণে শাশুড়ি তাকে অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিতে দেখে। তার উপর সে মুসলিম, অর্থাৎ সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যা। ভারতব্যাপী বিদ্যমান ইসলামোফোবিয়া বা মুসলিমদের প্রতি ঘৃণার অনুসঙ্গে তার ধর্মীয় পরিচয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে কেবল আর দরিদ্র মুসলিম নারীর পরিচয়ে আবদ্ধ থাকে না।

এক্ষেত্রে তার চরিত্রের বিস্তৃতির চিত্রায়ণে সাজিন বাবু সাহসিকতা এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি খাদিজার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়াকে দেবতুল্য করে দেখাননি। বরং তিনি সমাজের সাথে সম্পর্কিত সকল ব্যক্তিবর্গের সামনে তুলে ধরেছেন এক বিদীর্ণ দর্পণ, যাতে প্রতিফলিত হয়েছে এক অস্বস্তিকর সত্য- খাদিজা অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী হলেও তার ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হতো না। তিনি জোরের সাথে বলেছেন এবং দেখিয়েছেন কীভাবে একজন নারী হিসেবে খাদিজা ধর্মীয় বিভাজন রেখার উভয়পাশের লোকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে যাদের সাথেই সাক্ষাৎ হয়, সকলের কাছেই খাদিজা কেবল একটি মাংসপিন্ড। আর বিভিন্ন সম্প্রদায়ভেদে নারী- একটি মাংসের দলা, গৃহপরিচারিকা, রাঁধুনী বা সেবাদাত্রী হিসেবে সহজেই আরেক নারীর সাথে প্রতিস্থাপন বা বিনিময়যোগ্য। 

ইসলাম বা মুসলিমবিদ্বেষকে সুচতুরভাবে আবারও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমার পরের দিকে। এই সংক্ষিপ্ত দৃশ্যে আমরা একজন পুরুষকে দেখি, যে জীবনে প্রথমবারের মতো একজন একজন হিজাবী নারীর সাথে আসন্ন মিলনের পুলকের আতিশায্যে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এই সমস্ত ব্যাপার যখন ঘটছে, তখন ঐ নারীর মতো একই বিশ্বাসে বিশ্বাসীরা সমাজে নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। কারণ ভারতে এই সিনেমার শ্যুটিং চলাকালে সংঘটিত হওয়া নানা আন্দোলনের কথা আমরা সবাই জানি। এই পুরুষও হয়তো কোনো না কোনোভাবে এই নিগ্রহের সাথে যুক্ত। কিন্তু তার মাথায় তখন এসব নেই। কারণ দিনশেষে তার কাছে ঐ নারী স্রেফ একটা মাংসপিণ্ড।

ভারতে সাধারণভাবে মুসলিম এবং নারীদেরকে ছোট করে দেখার যে প্রবণতা, সেটি প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমায়। মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা আরো সঙ্গীন। কোনো ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিশেষজ্ঞ এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের এনে বিতর্ক, আলোচনা সভা ইত্যাদি আয়োজনের যে রীতি প্রচলিত, সেটিও দেখানো হয়েছে। এসব আলোচকদের অনেকেই যে বিষয়ে কথা বলছেন, সেই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আবার অনেকেই ওয়াকিবহাল নন। তবে বাবু এসকল বিশেষজ্ঞকে রেখে দিয়েছেন ব্যাকগ্রাউন্ডে অথবা একঝলক দেখিয়ে চলে গেছেন অন্য কোনো দৃশ্যে। কারণ, যারা এই আলোচনার বিষয়বস্তু, সেই খাদিজারা এখানকার অংশ না। আবার ভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী এবং আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বসবাস করার ফলে অনেক আলোচকেরই খাদিজারা কোন পরিবেশে থাকে সেই সম্পর্কিত সম্যক ধারণা নেই। 

সিনেমার পরিচালক সাজিন বাবু; Image Credit : Dailyhunt.in

শুধুমাত্র একজন সাংবাদিক (আই জি মিনি), খাদিজাকে খুঁজে বের করে এবং তার ভাষ্যকে সকলের সামনে তুলে ধরে। এই সাংবাদিক চরিত্রটি ঐসকল স্বল্প সংখ্যক চরিত্রদের একজন যে খাদিজাকে মানুষ বলে বিবেচনা করে এবং তার সাথে শিষ্টাচারমূলক আচরণ করে। এই ধরনের আরো কিছু চরিত্রের দেখা পাই আমরা। বাবুর লেখা চিত্রনাট্য সকলকে একই তুলিতে আঁকে না। সুরজিৎ গোপীনাথ অভিনীত মুয়াজ্জিন চরিত্রের কথাই ধরা যাক। এই চরিত্র আমাদেরকে এটাই স্বরণ করিয়ে দেয় যে, নারীলিপ্সা বা নারীর শরীরের আকাঙ্ক্ষা সকল পুরুষকেই মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত করে না। আবার আমরা ঐ দুই আইন প্রয়োগকারী সদস্যের কথাও বলতে পারি। নির্মম, লুন্ঠনজীবী সিস্টেমের সদস্য হয়েও যারা মনুষ্যত্ববোধ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেনি। খাদিজার মায়ের মানসিক অবস্থার কথা শুনে তারা খানিকটা হলেও বিচলিত হয়ে পড়েন। 

‘বিরিয়ানি’তে যেসকল সঙ্গম দৃশ্যাবলী রয়েছে, দর্শককে উদ্দীপ্ত করার উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহৃত হয়নি- এটা তো আগেই বলা হয়েছে। তবে এগুলোর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এগুলোকে কার্যকর, অনুভূতিশূন্য, পাশবিক ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। গল্পের মূল বিষয়বস্তুর প্রকাশে, বিশেষ করে নিষ্পেষণের প্রসঙ্গের প্রকাশে এগুলো অত্যন্ত কার্যকর। এগুলো দর্শককে অস্বস্তিতে ফেললেও দেখা যায়। তবে এই সিনেমায় আরো কিছু অংশ আছে, যেগুলো এদিকে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য অংশের সিনেমাতেও খুব একটা দেখানো হয়নি। মাংস এবং রক্তকে দেখানো হয়েছে কোনো রাখঢাক না রেখেই। এগুলো দর্শককে আরো বেশি অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার দিকে ঠেলে দেবে। এ ধরনের দৃশ্য থাকা সত্ত্বেও এই মুভি থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া কঠিন। এই কৃতিত্বের ভাগীদার ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি কার্তিক মুথুকুমার। তার দক্ষতার কারণে গল্প বলার ধরনের সাথে মিলে গেছে এগুলো, অযৌক্তিক মনে হয়নি। 

চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনার পাশাপাশি সিনেমায় শব্দ সংযোজনের কাজও করেছেন সাজিন বাবু। তার আগের দুই সিনেমাতেও তাকে এই ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। বাস্তবিকভাবেই ‘বিরিয়ানি’র ক্ষেত্রে শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা প্রকটভাবে প্রতীয়মান হয় কাল্পনিক ঐ ভূমিকা বদলের দৃশ্যে, যেখানে নিপীড়িতকে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি আমরা। তবে ঐ দৃশ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজের মূল্যবোধ থেকে একচুলও সরে আসেননি বাবু। কারণ পরের দৃশ্যেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এই ভূমিকা বদল শারীরিকভাবে সুখকর হয়তো হতে পারে, তবে মানসিক প্রশান্তি এনে দিতে পারে না। খাদিজার ঐ দুটি চোখ, এগুলো এখনো ম্লান, নিষ্প্রাণ। 

মুয়াজ্জিন ও খাদিজা; Image Credit : Timesofindia.com

২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে সাজিন বাবু বিরিয়ানিকে রিভেঞ্জ ড্রামা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সিনেমাটি দেখতে গিয়ে এই বোধ হয়নি। রিভেঞ্জ ড্রামার উদাহরণ পুরো বিশ্বেই ভূরি ভূরি রয়েছে। মলিউডেই নির্মিত হয়েছে এই ধারার টুয়েন্টিটু ফিমেল কোট্টায়াম (২০১২) বা পুথিয়া নিয়ামাম (২০১৬)। এসব চলচ্চিত্রে এমন একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশকে দেখানো হয়েছে, যেখানে একজন নারী নিগ্রহের শিকার হওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কেউ কেউ হয়তো নিপীড়কের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টাও করে। তবে বাস্তব জীবনের সাথে তুলনা করলে তাদের প্রতিশোধপরায়ণতাকে সিনেম্যাটিক গল্পের উপকরণরূপেই দেখতে হয়। কারণ এ ধরনের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার নজিরের তো আর অভাব নেই বাস্তবে।

ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য খাদিজা এমন একটি কাজ করে, যা পুরো গল্পজুড়ে তার চরিত্রের যে সহজাত অগ্রগমন ঘটেছে; তা থেকে দূরে ঢেলে দেয়। এই কাজ তার সহজাত আচরণের সাথে খাপ খায় না। তবে পরিচালক তার এই কাজকে আবেগপূর্ণভাবে দেখেননি, মহিমান্বিতও করেননি। তাই মনে হয়নি এই সিনেমা আগে উল্লেখিত দুটি সিনেমার সাথে একই কাতারে অবস্থান করে। 

সাজিন এক্ষেত্রে বাক্য নির্বাচনে সচেতন হতে পারতেন। কারণ তার এই বক্তব্য দর্শককে এরকম বাস্তবিক, শক্তিশালী, আচারনিষ্ঠ এবং বিশদ চলচ্চিত্রকে কেবল একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে উৎসাহিত করবে, যা এরকম সুচিন্তিত প্রজেক্টকে তার প্রাপ্য কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করবে। 

মুয়াজ্জিনের সাথে কথা বলার সময় একপর্যায়ে ধর্মে পুরুষকেই সব ধরনের অধিকার দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করে খাদিজা। তার মতে, ধর্মে নারীর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার কোনো দাম নেই। মুয়াজ্জিন তাকে এই ব্যাপারে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কাহিনীর একপর্যায়ে খাদিজা প্রতিশোধের যে পন্থা বেছে নেয়, সেটাও কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিচালক। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই প্রশ্ন, 

“আরো ভুল করে কি আগের ভুলকে শোধরানো যায়?” যা খাদিজার কর্মকাণ্ডকে মহিমান্বিত না করার দিকেই ইঙ্গিত দেয়। 

খাদিজা চরিত্রে কানী কাসরুতির অনবদ্য নৈপুণ্য তাকে দেশে-বিদেশে এনে দিয়েছে অসংখ্য সম্মাননা। যার মধ্যে আছে ২২ তম কেরালা স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেত্রীর পুরষ্কার। তার নৈপুণ্য আর বাবুর শক্তিশালী গল্পের মেলবন্ধনে ‘বিরিয়ানি’ পরিণত হয়েছে সম্প্রতি ভারতে নির্মিত সবচেয়ে চিন্তা-উদ্রেককারী সিনেমাগুলোর একটিতে। তাই অস্বস্তিকর বিষয়বস্তু এবং সমাজ ও ধর্মবিষয়ক খাদিজার বিশ্বাসের সাথে মানিয়ে নিতে পারলে দেখতে পারেন এ সিনেমাটি। এটা নিশ্চিত থাকতে পারেন- এই মুভিতে খাদিজার প্রতিশোধ আপনার ভাবনাকে কাঁপিয়ে দেবে।

Language: Bengali
Topic: Biriyaani movie review

Related Articles