Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিবর্তন: যে গল্পের সত্যিই কোনো শেষ নেই!

“ফরমা‌শ পেয়েছিলাম, এমন গল্প বলতে হবে, যে গল্পের শেষ নেই। এহেন গল্প অবশ্য অনেকই আছে, কিন্তু তার মধ্যে বেশিরভাগই ফাঁকির গল্প, অথচ যার কাছ থেকে ফরমাশ পেয়েছি তাকে ফাঁকি দেওয়া চলে না কোনোমতেই!”

হ্যাঁ,এমন একটা গল্প বলার গুরুদায়িত্বই লেখক পেয়েছিলেন তার ভাইঝি রুনুর কাছ থেকে। কিন্তু কী হতে পারে সেই গল্প? যে গল্পের নায়ক-নায়িকারা সদা-সজীব? এ কি সেই আরব্য রজনীর গল্প, কিংবা আমাদের দেশে যেরকম চালু আছে, শিকারীর জালে ধরা পড়া পাখির ঝাঁক ছোট্ট এক ছিদ্র পেয়ে পালাতে লাগল অনবরত, তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তো বেড়াচ্ছেই? সেরকম কোনো গল্প? দেবীপ্রসাদই দিয়েছেন তার উত্তর,

“এমনতর গল্প শুধু একটাই। সেটা হলো মানুষের গল্প!….থেমে যায়নি মানুষের গল্প,মানুষের গল্প থামে না কোনোদিন।”

লেখক দেবীপ্রসাদ চটোপাধ্যায়; Image Source: irabotee.com

‘যে গল্পের শেষ নেই’ আদ্যোপান্ত মানুষের গল্প। সাড়ে চারশো কোটি বছরের অশীতিপর বৃদ্ধা পৃথিবীর বর্তমান অধিপতি- মানুষের গল্প। এ গল্প নিছক ফিকশন নয়, কিংবা কাল্পনিক কোনো পুরাকথাও নয়, এ হলো বিজ্ঞানসিদ্ধ—বিজ্ঞানপ্রতিপাদিত মানব-বিবর্তনের কথা। আদিমতম এককোষী প্রাণ থেকে কীভাবে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে দেড় কিলো মগজধারী-দোপেয়ে মানুষের বিকাশ হলো, তারই চিত্র এ বই। আরো বড় কথা হচ্ছে, লেখক কেবল মানুষের জীবতাত্ত্বিক বিবর্তন কিংবা জৈব-বিবর্তনের কথা বলেই থেমে থাকেননি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র,সভ্যতার বিবর্তনও তিনি অত্যন্ত কুশলী ভাষায় সংযোজন করেছেন এর সাথে।

প্রকৃতপক্ষে, মানব বিবর্তন বা সভ্যতার বিবর্তন নিয়ে বহু এনসাইক্লোপিডিয়া, মোটা মোটা গবেষণা পুস্তক বের হয়েছে, বিজ্ঞানসভায় ঝড় তুলেছে- কিন্তু তাদের মধ্যে সাধারণের পাঠোপযোগী কয়টি, সে বিষয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে। এ বইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখক তুলে ধরেছেন বিন্দু থেকে সিন্ধু পর্যন্ত মানুষের উদ্ভব আর সমাজবিবর্তনের বৈশিষ্ট্যকে।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে। প্রথম প্রকাশিত হবার পরেই বইটি বিপুল সাড়া ফেলে, একে তো দেবীপ্রসাদের মতন একজন নামজাদা দার্শনিক ও বিজ্ঞান লেখকের বই, আর অন্যদিকে বইটির সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি। শুরুতেই পাঠক ধারণা পাবেন, এটি কোনো দাঁত-কড়মড়ে শব্দওয়ালা— নীরস বিজ্ঞানের বই নয়। যেমন বললাম, বিজ্ঞানের ওপর মেদবহুল বই রয়েছে ঠাসা ঠাসা, কিন্তু সেগুলোর কতগুলো অ্যাপ্রোন আর চশমাওয়ালাদের জন্য, আর কতগুলো সাধারণের জন্য— তা প্রশ্নাতীত নয়। এ ব্যাপারে অবশ্য পাঠককে আশ্বস্ত করছেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায় স্বয়ং,

‘যে গল্পের শেষ নেই’— আমি নিজেই শুধু বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়িনি, ছেলেদের এবং সাধারণ মানুষদের পড়াচ্ছি। কঠিন কথা, একেবারে অজানা কথা সহজ করে বুঝিয়ে বলা বা লেখার চেয়ে কঠিন কাজ জগতে কমই আছে। বৈজ্ঞানিকদের জন্য বিজ্ঞানের বই লেখার সময় জানা থাকে, তারা কতটা বোঝেন না বোঝেন, তাদের বুদ্ধি আর চেতনা কী ধরনের। কিন্তু, অজ্ঞদের বেলায় পড়তে হয় মুশকিলে। কার্যতই দেবীপ্রসাদবাবু অসাধারণ কাজ করেছেন এ বইটিতে।

সর্বমোট ৪১টি ছোট ছোট রচনায় বা প্রবন্ধে লেখক বলেছেন মানুষের গল্প। বইটিকে মোটাদাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, প্রাক-মানবযুগ থেকে মানবপ্রজাতির বিবর্তন এবং ‘অসভ্য’ মানবপ্রজাতি থেকে আধুনিক-উন্নত মানবসভ্যতার বিবর্তন। প্রথম অংশে পৃথিবী সৃষ্টির পর প্রাণের আবির্ভাব থেকে শুরু করে ছয় প্রধান মহাযুগে জৈববিবর্তনের মহা-আখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। প্রাণের আবির্ভাব, বিবর্তনের জীবতাত্ত্বিক-দেহতাত্ত্বিক প্রমাণ, বিবর্তন ধারণার আবির্ভাব, পাললিক পাহাড়ের বুকে প্রাণের দাগ ফসিল, অ্যামিবাজাতীয় সরল জীব-মাছ-উভচর-সরীসৃপের পর স্তন্যপায়ীর বিবর্তনের কথা উঠে এসেছে এ অংশে।

যে গল্পের শেষ নেই; Image Source: Prothom Alo

ভালো লেগেছে বিবর্তন-বিষয়ক সূচনা বক্তব্যটুকু। আমরা সিনডারেলার গল্প পড়েছি সকলেই, যেখানে জাদুর বুড়ি তার রূপোর কাঠির ছোঁয়ায় কুমড়োকে ঘোড়া-টানা গাড়ি আর টিকটিকিকে পরিণত করে সেই গাড়ির চালককে, বিবর্তন কি তেমনই কিছু? বা ঐ গল্পটাকেই যদি একটু এগিয়ে দিই, ধরুন, গাড়ি বানানোর জন্য এ বুড়ির কাছে কুমড়া নেই। একটা বক্সের মধ্যে রয়েছে পেরেক, বিয়ারিং,নাট-বল্টু, লোহার পাত; বিবর্তন কী এরকম, যে আমি বাক্সটা ঝাঁকি দিলাম, আর বেরিয়ে এলো একটা গাড়ি? দেবীপ্রসাদ এর তুলনাটা দিয়েছেন এভাবে,

“এইতো সে বছর কিনে আনলুম একটা ছাতা, কুচকুচে কালো— টাকের ওপর ছাতা বাগিয়ে যখন ঘুরে বেড়াই, আড়চোখে দেখি পাঁচজন দেখছে কিনা! ওমা,বছর তিনেক ঘুরতেই দেখি ছাতাটার রঙ হয়েছে ফ্যাকাশে, ধ্যাড়ধ্যাড়ে-নড়বড়ে, সেটা হয়ে গেছে লক্কড় ছাতা। কিন্তু কবে বদলালো? রোজই তো ঐ ছাতা হাতে বেরোচ্ছি, কখনো তো দেখলাম না যে ওর কালো রঙ ফিকে হয়ে যাচ্ছে!

রোজই মনে হয়েছে, সেই ছাতাটিই।……..তাহলে মানতে হবে ছাতাটা রোজই বদলেছে, কিন্তু সে বদলটা বড় মিহি। এমন মিহি যে চোখে ধরা পড়ে না, ধরা পড়ুক আর না পড়ুক, বদলটা পুরো দমেই চলছে, তার বিরাম নেই।…..পৃথিবীর যত গাছপালা,জীবজন্তুর বেলাতেও একই কথা।”

এরপর লেখক হাজির করেছেন ইয়োহিপাস থেকে ঘোড়ার বিবর্তনের কথা। বস্তুত জেনেটিক ড্রিফট, মিউটেশনের মতো জটিল আলোচনা না এনেও যে সাধারণ সহজ-বুদ্ধি পাঠকের মনে আলোড়ন ফেলা যায়,তা বোধ করি দেবীপ্রসাদই দেখিয়ে গেলেন।

দ্বিতীয় অংশে এসেছে সভ্যতার বিবর্তনের কথা। চার-পা ছেড়ে আদি হোমিনিডরা কী করে নেমে এলো দু-পায়ে, হাত দুটোকে কাজে লাগিয়ে হাতিয়ার বানাতে শিখলো, সমাজ গড়তে শিখলো, পৃথিবীকে জয় করার পথে নামল— সে কথাই বলা হয়েছে এখানে। সভ্যতার বিবর্তনে আদিম কৃষি সমাজ, শিকারী সমাজ থেকে কিছুটা উন্নত সামন্ত সমাজ, ক্রীতদাস, প্রাচীন রোম-গ্রিক-মিসর সভ্যতা, গঙ্গার কিনারে সিন্ধু সভ্যতা, নগরের পত্তন এবং মেহনতিদের হাতে নতুন পৃথিবীর যাত্রার গল্প উঠে এসেছে এখানে। চারপেয়ে-বৃক্ষচারী বনমানুষ সভ্য হওয়ার হতে হতে একসময় তাদের মধ্যে জন্মালো গোষ্ঠীবদ্ধতা। মানুষের মধ্যে কীভাবে সংস্কার-বিশ্বাসের জন্ম নিলো, তার বর্ণনা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।

আদিকাল থেকেই যে চিন্তা আর মন নিয়ে আমরা আমাদের চতুর্পাশে বিষয়ভিত্তিক বাস্তবতা তৈরি করেছি, সেই বাস্তবতাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে হাজারো মানুষ। তখন তা পরিণত হয়েছে কাল্পনিক বাস্তবতাতে। সমাজ,পরিবার, দেশ গড়ে উঠেছে আমাদের কাল্পনিক বাস্তবতায়। এই গড়াগাঁথাতে মানুষকে সাহায্য করেছে নাচ, ছবি আর ইন্দ্রজাল— আসল পৃথিবীকে জয় করার যে অভাব, সেটা কল্পনায় জয় করা দিয়ে পূরণ করে নেওয়া। বাকিটুকু নাহয় আগ্রহী পাঠকের জন্যেই তোলা থাকলো!

আদি হোমিনিড সম্প্রদায়; Image Source: Sapiens.org

এখানে উল্লেখ্য যে, বইটির রচনাকাল বেশ পুরাতন বিধায়, সেখানে তথ্যগত কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন প্রথমেই আপনার নজরে আসবে মৌলের সংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ৯২, আমরা জানি বর্তমানে তা ১১৮। এরকম কিছু বিষয় বাদ দিলে এক কথায় পুরো বইটি অসাধারণ। একেবারে গল্প বলার মতো অনাবিল এর ভঙ্গি। কোথাও একটুও প্রাচীনত্ব, একটুও জড়তার লক্ষণমাত্র নেই। বইটিতে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মানবসমাজ ও সভ্যতার সুদীর্ঘ ক্রমবিকাশকে যে দক্ষতায় দুই মলাটে মাত্র ১০৩ পৃষ্ঠায় তুলে ধরা হয়েছে, তা সত্যিই তুলনারহিত।

বইটি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন আশা করি। তাই আগ্রহী পাঠক একটু সময় করে বইটিকে সাথে নিয়ে টাইম ট্র্যাভেল ক্যাপসুলের সিটবেল্ট বেঁধে আঁটসাট করে বসে কিন্তু পড়তেই পারেন। ঘড়ির কাঁটা পেছাতে পেছাতে হয়তো পৌঁছে যাবেন মায়া কিংবা মাচুপিচু সভ্যতার প্রত্যন্ত গুহায়, হয়তো দেখবেন খটখটে রোদের মধ্যে মেক্সিকোর ‘তারাহুমারে’রা কেমন করে বৃত্তাকারে গান গাইতে গাইতে নাচছে, বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে পানির ছিটা, যেন সমস্বরে তাদের ভাষায় গাইছে, ‘আল্লাহ মেঘ দে,পানি দে’!

আরো একটু পেছোলে হয়তো দেখবেন ওরাঙ-ওটাঙ বা বানরদের কাছাকাছি চেহারার, নিচু কপাল আর উঁচু-চওড়া ভ্রূ’র নিয়ান্ডার্থালরা এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে গাছের ডাঁটা, নরম কন্দ কিংবা আফ্রিকা এলাকায় হয়তো দেখবেন কিছুটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারা অস্ট্রালোপিথেকাসরা পাথর খুঁটে বেড়াচ্ছে, খেয়ালই করছে না আপনার উৎসুক দৃষ্টি।

এ গল্প আমাদের বিবর্তনের গল্প; Image Source: DailyHunt

সাহস করে যদি একটু জোরালো রোটে‌শন যদি দিতে পারেন, আর আপনার ভাগ্য যদি ভালো থাকে, তাহলে হয়তো চোখের সামনেই দেখতে পারবেন প্রায় সাড়ে বারো কোটি বছর পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানো জুরাসিক যুগের ডাইনোসরদের! আপনার ক্যাপসুলের পাশ দিয়েই হয়তো জলাভূমির গাছের দিকে হেঁটে চলে যাবে ৫৮-হাতি ডিপলোডোকাস, শুকনো আকাশে দেখবেন উড়ন্ত সরীসৃপ টেরোড্যাকটিল আর সরীসৃপ-পাখির সংযোগকারী আর্কিওপটেরিক্স, হঠাৎ হয়তো ৪৫ ফুট লম্বা বিভৎসমুখো যমদূত টি রেক্সের গগনবিদারী চিৎকারে অন্য বড় বড় ডাইনোসরদের মতো আপনিও থরহরি কম্পমান। হোক না সেসব বহু বহু বহু বছর আগেকার রীতিমতো অবিশ্বাস্য সব ঘটনা, ছবিগুলো তো আজও সত্যি!

আরো জানতে পড়ুন এই বইটি- Sapiens: A Brief History Of Humankind

This is a Bangla Article. This is a book revie on 'Je golper sesh nei' written by Devi Prasad Chattopadhyay. This book is about the evolution of mankind.

Featured Image: BioEdge

Related Articles