Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাশগড় কত না অশ্রুজল: একুশ শতকের ভয়াবহ গণহত্যার উপাখ্যান

কিছু বই আছে যা পড়ে মানুষ তৃপ্ত হয়, আনন্দিত হয়, কিংবা আবেগে আপ্লুত হয়। আবার এমন কিছু বই আছে যার ঘটনা মানুষের মনে রোদন সৃষ্টি করে। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুজল। ‌বইয়ের প্রতিটি পাতায় বর্ণিত ঘটনার বিবরণে মানুষের হৃদয় কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ভেতরে জেগে ওঠে হাহাকার। আর বইটি যদি হয় সত্য ঘটনার বিবরণে পরিপূর্ণ, তাহলে এই কষ্টের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। ঘটনাগুলো যদি বর্তমানের হয়, তাহলে তো কথাই নেই!

কাশগড় কত-না অশ্রুজল‘ ঠিক এমনই একটি বই। ২৬৪ পৃষ্ঠার এই বইয়ে ঠাসা রয়েছে পূর্ব তুর্কিস্তানে উইঘুর নির্যাতনের হৃদয়বিদারক অসংখ্য ঘটনা। উঠে এসেছে ক্ষমতা, রাজনীতি এবং বিশ্বমানবতার বেড়াজালে চাপা পড়া নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ। এ আর্তনাদ আর আহাজারি ক’জনের কানেই বা পৌঁছেছে! তরুণ ও নিভৃতচারী লেখক মুহাম্মদ এনামুল হক এই বইয়ে তুলে এনেছেন উইঘুর নির্যাতনের না বলা অশ্রুজল বিশ্রুত ঘটনাগুলো।

বৌদ্ধ ও অধার্মিক অধ্যুষিত চীনের পূর্ব তুর্কিস্তান প্রদেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলে দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে বসবাস করে আসছে তুর্কি উইঘুর এবং কাজাখ মুসলিমরা। তাদের রয়েছে নিজস্ব ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বকীয় সমাজ ব্যবস্থা। চীনাদের সাথে তাদের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই, মিল আছে তুর্কি মুসলামানদের সাথে।

লাল রঙে ১৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পূর্ব তুর্কিস্তান; image source: wikimedia commons 

প্রায় ১৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই অঞ্চলটি প্রাকৃতিকভাবে অপরূপ সৌন্দর্যময়। জনসংখ্যা আড়াই কোটিরও বেশি। উইঘুরদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। ভিন্ন জাতিসত্তা, ধর্ম ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়ার কারণে চীন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তারা দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম করেছে। এ জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু সশস্ত্র গ্রুপ, যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়। তবে উইঘুরদের মধ্যে এমন বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব পোষণকারী লোকদের সংখ্যা খুবই কম। তারপরও স্বাধীনতা দাবিকারীদের দমন করতে গিয়ে চীন সরকার ছাড় দেয়নি কোনো উইঘুরকেই।

উইঘুরদের ওপর চীনের জুলুমের ইতিহাস অনেক পুরনো। সর্বশেষ জুলুম চলছে কম হলেও ৭০ বছর ধরে। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর ধরে এ নির্যাতন নতুন মাত্রা পেয়েছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ উইঘুর নারী-পুরুষকে। বাদ যায়নি শিশু এবং বৃদ্ধরাও। বইয়ে মোট ২১টি অধ্যায়ে উইঘুর নির্যাতনের ফিরিস্তি তুলে আনা হয়েছে।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নাম করে কীভাবে উইঘুরদের উপর নৃশংস নির্যাতন চালানো হচ্ছে; ধর্ষণ, খুন, গুম, জাতিসত্তা ভুলিয়ে দেওয়া, জোরপূর্বক বিবাহসহ নানা ধরনের অনৈতিক কার্যক্রমের বিবরণ বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এমন সব রোমহর্ষক ও নৃশংসতার বর্ণনা এতে রয়েছে, যার কারণে প্রকাশনী সংস্থা বইটির পেছনে সতর্কবার্তা হিসেবে “শিশু ও দুর্বল চিত্তের পাঠকদের জন্য উপযুক্ত নয়” কথাটি সংযুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে।

লেখক এনামুল হোসাইন বর্ণনা করেছেন- সমাজতান্ত্রিক চীন সরকার উইঘুরদের জাতিসত্তা ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে, কেননা ধর্ম ও সংস্কৃতি ভুলিয়ে যদি তাদেরকে কমিউনিস্ট সরকারের অনুগত করা যায়, তাহলে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন চিরতরে অস্তমিত হয়ে যাবে।

সমগ্র পূর্ব তুর্কিস্তানে কায়েম করা হয়েছে নিশ্ছিদ্র পুলিশি রাষ্ট্র। আড়াই কোটি মানুষকে নজরে রাখতে বসানো হয়েছে ৬৩ কোটি ফেসিয়াল রিকগনিশন ক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা। এমনকি উইঘুরদের ঘরের মধ্যে শয়নকক্ষেও রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। লক্ষ্য একটাই, তারা যেন তাদের কোনো সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় আচার পালন করতে না পারে।

কোনোরকম সন্দেহজনক কার্যক্রম চোখে পড়লেই সাথে সাথে পুলিশ ধরে নিয়ে ভর্তি করবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। আর একেকটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প যেন জীবন্ত নরক।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের এই ছবিটি ২০১৮ সালে অনলাইন দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে; image source: al jazeera 

বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে চীন সরকার শত শত মসজিদ ধ্বংস করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে, আরবি লেখা মুছে দিয়েছে, আজান নিষিদ্ধ করেছে, নামাজ-রোজা নিষিদ্ধ করেছে, মুসলমানদের বাধ্য করেছে শুকরের মাংস খেতে ও মদ পান করতে। এমনকি ঘোষণা দিয়ে বিকৃত করেছে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআন শরীফ। এছাড়া বইটির ভাষ্য অনুযায়ী, উইঘুরদের মোবাইল নেটওয়ার্কেও চীন সরকার নজরদারি করছে। বিদেশে কারো সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেই তাৎক্ষণিকভাবে সেই তথ্য পৌঁছে যায় পুলিশের কাছে। ‌ আর সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ এসে ধরে নিয়ে বন্দী করছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।

বইটিতে লেখক প্রমাণ করেছেন- চীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছে ‘উইঘুরদের বংশ, শেকড়, সম্পর্ক এবং উৎস ভেঙে দেওয়ার’; সরকারের নিজস্ব দলিল-দস্তাবেজেই স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে এমন প্রমাণ।

চীনের এমন বর্বর নির্যাতনেও নিশ্চুপ কেন বিশ্ব? এমন প্রশ্নের উত্তরে লেখক উল্লেখ করেছেন চীনের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, বিশাল ভোক্তা বাজার, সস্তা শ্রমবাজার, বিনিয়োগ লাভের আশা, সামরিক শক্তি, কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি এবং জাতিসংঘে ভেটো প্রদান ক্ষমতা বিশ্ব মোড়লদের নীরব করে রেখেছে।

স্যাটেলাইট থেকে তোলা একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ছবি; image source: bbc.com

লেখক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পকে বর্ণনা করেছেন ভয়ঙ্কর এক নির্যাতনশালা হিসেবে, যেখানে মানুষ শুধু নিজের মৃত্যুই কামনা করে। তাছাড়া লেখক চীন সরকারের এই গণহত্যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসিদের চেয়েও জঘন্য বলে উল্লেখ করেছেন। চীন সরকারের কৌশলী নীতির কাছে হার মেনেছে বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো। পূর্ব তুর্কিস্তানে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পর্যাপ্ত তথ্য নেই কোনো দেশ বা গণমাধ্যমের হাতে। এমনকি তথ্য নেই খোদ জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হাতেও।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, উইঘুরদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ কি আসলেই সত্য? নাকি কল্পনাপ্রসূত? যদি সত্যই হয়ে থাকত, তাহলে গণমাধ্যম, জাতিসংঘ কিংবা বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নীরব কেন? অনেকেই আবার মনে করেন পশ্চিমা বিশ্ব চাপ প্রয়োগ করতেই এমন কল্পিত দায়ভার চীনের উপর চাপিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কী? এই বইটির চমৎকার উপস্থাপনায় পাঠক অবলীলায় এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবেন।

  উইঘুরদের প্রতিবাদ; image source: bbc.com

বইটিতে লেখক প্রত্যেকটি ঘটনার একাধিক বিশুদ্ধ তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছেন। এমন একটি ঘটনাও চোখে পড়েনি যেখানে তথ্যসূত্রের ঘাটতি আছে। ঘটনার সত্যতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। লেখক ঘটনাগুলো এত সহজ এবং সাবলীল ভাষায় তুলে এনেছেন যেন চোখের সামনেই সবকিছু ঘটছে। ‌প্রাঞ্জল, সহজ-সরল বাক্য চয়নের জন্য পড়তে গিয়ে কোথাও থামতে হয়নি। চমৎকার বর্ণনাভঙ্গি এবং প্রচলিত শব্দ ব্যবহার বইটিকে চমৎকার করে তুলেছে।

বইটির লেখক মুহাম্মাদ এনামুল হোসাইন একজন অ্যাক্টিভিস্ট। জন্ম ১৯৯৩ সালে। বেড়ে ওঠা ঢাকায়, পড়াশোনাও করেছেন ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন সামাজিক ব্লগে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি লেখালেখি করছেন। ‘কাশগড় কতো-না অশ্রুজল‘ নিভৃতচারী এই লেখকের প্রথম গ্রন্থ। বইটি সম্পাদনা করেছেন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট আসিফ আদনান।

‘কাশগড় কতো-না অশ্রুজল’ বইটি প্রচ্ছদ; Image Courtesy: Ilmhouse Publication

উইঘুর নির্যাতনের দলিল ও তথ্য-প্রমাণসহ এটি বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক বই। এ বিষয়ে যারা বিস্তারিত জানতে চায় ও বিশ্ব রাজনীতির ফিরিস্তি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে আগ্রহী, তাদের জন্য বইটি জ্ঞানের দরজা খুলে দেবে।

বইটি সংগ্রহ করতে

বই: কাশগড় কতো-না অশ্রুজল
লেখক: মোহাম্মদ এনামুল হোসাইন
প্রকাশনা সংস্থা: ইলমহাউজ 
মূল্য: ২৬০ টাকা

This Bengali article gives a review on the book 'Kashgar Koto Na Oshrujol' by Mohammad Enamul Hossain.

Related Articles