Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাজার-সদাই থেকে খাওন-দাওন!

গুগল ট্রান্সলেটর বলছে, ‘Craving’ শব্দটির বাংলা হলো লালসা! আরো কিছু ডিকশনারি ঘেটে ক্ষুধা, অতৃপ্ত ইচ্ছা ইত্যাদি বহুবিধ অর্থ পাওয়া গেল। তবে বলাই বাহুল্য, এর কোনোটাই ‘Craving’ এর মানেটা ঠিকভাবে বোঝাতে পারছে না। ‘নোলা’ হতে পারতো উক্ত ইংরেজি শব্দের সুন্দর একটি প্রতিশব্দ। এই শব্দের বহুল ব্যবহার কাঁটাতারের ওপাশের বাংলায় দেখা গেলেও বাংলাদেশে তেমন দেখা যায় না। তবে শব্দের ব্যবহার তেমন না থাকলেও খাবারের প্রতি দুই বাংলার মানুষের যে ভালোবাসা সেটা একদমই আদি ও অকৃত্রিম। খাবারের কথা বললেই যে বিষয়টা সবসময় অনুচ্চারিতভাবে সাথে লেগে থাকে তা হলো বাজার-সদাই। আজকের আলোচনা সেই তিনটি বই নিয়ে, যেখানে আলোচ্য বিষয় বাজার থেকে ঘুরে খাবার টেবিল হয়ে পৌঁছে গেছে খাদ্যের ইতিহাস পর্যন্ত।

‘বাজার সফর সমগ্র’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: Goodreads

একটা বাজার শুধু যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করে এমন কিন্তু নয়; কোনো এলাকার বাজার সেখানকার ইতিহাস, অর্থনীতি, মানুষের আচার-অভ্যাস সবকিছুই ধারণ করে। এমনকি, একটি অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রা কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে সেটা সেখানকার বাজার পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, আজকাল পত্রিকায় লেখা ‘বাজার সফর’ কলামে সেই কাজটিই করতেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে তার সেই সকল কলামগুলো একত্র করে বই আকারে ‘বাজার সফর সমগ্র’ নামে প্রকাশ করে আজকাল।

১৯৯৭ থেকে ২০০০ দীর্ঘ তিন বছরে লেখক অসংখ্য বাজারে ঘুরেছেন, ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে কথা বলেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন সেই সময়ে ঐ বাজারের জিনিসপত্রের দর-দাম। বলা যেতে পারে- শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার সময়কে বেধে ফেলতে পেরেছেন। তার কলামগুলোতে উঠে এসেছে বাজারের ইতিহাস, সময়ের সাথে বাজারের, মানুষের, ইতিহাসের পরিবর্তন। শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তনের দিকে না হেঁটে লেখক চেয়েছেন বাজারের মানুষগুলোকে ধরতে, ক্রেতা-বিক্রেতা, তাদের আচরণ, ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় মানুষের রীতি-নীতি, বাজারের রকমভেদে মানুষের পরিবর্তন সবই উঠে এসেছে তার লেখায়।

সাধারণ মধ্যবিত্ত ছা-পোষা মানুষদের জীবিকা আবর্তিত হয় জীবনধারণকে কেন্দ্র করে। কোন বেলায় কী খাওয়া হবে, সেই হিসেবে দিনের বাজার ও মাসের পয়লায় মাসকাবারি বাজারের পরিকল্পনা সাধারণ পরিবার কর্তা-কর্ত্রীর জীবনের বড় একটা অংশ। প্রত্যক্ষভাবেই বাজার ও বাজারদর মধ্যবিত্তের জীবনের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বাজার বুঝলে মানুষ পড়ে ফেলা অনেক সহজ হয়ে যায়। লেখক সেই চেষ্টাই করেছেন তার লেখায়। এই বইয়ে বাজারের মাধ্যমে আসলে তুলে ধরা হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনকেই।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় শুধু যে দৈনন্দিন বাজারের অভিজ্ঞতা লিখেছেন এমন নয়; তার লেখায় উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের হাটবাজারের ইতিহাস থেকে শুরু করে গৃহস্থের হেশেলের অন্দরের খবর পর্যন্ত। বইটিকে নব্বই দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাজারদর ও সামাজিক অবকাঠামো পরিমাপের একটা বাটখারা বলা যেতে পারে। সমাজের একদম উঁচু স্তরের মানুষের বাজার করা, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে লেখক পৌঁছে গিয়েছেন একদম নিচু স্তরের মানুষদের জীবনযাপন, মানি ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার সময়কে বাঁধাই করে রেখেছেন ধ্যানীর নিষ্ঠায়, স্বভাবসুলভ উইটের সাথে।

লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ;Image Source: Prohor

বাজার থেকে এবার আসা যাক খাবারের পাতে। ‘খ্যাটন সঙ্গী’ বইতে লেখক দামু মুখোপাধ্যায়, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। বলাই বাহুল্য সেই অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সাধারণ দৈনন্দিন তিনবেলা আহারের বিবরণ স্থান পেয়েছে খুব কমই। মূলত বিভিন্ন জায়গায়, কর্মসূত্রে বা যেকোনো কারণে লেখক একদম বাংলার মাটির কাছাকাছি গিয়ে যে ‘অথেন্টিক’ স্বাদ আহরণ করেছেন, তারই সংকলন হলো খ্যাটন সঙ্গী।

কখনো পথ চলতে স্রেফ বরাতজোরে লেখক পেয়ে গিয়েছেন অমৃতের আস্বাদ, আবার কখনো খাদ্যের সন্ধানে ছুটে গিয়েছেন অচেনা পথে। নামেই বোঝা যায় যে বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে খাওন-দাওন। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ফুড রিভিউ। এখানে প্রশ্ন হতে পারে- ইউটিউব, ফুড ভ্লগিংয়ের এই যুগে কাগজে ছাপা ফুড রিভিউ আসলে উপাদেয় হবে কি? যেখানে ভিডিওতে, ছবিতে স্বচক্ষে দেখা যাচ্ছে, ভক্ষকের অভিজ্ঞতা শোনা যাচ্ছে, সেখানে শুধু পড়ে কি সেই স্বাদ পাওয়া যাবে? তার উত্তরে বলতে হয়- খাদ্য হোক বা বই, রিভিউ মূলত নির্ভর করে রিভিউদাতার উপর। জাতরসিক হলে লেখাতেও রসালো, সুস্বাদু বর্ণনা করা সম্ভব।

দামু মুখোপাধ্যায় যেভাবে বিভিন্ন খাবার ও তার আশেপাশের পরিবেশের বর্ণনা করেছেন- তা এককথায় অনবদ্য। বৈঠকী চালে লেখা হলেও লেখার বিশেষণ, উপমা প্রয়োগ, কাব্যিক ছন্দময়তা বিন্দুমাত্র বাধাপ্রাপ্ত হয়নি, বরং অন্য এক মাত্রা এনে দিয়েছে। সাথে ছিল লেখকের অসাধারণ সেন্স অব হিউমার। লেখার পরতে পরতে মিশে থাকা সূক্ষ্ম উইট বইটি পড়ার স্বাদ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। বইতে চার দশক ব্যাপী কলকাতা, দার্জিলিং বা এর আশেপাশের জায়গার বিভিন্ন চেনা খাবারের সুস্বাদু বিবরণ যেমন আছে, তেমনি আছে বনেবাদাড়ের, ভারতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত হরেক রসনা তৃপ্তির অভিজ্ঞতার দুর্দান্ত পরিবেশনা। শুধু রেস্টুরেন্ট, ধাবাই নয়, বাড়ির হেঁশেল, পুজোর খাওয়া, দাওয়াত বাড়ির ভোজ, ঘাটে, মাঠে যতরকম খাওয়া ও পান করা সম্ভব তার সবকিছু নিয়েই সাজানো হয়েছে বইটি।

পড়তে যেমন দেখতেও তেমন সুন্দর বইটি; Image Source: Asif Khan Ullash

বইয়ের অন্দরের সাথে সাথে বাহিরও অত্যন্ত মনোগ্রাহী। শক্তপোক্ত, রাউন্ড স্পাইন ও ভেতরে মাখনরঙা খসখসে কাগজের উপর কাপড়ের বাঁধাই, বইটা হাতে নিলেই বনেদি একটা ভাব আসতে বাধ্য। গাঢ় নীলরঙা প্রচ্ছদের সাথে ভেতরের পাতায় পাতায় স্বারক রায়ের আকা বিমূর্ত চিত্রাবলী লেখার আবেদন অনেকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকাশনীর নামটাও বেশ সুন্দর ‘৯ঋকাল বুকস’, অদ্ভুত না? আসলে এই ‘৯’ কিন্তু ‘নয়’ নয়। এটা হচ্ছে কালের পরিক্রমায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া স্বরবর্ণ ‘লি’। তাহলে, প্রকাশনীর নাম দাঁড়াচ্ছে লিরিকাল বুকস। সব মিলিয়ে সুপাঠ্য তো বটেই, সংগ্রহে রেখে বার বার খুলে চোখ বুলানোর মতো একটা বই।

নোলা বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: Goodreads

বাজার-সদাই থেকে খাবার-দাবার পর্যন্ত তো হলো, এবার ঘুরে আসা যাক খাদ্যের ইতিহাসের পাতা থেকে। ‘নোলা’ গ্রন্থে লেখক কৌশিক মজুমদার ছুঁয়ে এসেছেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সকল পরিচিত খাবারের ইতিহাস। রসগোল্লা থেকে এগ বেনেডিক্ট, কফি থেকে কেচাপ, বালিগঞ্জ থেকে বার্লিন কিছুই বাদ রাখেননি লেখক। শতেক রকমের খাবারের উৎপত্তি আর মজার ইতিহাসের ছোট ছোট টোটকা দিয়ে সাজানো বইটি অত্যন্ত উপাদেয়। ছোট পরিসরে বাঙালির পরিচিত প্রায় সকল খাদ্যের ইতিহাস নিয়ে বইটি পরিণত হয়েছে একটি জলজ্যান্ত তথ্যভান্ডারে। অনেক অনেক তথ্য সন্নিবেশিত হলেও কৌশিক মজুমদারের লেখনীর গুণে বইটি কোথাও তথ্যের ভারে নুয়ে পড়েনি, খুবই সাবলীল ও প্রাণবন্তভাবে গল্পের মাধ্যমে তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছেন লেখক।

খাদ্য মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাবার, বাজার, খাবারের ইতিহাস সম্পর্কে জানা মানে মানুষ সম্পর্কে, মানবসভ্যতা সম্পর্কে জানার পথে অগ্রসর হওয়া। উপরিউক্ত তিনটি বইয়ের প্রতিটিই ওপার বাংলার লেখকদের লেখা, তাই স্বভাবতই বাংলাদেশের মানুষের বাজার বা খাদ্যাভাসের কথা সেগুলোতে স্থান পায়নি। কিন্তু আমাদেরও আছে হাজার বছরের পুরনো বনেদি ইতিহাস, আশা থাকলো ভবিষ্যতে কোনো কৃতী লেখকের পথ ধরে সেগুলো আরো বিশদভাবে পড়বার ও জানবার সুযোগ হবে।

This article is a Bangla review of three books about food.

Feature Image credit: The Young Environmentalist

Related Articles