Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত: চলচ্চিত্রই যার হাতিয়ার

আমি প্রেমে ডুবে থাকা একজন মানুষ। এই প্রেম শুধু নারীর নয়। এই প্রেম কবিতার জন্যও। সিনেমার প্রতিও। 

উক্তিটি বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের। বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে যে ক’জন উজ্জ্বল নক্ষত্র রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত অন্যতম।

বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত; Image source: spotboye.com

সুতরাং সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের পর যে তাঁরই অবস্থান, সে কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা যায়। আনন্দবাজারকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন,

আমি একধরনের যথেচ্ছাচারে বিশ্বাসী। আমি খারাপ অর্থে যথেচ্ছাচার বলছি না। ক্রিয়েটিভলি হওয়া দরকার, এটা না হলে ওই চারপাশের ট্র্যাডিশনের মধ্যেই আটকে পড়তে হয়।

উপরের উক্তির যথাযথ প্রতিফলন দেখা যায় বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের গৃহযুদ্ধ, কালপুরুষ, ফেরা, উড়োজাহাজ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে। তিনি নিজের চিন্তা চ-তনাকে মেলে ধরতেন  চলচ্চিত্র দিয়ে, যেখানে নেই কোনো বাধা বা ভীতি।সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটকের মতো তাঁর ছবিতে কেবল বাস্তবতাই স্থান পেত না। বাস্তবতার মাঝে উঁকি দিত মানবমনে লুকিয়ে থাকা দিবাস্বপ্নগুলোও। যেখানে মানুষ কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে মন খুলে ঘুরে বেড়াতে পারে।তাঁর সিনেমায় থাকে কিছু স্বপ্ন, কিছু জাদু, কিছু বাস্তবতা।

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত। তিনি চান বাস্তবতার মাঝেই বেঁচে থাকুক আমাদের স্বপ্নেরা। তাই তাঁর গল্পেও দেখা যেত বাস্তবতা আর স্বপ্নের মিশ্রণ। সর্বশেষ ২০১৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর ‘উড়োজাহাজ’ চলচ্চিত্রেও শিল্পের স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। একজন শিল্পীর স্বাধীন চিন্তাভাবনায় শাসকগোষ্ঠীর প্রভাব কীভাবে হানা দেয় তা দেখানো হয়েছে সিনেমাটিতে। আনন্দবাজার পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন,

পুরো বাস্তব নয়। একটা এক্সটেন্ডেড রিয়্যালিটির বিষয় আছে আমার ছবিতে। উড়োজাহাজও তা-ই। 

উড়োজাহাজ সিনেমার পোস্টার; Image source: jiyobangla.com

শুধু চলচ্চিত্রনির্মাতা বলে সম্বোধন করলে কিন্তু মস্ত বড় ভুল হবে! কারণ কবিতা থেকে শুরু করে শিল্পের অন্যান্য গলিতেও আছে তাঁর যাতায়াত। তাঁর অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো- তিনি ষাটের দশকের এক গুণী কবি ।তাঁর কবিতা পড়লে যেমন অন্যরকম ঘ্রাণ পাওয়া যায়, তেমনই তাঁর চলচ্চিত্র থেকেও আসে অন্য এক স্বাদ। তিনি মনে করেন, প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্ব কথনভঙ্গী দরকার। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

আমি কবিতা লিখতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, একটা নিজস্ব কথনভঙ্গি প্রয়োজন।

যেমন- ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক: একটি সাধারণ গল্প’। লোকটি তার গাড়িকে ভালবাসে, গাড়িও তাকে ভালবাসে। গল্প এটুকুই। কিন্তু কী অসাধারণ ভঙ্গি তার! এই সাধারণের মাঝেই লুকিয়ে আছে কত অসাধারণত্ব। ঠিক যেন আসগর ফারহাদী, আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমার মতো।

বুদ্ধদেবের সিনেমায় বারবার প্রতিফলিত হয় বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। সমাজে যে অবক্ষয়ী মনোভাব চলমান তার প্রতি কড়া বার্তা দিয়ে গেছেন তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে। তিনি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলেন তখন প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন। কাকার সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিন দেখতে গিয়ে এই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এরপর তাঁকে মুগ্ধ করেছে কয়েকজন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকের ছবি। তাদের মধ্যে আছেন আকিরা কুরোসাওয়া, ভিক্টোরিয়া ডে সিচা, রবার্টো রেসেকিনি এবং আন্টোনিয়েনি। তবে তাঁর পছন্দের নির্মাতারা হলেন লুইস বানেল, আন্দ্রেই তার্কভস্কি এবং থিও অ্যাঙ্গেলোপোলাস। বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন সত্যজিৎ  রায়।

নিজের সম্পর্কে তার ভাষ্য,

আসলে আমি খুব প্যাশনেট মানুষ। সিনেমাকে পাগলের মতো ভালবাসি। আমি প্রেমে ডুবে থাকা একজন মানুষ। এই প্রেম শুধু নারীর নয়। এই প্রেম কবিতার জন্যও। সিনেমার প্রতিও। মনে করি এটা খুব সুলক্ষণ।

তাঁর নির্মিত কালপুরুষ ছবিতে নায়কের সাথে বাবার যে সম্পর্ক দেখানো হয় তা কতটা হৃদয়গ্রাহী ছিল সেটি বোঝা যায় সিনেমা দেখার পর তাঁর কাছে আসা ফোনকলগুলোর কথা ভাবলে। তিনি কালপুরুষ সম্পর্কে বলেন,

এই সিনেমা দেখার পর আমি অনেক ফোন পেয়েছি। মানুষ ফোন দিয়ে বাবার কথা বলতো, কাঁদতো। কথা বলতে মাঝে মাঝে রাত গড়িয়ে যেত।

বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের কোনো সিনেমাই আত্মজীবনীমূলক নয়। তবে তাঁর জীবনমিশ্রিত কিছু অনুভূতি, উপলব্ধি তিনি ছিটিয়ে দিতেন তাঁর নির্মাণে। উদাহরণ হিসেবে ‘কালপুরুষ’ এর পাশাপাশি বলা যেতে পারে ‘বাঘ বাহাদুর’ সিনেমার কথা।

ছোটবেলার কয়েকটি বছর তিনি কাটিয়েছেন একেবারে বাঙালি সংস্কৃতির বাইরে তেলেঙ্গা জাতির সাথে। এই  তেলেঙ্গারা বাঘের মতো সেজেগুঁজে নাচত, গাইত, উৎসব করত। সেই ধারণা থেকেই বাঘ বাহাদুর’ নির্মাণ করেন তিনি, যেখানে বাঘ নৃত্যশিল্পী হিসেবে ছিলেন পাভান মালহোত্রা।

‘বাঘ বাহাদুর’ সিনেমার একটি দৃশ্য; Image source: artalivegallery.com

ষাটের দশকের একজন গুরুতবপূর্ণ কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর ভাবনা শুধু এই উপমহাদেশের সিনেমার মাঝেই আটকে নেই। বিশ্ব সিনেমায় তিনি রেখে চলেছেন গুরুত্বপূর্ণ ছাপ। সিনেমা তাঁর কাছে ঠিক যেন ক্ষুধা নিবারণের মতো। খিদে যেমন আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়, তেমন সিনেমা না থাকলে বেঁচে থাকাটাই তাঁর জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি মনে করেন, সিনেমা তৈরির তেষ্টাই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

অন্য সব বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সাথে তাঁর একটা তফাত ছিল। তা হলো- কোনো নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে তিনি কাজ করতেন না। ষাটের দশকে তাঁর নির্মাণগুলো এখনও আধুনিক। সেগুলোকে পুরনো বলে মনে হবে না।কারণ তিনি সবসময় ভাবনা বদলানোর কথা বলেছেন। সময় এগিয়ে যাচ্ছে, আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ভাবনাগুলোকে বদলাতে হবে। কাজগুলো হতে হবে সময়োপযোগী।

খুব কম বাঙালি তাঁর মতো এত পুরস্কার পেয়েছেন। গুরুত্ব এবং সংখ্যা দুদিক থেকেই কোনো অংশে কম নয় তাঁর অর্জন। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎসবে বিচারকের মর্যাদাও তিনি পেয়েছেন অনেক। সেরা চলচ্চিত্রকার, সেরা নির্দেশনা, সেরা চিত্রনাট্য এসবের পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন সমালোচকদের পুরস্কারও। দেশীয় এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি আরও আটটি আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন।

চার দশকের এই লম্বা ক্যারিয়ারে বুদ্ধদেব অর্জন করেছেন বহু জাতীয় পুরুস্কার, বহুবার মনোনীত হয়েছেন  আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। শুধু বাংলা নয়, হিন্দি ছবিও করেছেন। মহামারীর কারণে তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্র এখনও মুক্তি পায়নি। সেখানে কাজ করছেন চন্দন রায় সান্যালের সাথে একটি নতুন ছবি তৈরিতে।

চন্দন রায় সান্যালের সাথে পরিচালক বুদ্ধদেব; Image source: republicworld.com

পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার নিকটবর্তী আনারা গ্রামে এই গুণীর জন্ম। বাবা তর্কনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ভারতীয় রেলওয়ের একজন ডাক্তার। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পড়েছেন তিনি। অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও পরবর্তী সময়েনি বেছে নেন চলচ্চিত্রই।

অর্থনীতির ছাত্র হওয়ায় ভারতীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিস্তর দূরত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃত আর্থ-সামাজিক অবস্থার তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে, মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য চলচ্চিত্রকে হাতিয়াররূপে বেছে নেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ১০ মিনিটের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরির মাধ্যমে এ জগতে তাঁর যাত্রা শুরু হয়।

চলচ্চিত্র পরিচালনায় শুধু মেধা বা চিন্তাশক্তিই নয়, দরকার হয় শারীরিক শ্রমেরও। বয়সের কাছে মাঝে মাঝে হার মানতে হলেও তিনি মনে করেন, একজন পরিচালক কখনও অবসর গ্রহণ করেন না।

Related Articles