Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সত্যজিতের ‘চারুলতা’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের সাথেই জড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত মাধুর্য। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে দীর্ঘদিন জমিদারি দেখভালে ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ফিরে ‘নষ্টনীড়’ গল্পটি লিখেন, যা নিয়ে নানা বির্তক রয়েছে। এ গল্পের মূল চরিত্র চারুলতা দেবীর সাথে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের বৌদি কাদম্বরী দেবীকে মেলাবার চেষ্টা করেন আর অমলের চরিত্রটি যেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিয়েই লিখেছেন। ‘নষ্টনীড়’ গল্পের মাঝে দেখানো হয়েছে নব্বই দশকের (১৮৭৯) এক ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী, যার ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছেন তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর মাঝে একটি- ‘চারুলতা’ (অ্যা লোনলি ওয়াইফ)। প্রথম প্রকাশের ৬৪ বছর বাদে সত্যজিতের হাত ধরে এই গল্পটি ‘চারুলতা’ হিসেবে পেয়েছে নতুন এক মাত্রা।

চারুলতা (সংক্ষেপে চারু) চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবিতে প্রথম কাজ করার পর ‘চারুলতা’তে অভিনয় করেছেন তিনি। সত্যজিৎ রায় মাধবীকে প্রথম দেখেছিলেন মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ। সত্যজিৎ রায় এক সাক্ষাৎকারে মাধবী মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমতি আর স্বতঃস্ফূর্ত অভিনেত্রী, সত্যজিতের মনে পড়ে না, কখনো কোনো দৃশ্যের জন্য মাধবীর একবারের বেশি দৃশ্য ধারনের প্রয়োজন হয়েছে।

চারুলতার সেটে সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাধবী মুখোপাধ্যায়; Image source: twitter

প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়, চারুলতা একটি রুমালের উপর নিজের হাতে সেলাই করে নকশা করছে। এরপর সময় কাটাবার জন্য কখনো বঙ্কিমচর্চা করছে, তো কখনো অপেরা গ্লাস নিয়ে ঘরময় একেক জানালা দিয়ে দেখে ফিরছে রাস্তার নানান রকমের মানুষকে, আবার কখনোবা পিয়ানোতে টুংটাং বাজাচ্ছে। চারুলতার স্বামী ভূপতি (শৈলেন মুখোপাধ্যায়) চরিত্রটিকে দেখানো হয়েছে বিত্তশালী, শৌখিন, রাজনৈতিক সচেনতা সমৃদ্ধ একজন মানুষ হিসেবে, যে তার পত্রিকা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।

এর পরের দৃশ্যেই দেখা যায় ভূপতি ব্যস্তভাবে ঘরের মাঝে এসে একটা বই নিয়ে বের হয়ে যায়, তবু চারুকে লক্ষ করে না, চারু অপেরা গ্লাসের মাঝ দিয়ে ভূপতিকে দেখে। এই দৃশ্যের শেষ অংশটি জুম লেন্সে ধারণ করা হয়েছে, হুট করেই অনেকটা দূর থেকে দেখানো হয়। এর মাঝ দিয়েই ফুটে উঠেছে চারুর একাকিত্ব আর ভূপতির ব্যস্ততার ভিড়ে দুজনের মধ্যকার দূরত্বটুকু।

ভূপতি চারুকে খেয়াল না করে চলে যাবার পরমুহূর্তের দৃশ্য (১); Image source: Satyajit Ray production
ভূপতি চারুকে খেয়াল না করে চলে যাবার পরমুহূর্তের দৃশ্য (২); Image source: Satyajit Ray production

চারুর নিঃসঙ্গতা আর পত্রিকার ম্যানেজারের দায়িত্ব দেবার জন্য চারুর দাদা উমাপদকে স্ত্রীসমেত আসার জন্য চিঠি লিখে দেয় ভূপতি। কিন্তু উমাপদের স্ত্রী, মন্দাকিনীর সঙ্গে মনের দূরত্ব চারুর শুরু থেকেই ছিল। তাই তাতে নিঃসঙ্গতা কাটেনি, বরং মন্দার উচ্চবাচ্যতে চারু বিরক্ত হতো বেশ। এরপরে ঝড়ের মাঝে ঝড়ের মতই আগমন ঘটে ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। অমল দেখা হবার সাথে সাথে চারুকে জিজ্ঞেস করে সে আনন্দমঠ পড়েছে কিনা, যার মাঝ দিয়ে সাহিত্যের সুতোতে তাদের দীর্ঘ বন্ধুত্বের আভাস পাওয়া যায়।

মন্দাকিনীর সাথে চারুলতা; Image source: Satyajit Ray production
ঝড়ের মাঝে অমলের আগমন; Image source: Satyajit Ray production

কাহিনীপ্রবাহে বাগানের মাঝে অমলের সাহিত্যচর্চা আর সেইসাথে চারুর দোলনায় বসে তাকে অপেরা গ্লাস দিয়ে দেখার মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হতে থাকে। গানে, কথায়, গল্পে অমলের চারুর তৈরি করা খাতায় লেখা শেষ হয়। এই সাহিত্যচর্চা কেবল তাদের দু’জনের ব্যক্তিগত হবার কথা ছিল এবং সেটা পত্রিকাতে না দেবার শর্ত থাকলেও অমল সে লেখা পত্রিকায় পাঠায় এবং ছাপার পর চারুকে বলবার আগে মন্দা বৌদিকে বলায়, চারুর সাথে অমলের এক মান-অভিমানের সম্পর্ক জন্ম নেয়।

সে অভিমান থেকেই চারুলতা তার ছোটবেলার গ্রাম নিয়ে একটা লেখা পাঠিয়ে দেয় পত্রিকাতে, সেটা ছাপাও হয়। সে পত্রিকা নিয়ে অমলের সামনে দাঁড়িয়ে আবার যেন নিজের সাহিত্য মর্যাদাই প্রতিষ্ঠা করে চারুলতা; কিন্তু অমল তাকে সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যেতে বললে চারুলতা অভিমানের জায়গা থেকে বন্ধুত্বের সীমা উতরে সে কাঁদতে কাঁদতে অমলকে জড়িয়ে ধরে; আবার সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নেয়। চারুলতা কেবল অমলকে বোঝাবার জন্যই লিখেছিল, এতে তার সাহিত্যচর্চার কোনো আগ্রহ প্রকাশ পায়নি- এটা অমল প্রথমে ধরতে পারে না।

দোলনার দৃশ্যে চারুলতা; Image source: Satyajit Ray production
একটি দৃশ্যে অমল আর চারু; Image source: Satyajit Ray production

এদিকে উমাপদকে অর্থ বিষয়ক দায়িত্ব দিলে সে পত্রিকার ধার শোধ না করে সে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়, যেটা ভূপতি বেশ পরে জানতে পারে। এই বিশ্বাসঘাতকতায় ভূপতি অনেক কষ্ট পায়, অমল এর মাঝে আর ঝামেলা বাড়াতে চায় না বিধায় কাউকে না বলে ঘর ছেড়ে চলে যায়। চারুলতা পরদিন সকালে উঠে অমলের প্রস্থানের কথা জানতে পারলে তার ঘরে ছুটে গিয়ে দেখে চারুর নিজ হাতে বানিয়ে দেওয়া চটিটাও রেখে গেছে, যেন বৌদির কোনো স্মৃতিই অমল রাখতে চায় না আর।

এসবের পর চারুলতা আর ভূপতি সমুদ্র ঘুরতে গিয়ে দু’জন আলোচনা করে ঠিক করে, পত্রিকার দু’টি অংশ বের করবে, ইংরেজি এবং বাংলা। যার বাংলা অংশটি দেখবে চারুলতা। ফিরে এসে অমলের চিঠি পায় ভূপতি, সেটা পড়ে চারুকে হাতে দিয়ে সে চলে যায়। চিঠি হাতে চারুলতা কেঁদে ফেলে, ভূপতি সে দৃশ্য দেখে বুঝতে পারে, অমলের প্রতি চারুর ভালোবাসাটা কেবল বন্ধুত্বে নেই আর।

এতে কষ্ট পেয়ে ভূপতি বাইরের কাজ শেষ করে যখন ঘরে ফেরে, চারু তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। কিছুটা ইতস্তত করে ভূপতিও যখন হাত বাড়িয়ে দেয় তাদের দু’জনার হাতের মাঝে কিছুটা দূরত্ব থাকতেই দৃশ্যটা ফ্রিজ হয়ে যায় এবং সে দূরত্ব রেখেই সিনেমাটি শেষ হয়ে যায় আর পর্দায় ভেসে ওঠে নষ্টনীড়, যা ভাঙনের সুর হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। তাদের হাতের মাঝের সেই দূরত্ব যেন দুজনের সম্পর্কের দূরত্বের প্রতীকী হয়ে থাকে। তাদের হাতের মাঝের শূন্যতা যেন কখনোই পূরণ হলো না।

ভূপতি আর চারুলতার হাতের মাঝখানের শূন্যতা; Image source: Satyajit Ray production

এই সিনেমাটির দৃশ্যায়ন বিশেষভাবে প্রশংসিত। ‘চারুলতা’তেই প্রথম সত্যজিৎ নিজে ক্যামেরা হ্যান্ডেল এবং প্রথম জুম লেন্সের ব্যবহার করেছেন। বাগানে দোলনাতে বসে ফুলে ফুলে গান গাওয়ার সময় চারুলতার দৃশ্যটি অসাধারণ সিনেমটোগ্রাফির অনন্য এক উদাহরণ। এই দৃশ্যটি যখন ধারণ করা হয়, তখন মাধবী মুখোপাধ্যায় গানটি পারতেন না, সত্যজিৎ রায় তাকে একটা নির্দিষ্ট তালে গানটি কবিতার মতো করে বলতে বলেন, দৃশ্যটি ওভাবেই ধারণ করা হয়। পরে গানটি ডাবিং করা হয়েছে স্টুডিওতে। কিন্তু এ বিষয়টি এতটাই দক্ষতার সাথে করা হয়েছে যে সিনেমাতে দেখলে বোঝার উপায় নেই।

ক্যামেরা পরিচালনায় সত্যজিৎ রায়, Image source: Times of India

এই সিনেমায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে রবীন্দ্রনাথের সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, সিনেমার চরিত্রগুলোও যেন ঠিক সেরকম। চারুলতার শ্যুটিংয়ের সেট যে বাড়িটার ওপর হয়েছে, সেটি প্রায় তিন-চারতলা ছিল। কিন্তু, সিনেমাতে সেটা একেবারেই ধরা পড়েনি আর তার মূলেই ছিল বংশী চক্রবর্তীর দক্ষতা।

রবীন্দ্রনাথের অমলের সাথে সত্যজিতের অমলের অনেক পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথের অমল ছিলেন বেশ একগুঁয়ে এবং ডিমান্ডিং, সে তুলনায় সত্যজিতের অমলের চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছে সহানুভূতি আর বিবেচনাবোধ। ‘চারুলতা’তে অমলের দিক থেকে চারুর প্রতি কখনো প্রেমের প্রকাশ বা সেটা গ্রহণের কোনো আভাস পাওয়া যায় না বরং দাদার সংসারে আর অশান্তি যেন না আসে সে বিষয়ে তার বিবেচনা বোধটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

নষ্টনীড় গল্পটির শেষে ভূপতি চারুকে বলে “চলো, চারু, আমার সঙ্গেই চলো” । চারু তার বিপরীতে বলে “না থাক”। কিন্তু সত্যজিতের শেষটা স্ক্রিপ্টে লেখা ছিল না। অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দৃশ্যটি ফ্রিজ করে দেবার ভাবনাটা সত্যজিতের মাথায় আসে। সংলাপে নয়, বরং অনুভূতিটাকে দেখাতে চেয়েছেন সত্যজিৎ। এই দেখানোর বিষয়ে তিনি ছিলেন পারদর্শী। সিনেমাটা কেবল সংলাপ আর চরিত্রই নয়, সে সাথে দেখারও এবং অনুভব করারও বটে- আর এ জিনিসটা সত্যজিৎ তার সিনেমা দিয়ে বারংবার বুঝিয়ে গেছেন।

সিনেমার শেষ দৃশ্য; Image source: Satyajit Ray production

চারুলতা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং এখন অবধি সমাদৃত। এই সিনেমাটি ১৯৬৪ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে পুরস্কার পেয়েছে, ১৯৬৫ সালে ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ আরও নানা পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছে। সমালোচকদের মতে, ‘চারুলতা’ই সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ কাজ।

সত্যজিতের সবগুলো কাজের মাঝে ‘চারুলতা’র আলাদা মাধুর্য রয়েছে, প্রতিটি ফ্রেমই যেন একেকটি অনবদ্য গল্প। সত্যজিৎ তার এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছেন, চারুলতা তার করা কাজগুলোর মাঝে সবচেয়ে কম ত্রুটিহীন কাজ, এই সিনেমাটি আবার বানাতে হলে তিনি ঠিক এভাবেই বানাতেন।

This is a Bengali article. It discusses some of the back-stories of 'Charulata', one of the best creations by the renowned film director, writer, and illustrator Satyajit Ray.

References:

1. 'Satyajit Ray: The Inner Eye' By Andrew Robinson

2. বিষয় চলচ্চিত্র; a book by Satyajit Ray

3. সত্যজিতের সাক্ষাৎকার

Featured Image: Satyajit Ray Productions

Related Articles