Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রাঙ্গদা: চরম ইচ্ছের চমৎকার চিত্রায়ন

‘অসমাপ্ত দালানকেও কেন দালানই বলা হয়?’

‘কারণ, পৃথিবীতে কোনোকিছুই সম্পূর্ণ নয়। সবটাই প্রক্রিয়াধীন।’

এই দুটি সংলাপ যেন গোটা সিনেমার সারমর্ম। চিত্রাঙ্গদার যে ইচ্ছেটা পুরো সময় জুড়ে প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে, সে চাওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এক জোড়া সংলাপে। জীবন একটা বিশাল উপকথা। সেখানে কখন কে আসে, কে যায়; বলা মুশকিল। আবার অনেকে আসে। নিঃসঙ্গতায় সবচেয়ে কাছের হয়, এমনকি ছায়ার চেয়েও। বেলাশেষে তাদের খুঁজে পাওয়া দায়। আসলে মানুষ যা চায়, তা পাওয়া হয়ে গেলে বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যেত। ঋতুপর্ণ ঘোষচিত্রাঙ্গদা‘য় তুলে ধরেছেন তেমন কিছু তত্ত্ব, পুরো সময় চলেছে এর ব্যাখ্যার খোঁজ। কখনও মিলেছে, কখনও মেলেনি। শুরুর বাক্যের মতন, সবটাই প্রক্রিয়াধীন।

চিত্রাঙ্গদার পোস্টার; image source: hoichoi. tv

মহাভারতের কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদাকে বড়পর্দায় তুলে এনেছেন কালজয়ী নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঋতুর কাজ মানেই ভিন্নতা। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে দর্শককে গভীর ঘোরে নিমজ্জিত করার গুণ তার মাঝে বরাবর বিদ্যমান। চিত্রাঙ্গদাকে কখনও মনে হবে উচ্চমার্গীয় মঞ্চনাটক, তাতে পরিচালকের সার্থকতার চিত্র ফুটে উঠবে। ছবিতে মুখ্য চরিত্র রুদ্র (ঋতুপর্ণ ঘোষ) হলেও অলিখিত প্রধান চরিত্র চিত্রাঙ্গদা।

“চিত্রাঙ্গদা মণিপুরের রাজকন্যা। রাজার ইচ্ছে ছিল ছেলে হবে। তা না হওয়াতে মেয়েকে ছেলেদের মতো করে বড় করতে লাগেন তিনি। একদিন বনে সুদর্শন পুরুষ অর্জুনের প্রেমে পড়ে চিত্রাঙ্গদা। ধীরে ধীরে নিজের মেয়েলিপনা উন্মুক্ত করতে চায় করে সে।”

এর আদলে সিনেমায় আমরা দেখতে পাই রুদ্র একজন নৃত্য নির্দেশক, যিনি মঞ্চে নাচেন এবং নাচান। শরীর পুরুষের হলেও মন-মননে তিনি নারী। নিজের মধ্যে ভিন্ন সত্ত্বা ধারণ করেন। জীবনে গত হওয়া প্রেমিক এবং বর্তমান, দু’জনই পুরুষ। রুদ্রের ভাঙা হৃদয়ে ভালোবাসার জোয়ার নিয়ে আসে পার্থ (যিশু সেনগুপ্ত)। ওরা সংসার করার স্বপ্ন দেখতে লাগে। কিন্তু, চাইলেই কি আর সব হয়?

ঋতুপর্ণ-যিশুর রসায়ন ছিল প্রত্যাশার চেয়ে চমৎকার; image source: zeenews. com

ঋতুপর্ণ একবার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার কাজ করার প্রবল ইচ্ছের কথা। মহাভারতেও ছিল তার আগ্রহ। ঋতুর চলচ্চিত্রে চোখ বুলালে দেখা যাবে, গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কাজ উপহার দিয়েছেন ভক্তদের। তার একেকটি ছবি যেমন কলকাতার মানুষকে মুগ্ধ করেছে, বলিউডে অজয়-ঐশ্বর্যকে নিয়ে রেইনকোট তেমনি হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ তুলেছে। ঋতুপর্ণের প্রত্যেক ছবির অন্তরালে প্রবল বার্তা লুকিয়ে থাকে। সেসব বার্তার প্রতিপাদ্য সমাজ, সংস্কৃতি, মনুষ্যত্ব। চিত্রাঙ্গদায় কি তেমন কিছু আছে? তা জানতে হলে সিনেমায় মজতে হবে।

ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে ভারতের বিতর্কিত সমকামী সম্পর্কে তিনি বরাবর সমর্থন দিয়েছেন। নিজেও পুরুষত্বের চাইতে নারীমনা হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। মৃত্যুর আগ অবধি দ্বৈতসত্ত্বাকে পাশাপাশি রেখেই হেঁটেছেন। চিত্রাঙ্গদাকে তাই ঋতুর একপ্রকার আত্মজীবনী বলা চলে। একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তি, যিনি জন্মগত লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সন্তুষ্ট নন, হতে চান বিপরীত। সমাজে, পরিবারে তার অবস্থান কতখানি কঠিন ও সংকীর্ণ, তা যেন ঋতুর চেয়ে বেশি কেউ জানে না। এ কারণেই হয়তো নিজেই পর্দায় রূপান্তর করলেন চ্যালেঞ্জিং চরিত্রটি। আর চরিত্রের এতটাই গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছেন তিনি, ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা চরিত্র পার্থ’র ভূমিকায় যিশুকেও খানিক ম্লান লেগেছে।

পার্থ চরিত্রে সুন্দর অভিনয় উপহার দিয়েছেন যিশু সেনগুপ্ত; image source: metareel. com

এখানে আরেকজন চরিত্র আছে। যিনি পর্দায় নিজের উপস্থিতি বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করাতে পেরেছেন। মনোচিকিৎসকের ভূমিকা রূপান্তর করা অঞ্জন দত্ত সিনেমার অন্যতম মুখ্য চরিত্র। তাকে ঘিরে রচিত হয় একমাত্র ‘টুইস্ট’। পর্দায় যিশুর চেয়ে ঋতুকে বেশি সময় দিয়েছেন অঞ্জন। কী স্টাইল! কী সাবলীলতা! অঞ্জন দত্তের রূপায়িত অসংখ্য চরিত্রের মাঝে চিত্রাঙ্গদায় করা চরিত্রটি দাগ কাটবে। এতে এমনকি তার চরিত্রের কোনো নাম পর্যন্ত নেই। রাইমা সেন আছেন খুব অল্প সময়ের জন্য, তবে বেশ প্রভাব ফেলেছেন গল্পে। ঋতুর বাবার ভূমিকায় গুণী অভিনেতা দীপঙ্কর দে, মায়ের চরিত্রে অনুসুয়া মজুমদার ছিলেন বরাবরের মতোই চমৎকার। খাবার টেবিলে লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা পরিবারকে শোনাতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে একমাত্র ছেলের গাম্ভীর্যে ভরা কথোপকথন দর্শককে মনের গহীন কোণ থেকে তৃপ্তি দেবে।

সামাজিক ও পারিবারিক সীমাবদ্ধতা ফুটে উঠেছে খাবার টেবিলে; image source: screenshot/picsart edit 

একজন ‘পুরুষ’ যখন নারী হতে চায়, এটা কেবলই কিছু অস্ত্রোপচারের ব্যাপার নয়। এতে জড়িয়ে আছে গোটা একটা সমাজ ব্যবস্থা। যে বাবা-মা সারাজীবন তাকে ‘আমাদের ছেলে’ বলে আসত, তাদের বলতে হবে ‘আমাদের মেয়ে’। বাড়ির উইলেও বদলাতে হবে নাম। সম্পূর্ণ নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটবে। চেনা হয়েও যে ভীষণ অচেনা। 

“এ সমাজ না পারবে আমাকে মানতে, না পারবে ফেলে দিতে।”

দুর্দান্ত সংলাপটি মনে করিয়ে দেয় সমাজের দোটানাকে। নিজেকে পরিবর্তন করতে চাওয়া ব্যক্তির শরীর, নাকি তার সৃজনশীলতা- কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ; অলক্ষ্যে এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়। যা প্রভাব ফেলে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক জগতে। 

ঋতু-অঞ্জন যতবার একসঙ্গে ছিলেন ততবার অদ্ভুত ঘোরের সৃষ্টি করেছেন; image source: screenshot/picsart edit

চিত্রাঙ্গদার কারিগরি দিক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার আগে আসবে ঋতুপর্ণের পরিচালনা। নিজের সিনেমায় তিনি জীবনঘনিষ্ঠ সংলাপ রাখেন, হিউমার রাখেন, দুঃখ রাখেন, সমানভাবে রাখেন যৌনতাও। এখানেও এর ব্যত্যয় ঘটাননি। সাংসারিক কলহ দেখিয়েছেন, নিখাদ যৌন আবেদন দেখিয়েছেন। চিত্রাঙ্গদায় কয়েকটা পিরিয়ড দেখানো হয়েছে। থিয়েটার, প্রেম, হাসপাতালের দিনলিপি কিংবা পারিবারিক আবহ। কালচক্রের ঘূর্ণনে প্রতিটি পিরিয়ড একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িয়ে তৈরি করেছে মোহের আবেশ। পিরিয়ডিক ড্রামা হিসেবে তাই একে সফল বলা চলে।

ক্যামেরার পাশাপাশি লাইটিং সেটআপ ছিল চোখে পড়ার মতো। পড়ার ঘর, ডাইনিং, হাসপাতালের বেড, মঞ্চ; প্রতিটি জায়গায় কালার গ্রেডিং সৌন্দর্য বাড়িয়েই গেছে কেবল। সাধুবাদ জানাতে হয় সিনেমাটোগ্রাফার অভিক মুখোপাধ্যায় আর এডিটর অর্ঘ্যকমল মিত্রকে। শব্দ আর সঙ্গীত আর্ট ঘরানার ফিল্মগুলোকে পূর্ণতা দেয়। এগুলো অন্তরকে অনুধাবন করায়। রবীন্দ্রনাথের গল্পের ছায়া অবলম্বনে ঋতুপর্ণের নির্মাণে যে শব্দ আর সঙ্গীতের বড় আয়োজন থাকবে, তা না বললেও চলে। দেবজ্যোতি মিশ্র সেটি ভালোভাবেই জানতেন। তাই সঙ্গীতের দিকে কোনো খুঁত রাখেননি তিনি।

চিত্রাঙ্গদা একটি ইচ্ছের গল্প, হাহাকারের গল্প; image source: news18. com

২০১৩ সালে ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি বোর্ডের বিচারে সেরা চলচ্চিত্রের খেতাবজয়ী চিত্রাঙ্গদা একটি চরম ইচ্ছের গল্প। নিজের মনের কথা শুনে বাঁচতে চাওয়া আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। প্রতিকূল স্রোতে সাঁতরে প্রিয়জনকে আপন করে পাবার তীব্র হাহাকার। যে ইচ্ছের বীজ বপন করে, যে বাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, যে হাহাকারের দামামা বাজিয়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে আছে অসংখ্য প্রাণ। তাদের অব্যক্ত আর্তনাদ আমরা শুনি না। কেউ কেউ সাহস করেন শোনাবার, বাকিরা অন্তরালেই থেকে যান অনন্তকাল।

This article is in Bangla. It is a movie review of 'Chitrangada', directed by Rituparno Ghosh. 

Featured Image: Hungama

Related Articles