সময়টা ২০২০। রক্তিম চৌধুরী, খুব সাধারণ একজন মানুষ, পেশায় স্কুল শিক্ষক, খুব বেশি স্বচ্ছল সে নয়। কলকাতা শহরের খুব পুরাতন এক বাড়িতে থাকে। তার একটাই অসুবিধা, ক্যানিয়ান দাঁত দুটো তার বড়। অনেকটা ড্রাকুলার মতো। কয়েকবার তুলে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু কোনো অজানা কারণে শেষমেশ আর তোলা হয়নি। বাড়িওয়ালার ছেলেকে রোজ ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোও তার একধরনের কাজ, যদিও বিনে পয়সায় করে। ক্লাসরুমে বোর্ডে ছেলে-মেয়েরা লিখে রাখে 'ড্রাকুলা স্যার', সেইসাথে জুড়ে থাকে সহকর্মীদের কিছু তাচ্ছিল্যও। রক্তিমের অপরাধ- তার ওই উঁচু দুটো দাঁত। সে শুধু পালায়, শুধু এ জন্মে, নাকি জন্মান্তরে? ভেসে আসে অতীতের স্বর, "কোথায় যাবে তুমি? কোথায় পালাবে? কতদূর যাবে পালিয়ে?"
স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কমিটির এক সদস্যের অনুরোধ ও একইসাথে অনুগ্রহে, রক্তিম একদিন 'ড্রাকুলা' চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পায়। কিন্তু সে এক মস্ত ভুল করে বসে। কেন সে এটা করল, তা কেউ জানে না, বোধহয় রক্তিম নিজেও না। এই এক অভিনয় করতে যাওয়া বদলে দিল রক্তিমের জীবন। সেটা ভালো না মন্দ? কে জানে? সে হারাল চাকরি, আজ জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে তাকে।
সময়টা ১৯৭১-৭২। উত্তাল কলকাতা। নকশাল প্রতিষ্ঠার পক্ষে-বিপক্ষে কত মানুষ, জ্বালাও-পোড়াও চলছে শহরে। নকশালপন্থী অমল সোম আশ্রয় নিলেন চিলেকোঠার এক ঘরে, প্রাক্তন বিধবা প্রেমিকার বাড়িতে। মঞ্জরী বিশাল বাড়িতে একাই থাকে। ভেঙে পড়া অমলকে সে প্রতিদিন নতুন করে সাহস যোগাচ্ছে। সবার চোখ থেকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে অমলকে। এলাকার দুই বখাটে- কাতু আর নাটা পেছনে লেগেছে মঞ্জরীর। এরা সন্দেহ করছে, কেউ আছে সেই চিলেকোঠার ঘরে।
কখনও বিপ্লবী অমল, কখনও একটু ভীরু প্রকৃতির রক্তিম। রক্তিম কেউ দাঁত দেখে ফেলবার ভয়ে মুখে রুমাল চেপে কথা বলে, খুব শান্ত গলায় প্রশ্নের জবাব দেয়। অন্যদিকে অমল টর্চার সেলের কষ্ট কেমন হতে পারে, বুঝতে নিজের উপরে অত্যাচার করে। দু'জন দু’ মেরুর মানুষ। কিন্তু দুই মেরুর এই দুই মানুষ একটা জায়গাতে এক। কিন্তু কোথায়?
এদের কে যে কখন গল্পে এসেছে, তা বোঝা মুশকিল। তবে তাদের সবসময়ে পাশে ছিল মঞ্জরী। দিশেহারা অমল কিংবা রক্তিমকে সে-ই সাহায্য করেছে, পথ দেখিয়েছে।
"শোনো আমি আবার জন্ম নেব
হব সবার শেষে বাড়ি ফেরা
তোমার জাতিস্মর!"
কিন্তু রক্তিম আর অমলের মধ্যে সম্পর্ক কোথায়? কীভাবে চেনে তারা একে অপরকে? ৫০ বছরের পার্থক্য তাদের সময়ে, আর মঞ্জরীই বা কীভাবে সাহায্য করছে এদের? তবে কি 'টাইম ট্রাভেল' সত্য? বাস্তব-পরাবাস্তব সময় কি সত্য?
আচ্ছা বলুন তো, কলকাতায় শেষ কবে বরফ পড়েছিল? এটা জানা এ সিনেমার জন্য বেশ জরুরি, কেননা সিনেমা শেষে দর্শকের কাছে এর সাথে আরো একটা প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়-
"এই গল্পটা সত্যি না মিথ্যে,
অসুখ, নাকি গত জন্মের আখ্যান?"
মঞ্জরী হিসেবে মিমির অভিনয় দুর্দান্ত। মিমিকে বোধহয় এমন চরিত্রেই বেশি মানায়। কয়েক বছর আগে প্রলয় সিনেমায় তার এমন শান্ত অভিনয় দেখা হয়েছিল। আর এ সিনেমায় তার সংলাপ বলা, হেঁটে আসা কিংবা চাহনিতেই যেন অতিপ্রাকৃত ছোঁয়া লেগে ছিল।
কাঞ্চন মল্লিককে এরকম পরিপক্ব চরিত্রে দেখা যাবে, সেটা বোধকরি দর্শক ভাবেননি। যদিও তার পর্দায় উপস্থিতি খুব কম ছিল, তবু যেটুকু ছিলেন, তাতেই তার শক্তিশালী অভিনয় দেখা গেছে। এছাড়া, অন্যান্য চরিত্রাভিনেতারাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভালো করেছেন।
কাতু আর নাটা চরিত্র দুটো পুরো সময় জুড়েই মধ্যপ ছিল, আর নাহয় বেনারসী আতর নিয়ে। যদিও তা চরিত্রের প্রয়োজনেই , তবে এদের অভিনয়ে কিছুটা কমতি লেগেছে, রুদ্রনীলের কাছ থেকে আরো একটু ভালো আশা করেছিল সবাই বোধহয়।
এবার আসা যাক অনির্বাণের কথায়। ড্রাকুলা স্যার চরিত্রে, অমলের চরিত্রের অভিনেতা। আশেপাশের মানুষের উপহাস, ঠাট্টা মশকরা একটা মানুষকে যে কতটা ভেঙে দিতে পারে, তা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। কখনও বিপ্লবী, কখনও অসহায় এক তরুণ, এই রূপান্তর ফুটিয়ে তোলা অনেক কঠিন, তবু অনির্বাণ এতে উতরে গেছেন ভালোভাবে। অনির্বাণের দক্ষতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তার কন্ঠস্বর মুগ্ধ করে রেখেছে পর্দার পুরোটা সময়। কিছু কিছু দৃশ্যে মনে হয়েছে, ট্রানসাল্ভানিয়া থেকে ড্রাকুলা স্বয়ং উঠে এসেছে।
মোট আটভাগে ভাগ করা হয়েছে সিনেমাটি। মোটামুটি অতীত ও বর্তমান সমানভাবে জায়গা পেয়েছে, মিমি-অনির্বাণের উপস্থিতি ঠিকঠাক ছিল। সংলাপ, গান, কবিতার লাইন, রঙ- প্লটের সাথে মানানসই। মনে হবে, কোনো থ্রিলার বইয়ের চরিত্র চোখের সামনে ঘুরছে। পরিচালনার মুন্সিয়ানা স্পষ্ট। লেখক দেবালয় প্রায় ১০ বছর সময় নিয়েছেন এটি লিখতে।
তবে ড্রাকুলা স্যারের চরিত্র তুলনামূল স্বল্প উপস্থিতি পেয়েছে এখানে। স্যার, বা শিক্ষক হিসেবে খুব অল্পক্ষণ পর্দায় ছিলেন রক্তিম, যা সিনেমার রেটিংকে কিছুটা হলেও নামিয়েছে, নাহলে আইএমডিবি রেটিং হয়তো ৭.৩-এর বদলে ৮-এ পৌঁছে যেত।
This article is in Bangla. It is a review of the film 'Dracula Sir'.
Featured Image: www.indulgexpress.com/