উত্তাল সত্তরের দশকের শেষভাগে শুরু হয়েছিল নকশাল আন্দোলন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা সার্টিফিকেট পুড়িয়ে উজ্জল ভবিষ্যতর মায়া ত্যাগ করে যোগ দিয়েছিল এ আন্দোলনে। বিভিন্ন উপন্যাস এবং পত্রিকার অজস্র কলামে ঠাঁই পেয়েছে এই মেধাবী ছেলেগুলোর কথা। ঠিক একইভাবে উপেক্ষিত হয়েছে পাড়া, স্কুল ও কলেজের অখ্যাত স্বপ্নবাজ ছেলেদের কথা। যাদেরকে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা লুম্পেন বলে অবজ্ঞা করে থাকেন। প্রেসিডেন্সি আর যাদবপুরের পাশে এদের ঠাঁই দিতে বিব্রতবোধ করেন লেখকগণ।
সেই ফুটসোলজারদের ত্যাগ, আদর্শের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস, চরম পুলিশী নির্যাতনের মুখেও মুখ না খোলা, নিশ্চিত মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গনের মতো রোমহর্ষক ঘটনার সাবলীল বর্ণনা আছে সুপ্রিয় চৌধুরীর লেখা 'দ্রোহজ' উপন্যাসে! ইতিহাসের পাতায় স্থান না পাওয়া ছেলেগুলো বারুদের গন্ধে স্বপ্নজাল বোনার অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নির্ভয়ে। এ কথাটিই লেখক বলে গেছেন সুদীপ্ত নামের এক পঞ্চদশী কিশোরের চোখের ভাষায়।
সুদীপ্ত তখন কলকাতা শহরের শ্যামবাজরের একটি স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। তখনই দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী গ্রামে শুরু হয় সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। কানু স্যন্যাল, চারু মজুমদার, সরোজ দত্তের মতো ত্যাগি নেতারা সিপিআই (এম) ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন নকশাল বাড়ী আন্দোলনের সমর্থনে। গঠন করলেন নতুন দল সিপিআই (এম-এল)। আর মুখপত্র দেশব্রতীতে চারু মজুমদার ডাক দিলেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ও শ্রেণী শত্রু খতমের।
সুদীপ্তের স্কুল ছিল সম্পূর্ণ নকশালদের দখলে। স্কুলের পরিবেশে প্রভাবিত হয় সুদীপ্ত ও তার বন্ধুরা। তারা মিশে যায় আন্দোলনের সাথে। অবশ্য এতে সুদীপ্তের পরিবারেরও যথেষ্ঠ প্রভাব ছিল। ওর বাবা এবং বড়দা মৃন্ময় এই আন্দোলনে যুক্ত ছিল। সুদীপ্তের সবচেয়ে কাছের বন্ধু পুনে, পুরো নাম পূর্ণেন্দু দস্তিদার। ক্লাসের পেছনের সারির ছাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় তেমন ভালো নয়। গালাগাল আর মারামারিতে সিদ্ধহস্ত। এককথায় মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের ভাষায় লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের সকল বদ গুণের অধিকারী এই পুনেও আন্দোলনে যোগ দেয় কিছু না বুঝেই।
স্কুলের মিটিংয়ে প্রতীপদা'র অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুনে বলেছিল, শোনো গুরু, তোমাদের এই আগুনের গোলার মতো শক্ত শক্ত কথা আমি বুঝি না, আমি বিশ্বাস করি আমার বন্ধুরা যে লড়াইয়ের সাথে যুক্ত তা কখনোই খারাপ কাজ হতে পারে না। এখন তুমি আময় দলে নাও বা না নাও লড়াই আমি লড়বই। সেদিন মিটিংয়ে উপস্থিত সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিল পুনের কথা।
আর অন্যদিকে এক আগুনখোর তাত্ত্বিক নকশাল নেতা, কথায় কথায় তিনি তত্ত্ব কপচাতেন, সুদীপ্তদেরকে দুধের বাচ্চা বলে উপহাস করেছিলেন, তিনি পুলিশের এন্টি নকশাল স্কোয়াডের হাতে ধরা পড়লেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লাল বাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। তখন বাজারে গোপন খবর বেরিয়েছিল- পুলিশের নাকি ওই আগুনখোর তাত্ত্বিক নেতার জন্য একটি লাঠির বাড়িও খরচ করার প্রয়োজন পড়েনি! নিজে থেকে সব উগড়ে দিয়েছিলেন। ফলে শত শত গোপন শেল্টারে পুলিশ হানা দিলো। হাজারের ওপর কমরেড নিহত হলেন পুলিশের গুলিতে। অন্যদিকে সুদীপ্ত এবং তার বন্ধু পুনেকে (ওনার ভাষায় দুধের বাচ্চা) পুলিশ শত অত্যাচার করেও একটি নাম বলাতে পারেনি।
সুদীপ্তের আরেক বন্ধু নজরুল ভক্ত তন্ময়। স্কুলে কবিতা প্রতিযোগিতার প্রতিবারের চ্যাম্পিয়ন। তুখোড় মেধাবী জীবনে একটি পিঁপড়ে না মারা এই ছেলেও ঝাঁপ দিয়েছিল এই আগুনে। হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র, লড়াইয়ের ময়দানে আবৃত্তি করেছিল-
পারবি যেতে ভেদ ক’রে এই বক্র-পথের চক্রব্যুহ?
উঠবি কি তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ?
অনেক লড়াই-সংগ্রাম আর প্রাণের বিনিময়ে বিদায় নিয়েছিল সত্তরের দশক। এই উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঠক সেই সময়কালের ঘ্রাণ অনুভব করবেন খুব জীবন্তভাবে।
এটি সুপ্রিয় চৌধুরীর লেখা প্রথম উপন্যাস। প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে। খুব ঝরঝরে লেখনি, এবং নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা গতানুগতিক উপন্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার জন্য পাঠক মহলে প্রশংসিত হয়। পরবর্তীতে পাঠকদের আগ্রহে এবং উৎসাহে এটি পুস্তক আকারে প্রকাশ পায়। বছর দুই পরে লেখক 'কেতজেল পাখি' নামে দ্রোহজের দ্বিতীয় খণ্ড লিখেছেন।
পরবর্তীতে আপনাদের মতামত এবং আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে সামনে।
অনলাইনের মাধ্যমে বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ঘুরে আসুন নিচের লিঙ্ক থেকে:
১) দ্রোহজ
This article is a review of Drohoj by Supriyo Chowdhury
Featured Image: Bangla Live