Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দুচাকায় দুনিয়া: বাঙালির বিশ্বভ্রমণ

(প্রথম অংশের পর থেকে)

বিমল মুখার্জি খুবই কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। হাতে কোনো টাকা নেই, এদিকে ভ্রমণে মরুভূমিতে বালি ঠেলে এবং ভারি মাল বহন করার ফলে তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে লন্ডনে চেয়ারিং ক্রস হসপিটালে ভর্তি হন। তার দু’পায়েই অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর ছ’মাসেরও বেশি সময় লাগে তার সুস্থ হতে।

পুরোপুরি সুস্থ হবার পর আয়ারল্যান্ডগামী এক জাহাজে চাকরি নিয়ে তিনি পুনরায় বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। বেশ কিছুদিন তিনি আয়ারল্যান্ডে কাটান। তারপর পুনরায় লন্ডনে এসে কিছুদিন কাটিয়ে রওনা দেন স্কটল্যান্ডর দিকে। স্কটল্যান্ড থেকে তিনি মাছ ধরার ট্রলারে নাবিকের নাম লেখান তাতে করে আইসল্যান্ড যাবার উদ্দেশ্যে। সে জাহাজে তিনি ট্রলিং, রান্না করা, বয়লারে কয়লা ঢালা, মাছের তেল বের করা ইত্যাদি নানা কাজ করেছেন।

আইসল্যান্ডের উত্তরে ইসাফিওর্ড নামের এক ছোট বন্দরে পৌঁছানোর পর তিনি মার্গারেট ক্লার্ক (মাছ ধরার ট্রলার) থেকে বিদায় নিয়ে ইসাবেলা নামক এক স্প্যানিশ মালবাহী জাহাজে করে গ্রিনল্যান্ডে নামেন। গ্রিনল্যান্ডে লেয়া নামের এক এস্কিমোর ইগলুতে তিনি আতিথ্য গ্রহণ করেন। গ্রিনল্যান্ডের বরফের বাসিন্দা হয়ে অনেকদিন থাকার পর তিনি এক জাহাজে করে রাইকাভিক বন্দরে পৌঁছান। সে বন্দরে তিনি আবার মার্গারেট ক্লার্ককে পেয়ে পুরনো বন্ধুদের সাথী হয়ে ফিরতি স্কটল্যান্ড ও সেখান থেকে নরওয়েতে পৌঁছান। নরওয়ে থেকে সুইডেন হয়ে যান ফিনল্যান্ড। ফিনল্যান্ডে তার সাথে পরিচয় হয় আরেক জগদ্বিখ্যাত সুরকার ইয়ান সিবেলিউসের। ইয়ান সিবেলিউস সম্পর্কে বিমল মুখার্জি তার বইয়ে বর্ণনা করেন,

“ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কে বা প্রধানমন্ত্রীর নাম হয়তো অনেকে জানে না, তারা জানে কিংবা শুনেছে ইয়ান সিবেলিউসের কথা। মিউজিক জগতে তার স্থান ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠদের সমান পংক্তিতে, বিথোভেন, মোজার্টের মত সম্মান লাভ করেছেন বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে। ফিনল্যান্ডবাসীরা গর্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে বলে, আমাদের দেশীর একমাত্র রাজা ইয়ান সিবেলিউস। ফিনল্যান্ডের পরিচয় আর ইয়ানের পরিচয় একই কথা”

ইয়ান সিবেলিউস (১৮৬৫-১৯৫৭); Source: allmusic.com

ফিনল্যান্ড থেকে বিমল রাশিয়ায় প্রবেশ করেন। কমিউনিজমের ফলে রাশিয়ায় ঘটা প্রগতির প্রত্যক্ষ রূপ তিনি সেখানে দেখতে পান। রাশিয়া থেকে ইউক্রেনে গিয়ে পিরায়ুস নামক জাহাজে করে তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার জন্মস্থান খ্যাত গ্রিসে চলে যান।

গ্রিসে তিনি খুব বেশি সময় কাটাননি, অল্প কিছুদিন পরই সেখান থেকে আফ্রিকার পোর্ট সৈয়দগামী জাহাজে চেপে বসেন। পোর্ট সৈয়দ থেকে স্থলপথে পৌঁছান মিশরে। মিশর থেকে আফ্রিকার অল্প কয়েকটি দেশ ঘুরে হিংস্র বন্যজন্তুর প্রভাবে তিনি আফ্রিকা ছাড়তে বাধ্য হন।

১৯৩০ এর দশকে পোর্ট সৈয়দ; Source: commons.wikimedia.org

আফ্রিকা ছেড়ে তিনি এবার ভ্রমণ শুরু করেন সিসিলির দিকে। ইতালি থেকে জেনেভা, স্পেন হয়ে তিনি ফ্রান্সে যান। সেখানে অ্যালেক্স ইয়ার্ল নামক এক ভদ্রলোকের অনুরোধে তিনি পথে বেলজিয়াম হয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সভ্যতার উৎস ডেনমার্কে যান।

অ্যালেক্স ইয়ার্লের ডাকনাম ছিল আকসেল। তিনি ছিলেন সেখানকার এক সুবিখ্যাত চিত্রকর। ডেনমার্কে বিমল আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার সেখানে তাকে সুনিয়মে থাকার পরামর্শ প্রদান করেন। তাই তিনি বিশ্রামের উদ্দেশ্যে আকসেলের বাড়িতে থেকে যান ও সেখানে গো পালন করেন। দীর্ঘ এক বছর আকসেলের বাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে তিনি পৃথিবী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আবার বেরিয়ে পড়েন।

আকসেলের বাড়ি থেকে তিনি প্রথমে যান জার্মানিতে। জার্মানি থেকে হল্যান্ড হয়ে ফ্রান্সের ল্য হ্যাভর বন্দর থেকে নিউইয়র্কগামী জাহাজে উঠে বসেন। ছ’দিনের সফরের পর তাদের সামনে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দৃশ্যমান হয়। আমেরিকায় তিনি যে বাড়িতে উঠেছিলেন, সে বাড়ির ম্যানেজারের অনুরোধে তাঁর ভ্রমণকালীন একশো ছবির সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী হয়।

১৯৩০ এর দশকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি; Source: teepee12.com

নিউইয়র্কে এসে তিনি আবারও দেখা পান উদয় শঙ্করের। নিউইয়র্ক থেকে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে পৌঁছান মায়ামিতে ও সেখান থেকে কিউবায়। কিউবা থেকে তিনি আবার আমেরিকার পথ ধরেন। এবার গন্তব্য হলিউড। এভাবে আমেরিকার নানা অঞ্চল ঘুরে তিনি এবার ল্যাটিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে পথচলা শুরু করেন।

ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে এবার বিমল পৌঁছান জাপানে। জাপান থেকে তিনি জাহাজে করে চীনের টিনসিন বন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে জেমস নামক একজন তাকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যান পিকিংএ।

বিমল মুখার্জি চীনের চারুকলা দেখে দারুণ মুগ্ধ হন, তাঁর বর্ণনায় পাওয়া যায়,

“চীনারা চারুকলায় পৃথিবীর মাঝে শ্রেষ্ঠ জাতি। তার নিদর্শন চারদিকে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিত্তশালী লোকেদের বাড়ি ঠাসা চীনা কারুশিল্পের তৈরি অসংখ্য কাঠের, জেডের, অন্যান্য পাথরের কাজে যা, দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। বড় বড় চীনা মাটির কাজের সূক্ষ্ম কারুকার্য ও বর্ণবৈচিত্র সত্যিই আশ্চর্য”।

পিকিং থেকে সাংহাই, ন্যানকিং হয়ে হংকং ও সেখান থেকে ম্যাকাও হয়ে বিমল ইন্দোচিনে (বর্তমান ভিয়েতনাম, লাওস ও কাম্বোজ) প্রবেশ করেন। এ দীর্ঘ পথ জেমস তাকে সঙ্গ দেন। পরবর্তীতে মতের মিল না হওয়ায় তারা দুজনে নিজেদের পথ আলাদা করে নেন। পরে বিমল সেখান থেকে সাইকেল চালাতে চালাতে ‘উয়ে’ বা পুরাকালের রাজধানীতে প্রবেশ করেন।

ইন্দোচিনের বিভিন্ন শহর ঘোরা শেষ করে বিমল মুখার্জি থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেন। থাইল্যান্ড থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে প্রবেশ করেন সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে সুমাত্রা ও সেখান থেকে জাভায় (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া)। জাভা তখন ডাচ কর্তৃত্বাধীনে ছিল।

১৯৩০ এর দশকে জাভা (ইন্দোনেশিয়া); Source: oldindonesianvehicles.blogspot.com

জাভা থেকে তিনি শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করেন। শ্রীলঙ্কায় তাঁর দীর্ঘদিনের পথের সঙ্গী বন্দুক ও রিভলভারটি রেখে দেয়া হয়। সে দুটো তিনি পরে আর কখনোই ফিরে পাননি। শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ শেষ করে তিনি দীর্ঘ প্রায় বার বছর পর ভারতবর্ষের সীমানায় প্রবেশ করেন। বিশ্বভ্রমণ শেষ করে তাঁর ঘরে ফিরে আসা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় তাকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন করা হয়। অবশেষে দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরে তিনি বিয়ে করে তাঁর ভবঘুরে জীবনের অবসান ঘটান।

বিমল মুখার্জি তাঁর ভ্রমণ শেষ করার প্রায় পঞ্চাশ বছর তাঁর বিশ্বভ্রমণের কাহিনী নিয়ে ‘দুচাকায় দুনিয়া’ নামক বইটি লিখে প্রকাশ করেন। তিনি বইটির লেখকের কথায় তাঁর ভ্রমণ ও বই লেখা সম্পর্কে বলেছেন,

“দেশ দেখতে কার না সাধ হয়। তবে হাতে একটা পয়সা না নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণের শখ মেটানো সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। আমার একযুগের ওপর সময় লেগেছিল। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭। টাকা জোগাড় করেছি পথে- কখনও ফটোগ্রাফার, কখনও নাবিক, কখনও পাইলট, নানা বিষয়ে স্কুল কলেজে বক্তৃতা দিয়ে- কখনোবা মাছ ধারার ট্রলারে নানারকম কাজ করে, কখনও স্কুলে পড়িয়ে, ডেয়ারি ফার্মে গো পালন করে। শারীরিক পরিশ্রম করে কতভাবে অর্থোপার্জন করেছি ,তাঁর ইয়ত্তা নেই। মনে হয় এক জীবনেই অসংখ্যবার আমি জন্ম পরিগ্রহ করেছি।

সব কাজের মধ্যে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়াতে চেষ্টা করেছি। কত জাতের কত স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছি। তারা আমার মনের প্রসার বাড়িয়েছে এবং অনেক সংস্কারমুক্ত হতে সাহায্য করেছে। সার্থক হয়েছে আমার ভ্রমণ।

মা বই লিখতে আমায় খুব উৎসাহিত করেছিলেন। বারো বছর ধরে সপ্তাহে একটা করে চিঠি দিয়েছি। মা লিখেছিলেন ‘তোমার জীবনের সব ঘটনা আমার কাছে ধরা আছে। ভ্রমণ শেষ করে বই লিখতে হবে’। তাই এই বই। ভ্রমণ শেষ করার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে লেখা”

কেবলমাত্র অল্প কিছু টাকাকড়ি সঙ্গে করে করে বিমল মুখার্জি তাঁর পৃথিবীভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনি যে দেশেই গিয়েছেন সেখানকার অনেক কিছু লক্ষ্য করেছেন। তবুও তাঁর সে দেখার মাঝে গভীর দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়ে গেছে। তবে কোনোকিছুকে সম্বল করে না বেরিয়ে বারো বছর ধৈর্য ধরে তাঁর পৃথিবী ভ্রমণ করে আসার কাহিনী নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর।

তথ্যসূত্র: বই: দুচাকায় দুনিয়া; লেখক: বিমল মুখার্জি

ফিচার ইমেজ: bamboosplinter.blogspot.com

Related Articles