এনকান্টো: মাদ্রিগাল পরিবারের জাদুর গল্প

প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। এবুয়েলা এলমা আর তার স্বামী পেদ্রো, তিন সন্তান ব্রুনো, পেপা আর জুলিয়েটাকে নিয়ে বাস করত এক ছোট্ট গ্রামে। একদিন সেই গ্রামে কেউ আক্রমণ করে। সবাই প্রাণভয়ে নদী পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যায়। এদিকে পেদ্রো সেই সময় হারিয়ে যায়। এবুয়েলা যখন মোমবাতি হাতে বাচ্চাদের সাথে নদী তীরে পেদ্রোর জন্য অপেক্ষা করছিল, ঠিক সেই সময়ে কেউ একজন এসে এবুয়েলার হাতের মোমবাতিতে দিয়ে গেল জাদুর ছোঁয়া। সেই মোমবাতি হাতে নিয়েই এই পরিবারের সবাই একে একে পেয়ে গেল একেকরকম জাদু। কারো হাতের খাবারে সেরে যাবে সমস্ত অসুস্থতা, কেউ দূরদূরান্তের কথা শুনতে পারে, কেউ পালোয়ান, কেউ ফুল সৃষ্টি করে, আবার কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পারে। 

মিরাকেল নাই মিরাবেলের; Image source: Movie and Disney Animation

মাদ্রিগাল পরিবার বাস করে ক্যাসিটা নামের এক জাদুর প্রাসাদে। একদম মাথায় এক চিলেকোঠায় রাখা সেই অনির্বাণ জ্বলতে থাকা জাদুর মোম। এদিকে এই পরিবারের জুলিয়েটার ছোট মেয়ে মিরাবেল। কোনো এক অজানা কারণে মিরাবেলের কোনো জাদুকরী শক্তি নেই। এটা নিয়ে সবাই তাকে বেশ কথা শোনায়, বিশেষ করে নানী এবুয়েলা। 

এই পরিবারেরই সদস্য ব্রুনো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই পালিয়ে যাবার পেছনেও মিরাবেলের দায়। কিন্তু কেন? এদিকে পরিবারের পর পর দুটো আনন্দ অনুষ্ঠানের দিনে ঘটে দুর্ঘটনা। মাদ্রিগাল পরিবারের জাদুর প্রাসাদ ভেঙে পড়ে, সাথে পুড়ে যায় সেই জাদুর মোমবাতি। এই মোমবাতি নিভে গেলেই শহরে নেমে আসবে দুর্যোগ। মাদ্রিগাল পরিবার হারিয়ে ফেলবে তাদের জাদুর ক্ষমতা। 

মিরাবেলের কাজ মন ভালো করে দেবে; Image source: Movie and Disney Animation

এই বিপদে সাহায্য করতে পারত ব্রুনো। কিন্তু ব্রুনো কোথায় আজ? বেঁচে আছে কি? মিরাবেল, যার কোনো শক্তি নেই, সে কী করবে? কার সাহায্য নেবে? ইসাবেলের সাথে তার চিরশত্রুতা, অন্য বোনের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকলেও এই মুহূর্তে সে কোনো সাহায্য করতে পারছে না। এদিকে, পারলে মিরাবেলকে ঘর থেকে বের করে দেন নানি এবুয়েলা। সব কিছুর সমাধান হবে কি? কে বাঁচাবে? নদীতীরে ধীরে ধীরে ফিরে আসছে সেই শত্রুর দল। সবকিছু রক্ষা করতে দরকার সেই মোমবাতির জ্বলতে থাকার ক্ষমতা। কিন্তু আদৌ কি সম্ভব সেটা?

নিভে গেল শেষ আশার প্রদীপ; Image source: Movie and Disney Animation

ডিজনির অধিকাংশ মুভিতে দেখা যায়- প্রতিটি প্রধান নারীচরিত্র বেশ শক্তিশালী হয়। সুপার পাওয়ার থাকে, সব সমস্যার সমাধান করে ফেলে। এই মুভির চরিত্রটি কিছুটা আলাদা। সুপার পাওয়ার ছিল না মাদ্রিগাল পরিবারের মিরাবেলের। তবুও এই হাসিখুশি মেয়েটা পরিবার, প্রতিবেশি সবার মন কেড়ে নেয়। জাদুক্ষমতা না থাকলেও, সে সবখানে হাজির। টেবিলে খাবার দেয়া থেকে শুরু করে ভাইকে দরজায় পৌঁছে দেয়া, মায়ের কাছে আদর নেয়া। অতি সাধারণ এই মিরাবেলকে দেখে মনে হবে- আমাদের আশেপাশের সবচেয়ে হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়েটি। ট্র্যাডিশনাল অ্যানিমেশন মুভির বাইরে গিয়ে ডিজনি একটা দারুণ থিম আর গল্প নিয়ে ‘এনকান্টো’ মুভিটি তৈরি করেছে। মিরাবেলের সাথে ব্রেভ মুভির মেরিডার খানিকটা মিল পাওয়া যেতেও পারে। কোকড়া চুলের শ্যামবর্ণা এই মেয়ে প্রথমেই সবার নজর কেড়ে নেবে। 

প্রিয় ক্যাসিটা; Image source: Movie and Disney Animation

অ্যানিমেশন মুভি থেকে সিরিয়াস কিছু সাধারণত আশা করা হয় না। এই মুভিতে হাসির খোরাক কমই পাওয়া যাবে। তবে এটা কাঠখোট্টাও না। বাস্তবতার সাথে মিলিয়েই ছবির গল্প লিখেছেন বেশ ক’জনের একটি দল। যেমনটা আমাদের প্রায়শ শুনতে হয়- অমুক এই কাজ করে, তাহলে তুমি কেন পার না? গল্পের চরিত্র, কাহিনীবিন্যাস দেখে দর্শকদের মনে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো গল্প বলেই মনে হতে পারে। 

তুমি অকেজো, অকর্মণ্য, তুমি পরিবারের জন্য বোঝা— কেবলমাত্র এই কথার বুলি মানুষকে কীভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে এমন চিত্রায়ন পরিবেশন করতে পেরেছেন এর পেছনের কারিগররা। মিরাবেল আর তার মায়ের সাথে মুহূর্ত দারুণ ছিল। মা তাকে বার বার বুঝিয়েছেন, তুমি আর দশজনের মতোই অসাধারণ। তোমার যে শক্তি আছে সেটাই তোমার বিশেষত্ব। প্রিন্সেস মানেই তুমি একদম সব কাজে সেরা না, এই অনিন্দ্যসুন্দর বাস্তব বৈশিষ্ট্যও ফুটে উঠেছে ইসাবেলা চরিত্রে। 

আবার অন্যদিকে দেখানো হয়েছে- যেকোনো মানুষ যদি কিছু পারে, তার প্রতি প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আরো কিছু করার জন্য চাপ দিতে থাকে। এত বাস্তবতাপূর্ণ ছবি অনেকদিন পর দেখা গেছে। 

এবুয়েলা, যার হাত ধরে এসেছে মিরাকেল; Image source: Movie and Disney Animation

মুভির ইতিবাচক দিক হিসেবে ‘একতাই শক্তি’ থিম খুঁজে পাবেন দর্শক। আবার, যদি আপনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন যে আপনি কোনো কাজ করবেন, তাহলে কোনো না কোনোভাবে একটা পথ ঠিক পেয়েই যাবেন। আবার, যখন কেউ বিরোধিতা করবে, ঠিক কেউ না কেউ আপনাকে সাহায্য করবেই। আপনি জানেন না যে কে কখন আপনাকে সাহায্য করবার কল্পনা করছে। 

দুর্দান্ত এই অ্যানিমেশনের ভিজুয়াল ছিল বেশ চমৎকার। মুভির মূল তথ্য নিয়ে নানা মুনির নানা মত দেখা গিয়েছে। একজন শিশু বা কিশোর কেবল আনন্দের জন্যই দেখবে, আবার যারা একটু বুঝতে শিখেছেন তারা নিজেদের জীবনের সাথে মেলাতে পারবেন। কেউ বলেছেন, এই মুভিতে কোনো আলাদা কিছু নেই, বেশি সাধারণ গল্প, কোনো উত্তেজনা নেই, কোনো রহস্য নেই। আবার, কারো কাছে মুভির মিউজিক সবচেয়ে ভালো লেগেছে।

অ্যান্টোনিও, জাদুর প্রাসাদ ক্যাসিটা আর জুলিয়েটা- এই ক’জন মনে গেঁথে থাকবে মিরাবেলের সাথে। এবুয়েলা আর ইসাবেলাকে ঘিরে একটা দীর্ঘশ্বাস। কারণটা দর্শকের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি। এছাড়াও কিছু কিছু চরিত্রের প্রতি রাগ কিংবা অভিমান হতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত কার কার উপর টিকে থাকবে সেটা প্রতিটি মানুষের উপর নির্ভর করবে।

তবে, অনেকের কাছেই এই মুভির গান কিছুটা বিরক্তির উদ্রেক করে। মুভির স্ক্রিপ্টের তুলনায় গানের ব্যবহার বেশি। এই গানের জন্য অনেক পরিস্থিতি বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছে দর্শকদের, যা প্রতিফলিত হয়েছে কম রেটিং দেয়ার মধ্য দিয়ে। যদিও গানের মধ্য দিয়ে সবকিছু বার বার বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়টা বেশ প্রশান্তিদায়ক ছিল। এভাবে কোকো মুভিতেও মিউজিকের কাজ দাগ কেটেছিল দর্শকদের মনে।

রিভিউ যতই বাজে হোক না কেন, দর্শকদের কাছ থেকে কাজের কাজ সেরে নেয়া গিয়েছে মুভির বাজেটের দ্বিগুণ আয়ে। ২০২১-এর নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া এই মুভি বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ড শোতেও মনোনয়ন পেয়েছে, এর মধ্যে জিতেছে প্রায় ৫টি। 

রূপকথার মুভিগুলোতে রাজকন্যার পাশে কোনো না কোনো রাজকুমারের দেখা পাওয়া যায়। তবে রাজকুমারবিহীন ব্রেভ, এনকান্টোর মতো এই মুভিগুলো এক অন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কন্যারা কোনো পুত্রের চেয়ে কম কিছু না, সেটা বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। রূপকথা মানেই রাজকন্যা বন্দী দৈত্যের হাতে, আর রাজপুত্র ঘোড়ার পিঠে এসে উদ্ধার করবে- সেটা না। আজকের রাজকন্যা কিংবা সাধারণ কোনো মেয়ে নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারে, উদ্ধার করে ফেলতে পারে সব দেশ ও জাতিকে বিপদ থেকে। মাত্র ১০৩ মিনিটের এই দারুণ মুভির সাথে সময়টা বেশ ভালো কাটবে, এটা ধরে নিতেই পারেন।

Language: Bangla

Topic: This article is a movie review on animated movie Enchanto released in November, 2021. 

Image Source: Enchanto Movie Clippings.

Related Articles

Exit mobile version