Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর: এক কাল্ট-ক্লাসিকের আখ্যান

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে The 100 best films of the 21st century শিরোনামে এক আর্টিকেল প্রকাশ করে ব্রিটিশ দৈনিক সংবাদপত্র The Guardian। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে এর পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলো থেকে উঠে এসেছে বিভিন্ন কালজয়ী সিনেমা। বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির দেশ ভারতের বিভিন্ন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও নির্মাণ হয়েছে বহু চলচ্চিত্র। এক জরিপ অনুসারে, ভারতের বলিউড, টলিউড, কলিউড, মলিউড প্রভৃতি ইন্ডাস্ট্রি মিলিয়ে প্রতিবছর মুভি প্রডিউস হবার সংখ্যাটা ১৮০০ এরও অধিক। স্ট্রিমিং সার্ভিসের আধিপত্যের যুগে এই সংখ্যাটা হয়তো ছুঁয়ে যাবে ২০০০ এর ঘরকে। কারণ, প্রতিবছরই নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমের মতো জনপ্রিয় OTT প্লাটফর্ম অরিজিনাল ইন্ডিয়ান কন্টেন্ট রিলিজ দিয়ে থাকে।

২০০০ সাল থেকে শুরু করে এখন অবধি মুক্তি পাওয়া এমন অনেক ভারতীয় সিনেমার নাম উল্লেখ করা যাবে, যেগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। দর্শকদের ভোটে এদের কতক আবার জায়গা করে নিয়েছে IMDb-র Top 250 সিনেমার তালিকায়।

এতো শত কাল্ট-ক্লাসিক, মাস্টারপিস, বা ফ্যান-ফ্যাভারিট সিনেমার মধ্য হতে দ্য গার্ডিয়ানের একবিংশ শতাব্দীর টপ হান্ড্রেডের তালিকায় স্থান পেয়েছিল বলিউডের অন্যতম সেরা এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর। শুধু তাই নয়, জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করা এই একশত সিনেমার মাঝে একমাত্র ভারতীয় ফিল্ম হিসেবে আসন বাগিয়ে নেয়ার কৃতিত্ব শুধু এই সিনেমারই। কী এমন বিশেষত্ব ছিল এই সিনেমায়? যার কারণে বাকি সবাইকে রেখে শুধু তাকেই বেছে নেয়া হলো?

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর সিনেমার একটি পোস্টার; Image Source: IMP AWARDS

সবকিছুর সূচনা হয়েছিল ১৯৪১ সালে। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে সংঘটিত হওয়া সিনেমার ওপেনিং সিকুয়েন্সের মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠা আকাশ-বাতাস দর্শককে কিছুটা ভ্যাবাচেকা খাওয়াতে পারে। কিন্তু সেখান থেকে জাম্প দিয়েই ফিরে যাওয়া হয়েছে ফ্ল্যাশব্যাকে, ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে।

“মানুষ মূলত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। একদল হলো হারামি, আরেক দল হলো বেকুব। সকল কিছু ঘুরপাক খায় এই দুই শ্রেণিকে কেন্দ্র করেই। এ যেন শঠতা, প্রতারণা আর ছদ্মবেশের নোংরা এক খেলা। হারামি কখন বোকা বনে যায়, আর বেকুব কখন হারামির শিকারে পরিণত হয়, তা বুঝা বড্ড মুশকিল। আমাদের এই ওয়াসিপুরের কাহিনীটা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরপুর। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে মাথামোটাদের বস্তি। ভেতরে যান, মনে হবে কে কত বড় হারামজাদা, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। এটা এমন এক জঙ্গল, যেখানে সবাই নিজেকে জঙ্গলের রাজা হিসেবে কল্পনা করে। মুসলিমদের মধ্যকার এই সংঘর্ষপূর্ণ আখ্যান আজ-কালকার নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আর ওয়াসিপুরের এই লড়াই তো শিয়া-সুন্নির মধ্যেও নয়। এখানে সবাই ছিল সুন্নি। এ লড়াই ছিল কুরাইশি ও বাকি মুসলিমদের মধ্যে।”

এভাবেই ব্যাকগ্রাউন্ডে শুরু হয় নাসির আহমেদের (পীযুষ মিশ্র) সমান্তরাল বর্ণনা। কিছু ওল্ড শট এবং ন্যারেটিভে উঠে আসে ওয়াসিপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, এবং ওখানকার মানুষের স্বাভাবিক চালচলনের বিস্তারিত।

সিনেমায় দেখানো কয়লা খনির দৃশ্য; Image Source: Viacom18 Studios

অনুরাগ কাশ্যপ কালের যাত্রার ধ্বনি অনুরণিত করেছেন নাসির আহমেদের সাহায্যে। কয়লা খনিকে আবর্তন করে তিনটি দলের রেষারেষি চক্রাকার ঘূর্ণনে ঘুরতে থাকে। ঘটতে থাকে একের পর এক ধুরন্ধর ঘটনা। প্রথমত, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর খনির সিংহভাগ দখল করে নেয়া রামাধীর সিং। দ্বিতীয়ত, কুরাইশিরা, যারা ঐতিহ্যগতভাবে এবং বংশপরম্পরায় পুরো ওয়াসিপুরে রাজ করে আসছে। তৃতীয়ত, শহিদ খান, যাকে ট্রেন লুটের অপরাধে যাকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করে দেয়া হয়েছিল। কসাই হবার দরুন, ওয়াসিপুরে কুরাইশিরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পেয়েছিল। এলাকায় অন্যান্য গোত্র তাদের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ধনবাদ ছিল বাংলার একটি অংশ। ওয়াসিপুর তখন ধনবাদের পাশের একটি গ্রাম। ব্রিটিশরা চলে যাবার পর ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হলে, রাজনৈতিক কারণ হোক বা ভৌগোলিক, ধনবাদকে বাংলার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দিয়ে দেয়া হয় বিহারের বাহুডোরে। ভাগাভাগির এই তুমুল লড়াইয়ে, শেষমেশ ধনবাদ ঠাঁই পায় ঝাড়খণ্ডে। ওয়াসিপুরও তাই।

স্বাধীনতার পূর্বে ইংরেজরা ধনবাদের আশেপাশের সকল আবাদি জমিকে পরিণত করেছিল কয়লা খনন কার্যে। কারণ তখন রেলগাড়ি, কলকারখানা, বা মেশিন- সবকিছুর একমাত্র চালিকাশক্তি ছিল এই কয়লা। ইংরেজদের ট্রেন লুট করে নাকানি-চুবানি খাওয়ানো সুলতানা ডাকুর দুর্ধর্ষতার কাহিনী তখন আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াত। চিরচেনা ওয়াসিপুরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূচনা পর্ব উদ্বোধন করেছিল ওই সুলতানা ডাকু, যার সূত্র ধরেই এতসব এলাহি কারখানা।

সিনেমায় দেখানো ওয়াসিপুরের মানচিত্র; Image Source: Viacom18 Studios

প্রশংসার জোয়ারে ভাসানোর জন্য এই সিনেমায় অনেক উপাদান আছে, যার একেকটা জিনিস নিয়ে লিখে ফেলা যাবে স্বতন্ত্র রচনা। তবে গুণকীর্তন গাওয়া শুরু করলে প্রথমেই উঠে আসবে ছবির স্টোরি টেলিংয়ের ব্যাপারটা। তিনটি পরিবারের মধ্যে চলমান সংঘাত একসময় রূপ নেয় পুরো ওয়াসিপুরের অরাজকতায়। একদিকে যেমন তাদের সচিত্র বর্ণনা দিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তেমনি দেখানো হচ্ছে তাদের ব্যাকড্রপের কাহিনী, তাদের ফ্ল্যাশব্যাক বা আক্রোশ-প্রসূত ইতিহাস।

বলিউডের ইতিহাসে গ্যাংস্টার বা ক্রাইম থ্রিলার জঁনরায় গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর নিঃসন্দেহে এক ট্রেন্ডসেটার, যা হিন্দি ভাষায় রচিত সিনেমায় এই জনরার চিরাচরিত ধারণাকে পুরোপুরি পালটে দেয়। গতানুগতিকতার খোলস ভেঙে উপহার দেয় সম্পূর্ণ নয়া ধাঁচের কিছু। আজকাল গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের আদলে অনেক সিরিজ গড়ে উঠছে। উদাহরণ হিসেবে হালের জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ মির্জাপুর এর কথা বলা যায়।

মির্জাপুর সিরিজের ব্যাকড্রপ স্টোরিকে যতটা না গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দুটো ফ্যামিলি মধ্যে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে। এর ব্যাকড্রপ এতো বেশি সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়নি, বা নির্মাতাদের ইচ্ছা ছিল না সেরকম কিছু সিরিজে তুলে ধরার। কিন্তু অনুরাগ কাশ্যপ রূপালী পর্দায় যেভাবে কুরাইশি ও খান বংশের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ তুলে ধরেছেন, তেমনি বিশদভাবে সাজিয়েছেন এর পূর্বে ঘটে যাওয়া বাদপ্রতিবাদের কাহিনীসমূহকেও। কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে স্থান দিয়েছেন রাজনৈতিক অস্থিরতা, কার্যক্রম ও এর প্রাপ্ত ফলাফলকে। রাজনীতির সাথে ভৌগোলিক পরিবর্তন গুলোও উঠে এসেছে। সময়ের সাথে সাথে সবকিছুতে একটা আমূল পরিবর্তন আসছে। সেগুলোর বাস্তব শট দেখানো হচ্ছে পর্দায়, যেন দর্শকরা গল্পের গভীরে তলিয়ে যেতে পারে। আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলাকে বুনা হয়েছে ক্যামেরার ফ্রেমে।

একসময় কয়লা নিয়ে মাফিয়াগিরি চললেও, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানোর সাথে মাফিয়ারা বদলেছে তাদের ব্যবসার ধরন, কয়লা থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে লোহা চোরাকারবারিতে। কাশ্যপ সাহেব যে এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণার পরেই সিনেমা বানাতে নেমেছেন, তার ছাপ সিনেমাতে স্পষ্ট। প্রত্যেকটা জিনিসেই একটা বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় authenticity। এই কাহিনীর ফলে ওই হলো, এটার ফলে এটা ওইটা জন্ম নিয়েছে; অর্থাৎ প্রত্যেকটা কর্মকাণ্ডের পেছনেই একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ জুড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে পুরোটা সিনেমাতেই অথেনটিক ভাব ফুটে ওঠে।

কাহিনীর ধারাবাহিক বর্ণনা শুধু দুটি বা তিনটি পরিবারের উপর সীমাবদ্ধ না রেখে মাফিয়া-চক্রের সম্পূর্ণ গতিবিধি ও কার্যকলাপ পেঁয়াজের খোসার মতো একে একে ছাড়ানো হয়েছে, যথেষ্ট সময় নিয়ে। দুইটা জিনিস যখন একসাথে ওভারল্যাপ করা হচ্ছে, তখনই দর্শকরা জিনিসটা উপভোগ করতে পারছে। এটাই অনুরাগ কাশ্যপের টোটাল সিক্রেট, যিনি ডিটেল স্টোরি টেলিংয়ের মাধ্যমে দর্শকদের কাহিনীর সাথে এক নিরুপম সংযোগ ঘটাতে পেরেছেন।

এই সিনেমা নির্মাণে অনেক গুণী নির্মাতার অনুপ্রেরণা একাট্টা করেছেন পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। মৌলিক গল্প নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে অনুরাগ অনেক বেশি সংযমী, সুনিয়ন্ত্রিত, এবং নিখুঁত। সাধারণভাবে কথা-বার্তা চলে যাচ্ছে, খানিক বাত-বিতণ্ডা চলছে বা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের একপর্যায়ে ঠুস ঠুস গুলি। বয়ে যাওয়া খোশগল্প মূহুর্তেই পরিণত হয় বিমূর্ত নিস্তব্ধতায়। বাদামী মাটি আর্দ্র হয়ে উঠে তাজা রক্ত স্রোতে। সাথে থাকা সবাই মুখে পাথর দিলেও খুনি ফেটে পড়ে অট্টহাসিতে। এই নির্মাণ কৌশলের হরহামেশাই দেখা মিলে কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর ফিল্মে। যিনি পৃথিবীকে পাল্প ফিকশন (১৯৯৪), ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস (২০০৯), জ্যাঙ্গো আনচেইন্ড (২০১২), রেজারভয়ার ডগস (১৯৯২), কিল বিল ভলিউম এর মতো কালজয়ী সিনেমা উপহার দিয়েছেন। তিনি যেমন ভায়োলেন্সকে নিয়ে গেছেন একদম শিল্পের পর্যায়ে, ঠিক তেমনি কাশ্যপও গ্যাংস্টার জনরার সাথে ভায়োলেন্স জোড়া লাগিয়ে পূর্ব নির্ধারিত ছকের বাঁধাকে পেরিয়ে গেছেন। 

কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর বিখ্যাত কিছু ফিল্মের পোস্টার; Image Source: Wallpaper Flare

ওয়াসিপুরের সবার মধ্যেই রয়েছে করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে না থাকার দৃঢ় সংকল্প। আর সেই সংকল্পকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করে দেখতে দিয়েছেন অনুরাগ কাশ্যপ। পরিচালনার ধরনের প্রকট সাদৃশ্য পাওয়া যায় মার্টিন স্করসেজির ভায়োলেন্স পূর্ণ ফিল্ম মেকিং স্টাইলের সাথে। গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর সিনেমায় প্রচুর গ্রাফিক ভায়োলেন্স বিদ্যমান। বর্বরতার উন্মত্ত রূপ এতোটাই বাস্তব যে, মূহুর্তেই দর্শকদের টনক নড়িয়ে দিতে বাধ্য। সেখান পাওয়া যাবে ট্যাক্সি ড্রাইভার, ক্যাসিনো, কেপ ফেয়ার, র‍্যাগিং বুল বা গুডফেলাস ইত্যাইর মতো মুভির গ্রামীণ ভারতীয় সংস্করণের আবেশ।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর সিনেমার প্রশংসা করেছে খোদ স্করসেজিও। তিনি অনুরাগ কাশ্যপকে এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছেন, “আমি দেব. ডি এবং গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর অনেক উপভোগ করেছি। চলচ্চিত্রগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নেয়ার মতো অনেক উপাদান আছে।”

মার্টিন স্কোরসেজির সাথে অনুরাগ কাশ্যপ; Image Source: Filmi Beat

আমেরিকান ফিল্ম ডিরেক্টর স্যাম পেকিনপাহ্’র সিনেমার সাথেও এই সিনেমার মিল রয়েছে। ক্রাইম বা ভায়োলেন্সের সময় অনেক লং মন্টেজ শটের দেখা মিলে গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর মুভিতে। যেমন- দিল চি চা লেদার গানের লং সিকুয়েন্সটাতে পেকিনপাহ্ থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়েছেন অনুরাগ কাশ্যপ।

অনেকে প্রায় সময় গডফাদার ট্রিলজির সাথে অনুরাগ কাশ্যপের গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের তুলনা করে থাকেন। কিন্তু অনুরাগের ভাষায়, তিনি এই সিনেমার অনুপ্রেরণা নিয়েছেন তামিল ফিল্ম সুব্রামানিয়াপুরাম (২০০৮) থেকে। সুব্রামানিয়াপুরাম আর গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের স্ক্রিনপ্লে ফরমেটের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য বিরাজমান।

ফ্যান্সি স্যুট পরিহিত, ফ্ল্যাশি ওয়েপন হাতে নিয়ে স্বভাবে রাশভারি একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপলার গডফাদার থেকে মার্টিন স্কোরসিজের গুডফেলাস; প্রত্যেকটা গ্যাংস্টার সিনেমাই মস্তিষ্ক কোণে গ্যাংস্টারের এ রকম একটা নির্দিষ্ট অবয়ব গঠন করে দিয়েছিল। নব্বই দশকের বোম্বে ভিত্তিক গ্যাংস্টার ফিল্ম থেকে শুরু করে প্রি-গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর পর্যায় পর্যন্ত এরকম ধারা অব্যাহত ছিল। চিরপ্রচলিত এই ধারাকে নতুন পথ দেখালেন অনুরাগ কাশ্যপ। স্যুট-পরিহিত কেতাদুরস্ত গ্যাংস্টারের বদলে লুঙ্গি-গামছা-মাফলার ওয়ালা গ্যাংস্টার! মোটামুটি বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বলা যায়। ফিল্মের শুরুতেই ব্যাকস্টেজ ন্যারেশনে বলা করা হয়েছিল,

“মানুষ মূলত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। একদল হলো হারামি, আরেক দল হলো বেকুব। সকল কিছু
ঘুরপাক খায় এই দুই শ্রেণিকে কেন্দ্র করেই।”

প্রথম পার্টের প্রাণবন্ত চরিত্র সরদার খান সে গোঁয়ার গোবিন্দ চরিত্রের প্রতিফলন। ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো ক্রোধে সবসময় জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়াটা যেন তার জন্মগত স্বভাব। সে যতটা না ‘কুল অ্যান্ড কালেক্টেড ক্রিমিনাল’, তার চেয়ে বেশি আচরণ করে প্রেশার কুকারের ন্যায়, যার মেজাজ হুট-হাট গরম হয়ে যাওয়াটা যেন স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। নিজেকে সে অনেক বড় হিরো ভাবলেও, পর্দায় সে দর্শকদের অফুরন্ত হাস্যরসের খোরাক। সে হলো গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের সকল স্ল্যাপস্টিক কমেডির যোগানদাতা।

ওয়াসিপুর কাঁপানো এই গ্যাংস্টার পতিতালয়ে নিজ বউ নাগমার কাছে মার খাচ্ছে, গালাগাল ও ঢিল খেয়ে ঘর থেকে ভয়ে বের হয়ে যাচ্ছে, কখনো বা দুর্গার সাথে গিয়ে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে কাপড় কাচার অভিনয় করছে। আবার সে একই সরদার খান পিতার হত্যার প্রতিশোধের বীজকে মনে পুঁতে রেখে ধীরে ধীরে বিরাট বৃক্ষে পরিণত করছে। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দেখানো শুধু কাশ্যপের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

বাম থেকে নাসির আহমেদ, সরদার খান ও আজগর খান; Image Source: Viacom18 Studios

গাম্ভীর্যের খোলস ধরে থাকা রামাধীর সিং যেন ব্রেকিং ব্যাডের ঠাণ্ডা মাথার খেলোয়াড় গাস ফ্রিংয়েরই প্রতিফলন। রামাধীর ভালো করেই জানে, বেকুব দিয়ে পৃথিবী ভরপুর। তাই বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই হতে হবে হারামি। নীরবতায় আচ্ছন্ন থাকা রামাধীরকে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, তার মনের মধ্যে কী ভয়ংকর কুচক্রী পরিকল্পনা ছক কষে চলেছে। সে সবসময়ই চেয়েছে আড়ালে থেকে ক্ষমতার সুতো নাড়াতে। পরিপাটি গোছের এই ব্যক্তির নেই কোনো স্টাইল, নেই আলাদা সোয়াগ, সে শুধু কার্যতৎপরতায় পাশবিক, বর্বর, এবং পশু-প্রবৃত্তির। যার সুবিধা বিকিয়ে সে ওয়াসিপুরের মতো জাহান্নামে তিন প্রজন্ম পর্যন্ত নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে।

রামাধীর সিং ও তার ছেলে জে. পি. সিং; Image Source: Viacom18 Studios

সিনেমার প্রতিটা নারী চরিত্রই নিজ জায়গা থেকে স্বাধীন, শক্তিশালী এবং স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্যের। নাগমা খাতুন যেমন নিজ সন্তানদের বড় করে তুলছে সরদার খানের মৃত্যুর বদলা নেয়ার জন্য, তেমনি দুর্গা তার সন্তান ডেফিনিটকে বড় করে তোলে সরদার খানের প্রতি ঘৃণা পোষণ করিয়ে। একই সূত্রে মোহসিনাও তার ছেলেদের বড় করে তুলবে ফয়জাল খানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া জন্য।
সাম্রাজ্যবাদ, রাজনীতি এবং মাফিয়া জগতের বাস্তবতাকে খুব কাছে থেকে অনুভব করার অপর নাম গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর। লুঙ্গি, গামছা, বহুবিবাহ, যৌনতা, কামনা; গ্রাম্য সমাজের সকল বুনিয়াদি উপাদানের রসদ বরাদ্দ আছে এই মুভিতে।

নাগমা খাতুন; Image Source: Viacom18 Studios

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের মাধ্যমে অনুরাগ কাশ্যপ বলিউডের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। রামাধীরকে মাইকের মাধ্যমে ধমকি দেয়ার সময় দেখা যায় এক ডিস্কো-ড্যান্সারকে, যা সে সময়ে মিঠুন চক্রবর্তীর আমলকে তুলে ধরেছে। ফয়জাল খানের বেশভূষায় নব্বই দশকের নায়কদের স্পষ্ট ছাপ বিরাজমান। কারান-অর্জুন, দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গি সহ সে সময় চলা সকল হিট সিনেমার রেফারেন্স মুভিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

সিনেমার চরিত্র পারপেন্ডিকুলার-এর আমলে সঞ্জয় দত্ত তখন বেশ জনপ্রিয়, ভক্তদের মাঝেও তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস, আবেগ, চিত্তচাঞ্চল্যের কোনো কমতি নেই। উঠতি বয়সের ছেলেরা সেলুনে সেলুনে গিয়ে দিতে থাকে সঞ্জয় দত্তের চুলের ছাট, ঘরের দেয়াল ভরে উঠে সেঁটে থাকা সঞ্জয় দত্তের ছবিতে। চালচলনে উদ্ধত ভাব নিয়ে রঙিন চশমার আড়ালে বিচিত্র ভুবনে ডুবে থাকা সকলেই তখন নিজেকে ভাবত অমিতাভ বচ্চন, সালমান খান কিংবা সঞ্জয় দত্ত। হালফ্যাশনের কেতাদুরস্ত পোশাকে হিরোগিরির এই চোরাস্রোতে গা ভাসিয়েই প্রাণ হারিয়েছে ওয়াসিপুরের অনেক লোক।

শুরু থেকেই সিনেমা কীভাবে ভারতকে প্রভাবিত করে আসছে, তার জীবন্ত ছাপ পাওয়া যায় এই সিনেমায়। এখানে যতটা না প্রতিশোধের প্রতিহিংসা উঠে এসেছে, তার চেয়ে বেশি উঠে এসেছে প্রত্যেকের হিরো হয়ে উঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সেজন্য সিনেমার পরতে পরতে হয়তো গ্যাংস্টার ভাইব চাইবে দর্শক, কিন্তু সেই সাথে উঠে আসবে নিপট জীবনের ধোঁয়াশার মোড়া রূঢ় বাস্তবতা। এর উপস্থাপনা সংক্ষিপ্ত নয়, তবে তা সরস ও শ্রুতিমধুর।

নিজেকে নায়ক ভাবা ফয়জাল খান; Image Source: Viacom18 Studios

সেলুলয়েডের ফিতায় ওয়াসিপুরের এই অব্যক্ত কাহিনী উঠে আসার মূলনায়ক জিশান কাদরি। তিনি এই ওয়াসিপুর উপাখ্যানের বিশ্বস্ত রূপকার। গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের দ্বিতীয় পর্বে ডেফিনিট চরিত্রে নিজের জাত চিনিয়েছেন, দেখিয়েছেন প্রতিভার পরিপূর্ণ ঝলক। হিরো হবার স্বপ্ন বুকে চেপে ওয়াসিপুর ছেড়ে মুম্বাই পাড়ি জমিয়েছিলেন জিশান কাদরি। ইট-পাথরের শহরে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারলেন রূঢ় বাস্তবতার তিক্ত স্বাদ, বুঝলেন নায়ক হওয়াটা এত সোজা নয়।

তখন তিনি প্রচুর সিনেমা দেখা শুরু করলেন। বুঝতে চাইলেন সিনেমার নিগুঢ় তত্ত্ব, বুঝার চেষ্টা করলেন সিনেমা তৈরির কলাকৌশল, এবং তা তৈরিতে কী কী রসদ প্রয়োজন। গ্রহের ফেরে হঠাৎ তিনি একদিন দেখে ফেললেন ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া ব্রাজিলিয়ান সিনেমা ‘সিটি অভ গড’। তখন তিনি মনে মনে ভাবলেন, সিনেমায় দেখানো এমন বদমায়েশি তো আমাদের ওয়াসিপুরে বারোমাসই ঘটতে থাকে। সিটি অভ গডের অনুপ্রেরণাকে পুঁজি করেই নিজ এলাকা ওয়াসিপুরকে নিয়ে লিখতে বসলেন কাহিনী। ভাবলেন, কাহিনী তো চটকদার, যদি কারো নজরে আটকে যায়!

শুরুতেই তিনি দরজায় কড়া নাড়লেন পরিচালক হানসাল মেহতার। গল্প খুবই পছন্দ করলেন হানসাল মেহতা। বুকে ভরসা পেলেন জিশান, বুঝলেন এই কাহিনীতে নিশ্চয়ই দম আছে। কিন্তু হানসাল মেহতা কিছুদিন পর জানালেন, এই ফিল্মের জন্য প্রডিউসার মিলছে না, সে যাতে অন্য কারও দ্বারস্থ হয়।

ব্ল্যাক ফ্রাইডে  (২০০৪) সিনেমার বদৌলতে অনুরাগ কাশ্যপ সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন জিশান। তিনি চিন্তা করলেন, এই ছবি নির্মাণে নিজের সেরাটা ঢেলে দিতে পারবেন শিল্প-বোধসম্পন্ন দূরদর্শী অনুরাগ কাশ্যপ। অনুরাগ কাশ্যপও বিহারকে নিয়ে ‘বিহার’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন কারণে সে প্রজেক্ট আর সফলতার মুখ দেখেনি।

অনুরাগের অফিসে গেলেন জিশান, উনার দেখা মিলল না। দুই-তিনদিন পর আবার এলেন, এবারেও আগের মতো লাপাত্তা অনুরাগ কাশ্যপ। শেষমেশ পৃথ্বী থিয়েটারে গিয়ে দেখা মিলল অনুরাগ সাহেবের। অনুরাগের নজর কাড়তে সক্ষম হলেন জিশান। তখন অনুরাগ কাশ্যপ জিশানকে বললেন,

– কী উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছ এখানে?

– স্যার, ঝাড়খণ্ডের নাম তো শুনেছেন।

– হ্যাঁ, শুনেছি তো।

– ঝাড়খণ্ডে ওয়াসিপুর নামক একটা জায়গায় আছে, যেখানে প্রতিনিয়ত চলে খুন-খারাবি। তিন প্রজন্মের রোমাঞ্চকর এবং লোমহর্ষক একটি কাহিনীও গড়ে উঠেছে এই সহিংসতা ও রেষারেষিকে কেন্দ্র করে।

– এক কাজ করো, এই কাহিনীর সারাংশ লিখে নিয়ে আসো। পড়ে ভালো লাগলে মতামত জানাব।

– ঠিক আছে, স্যার।

অনুরাগ কাশ্যাপের সাথে জিশান কাদরি; Image Source: DAWN

যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন জিশান। বসলেন একতাড়া কাগজ নিয়ে। আবেগাপ্লুত হয়ে চল্লিশ পেজের এক স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললেন। যথারীতি স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হলেন অনুরাগের অফিসে। অফিস সহকারী তাকে জানালেন, “চল্লিশ পেজ পড়ার মতো সময় কি অনুরাগ কাশ্যপের আছে? আপনি এটাকে সাত-আট পৃষ্ঠায় নামিয়ে আনুন।” কী আর করা?

জায়গায় বসে কাগজে-কলমে খসখস শব্দে আট পৃষ্ঠায় গল্প আটালেন জিশান। তখনো তিনি জানতেন না আট পৃষ্ঠার এই কাটাছেঁড়া খসড়া পালটে দিতে যাচ্ছে তার জীবন, বলিউডে তৈরি করতে যাচ্ছে প্রথা ভাঙার নয়া এক ইতিহাস। অনুরাগের কাছে সেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে যাবার পর একটানা পুরোটা পড়লেন তিনি। সাফ জানিয়ে দিলেন, 

“এই ফিল্ম আমি বানাতে যাচ্ছি। এই নাও আমার ফোন নাম্বার, সময় নিয়ে আমার অফিসে এসে পোড়ো। বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হবে।”

জিশানের চোখে-মুখে তখন আত্মতুষ্টির স্পষ্ট ছাপ। অধরা স্বপ্ন তাহলে পূরণ হতে চলেছে। ফিল্ম ডেভেলপমেন্টের পূর্বে অনুরাগের নির্দেশেই ওয়াসিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন জিশান কাদরি। টানা ৩৫ দিন সেখানে থেকে সকল বিষয় সম্বন্ধে খুঁটিনাটি বর্ণনা তুলে নিলেন সাদা কাগজে। ওয়াসিপুরের রোমাঞ্চকর কাহিনী দিয়ে শ্বেত কাগজ ভরে উঠতে লাগলো কালো অক্ষরের মাধ্যমে।

মুম্বাই এসে জিশান নতুন স্ক্রিপ্ট দেখালেন অনুরাগ কাশ্যপকে। বিস্ময়ের ভঙ্গিতে অনুরাগ বললেন,

– এটা দিয়ে তো একটা ফিল্ম বানাতে পারব না।

– মানে? কেন বানাতে পারবেন না?

– এখানে তো তিনটে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লিখে নিয়ে এসেছ তুমি।

– স্যার, স্পষ্ট করে বলে দিলে ভালো হয়, ফিল্ম বানাবেন নাকি বানাবেন না!

– আরে ভাই, ফিল্ম তো বানাবো অবশ্যই। তবে দুই পার্টে।

আহ্লাদে আটখানা জিশানের উপর ব্যাপারটা অনাকাঙ্ক্ষিত আশীর্বাদ রূপেই বর্ষিত হলো। আপন মনে বিড়বিড় করে বললেন, “কপাল কী শালার, বানাতে এসেছিলাম একটা, পেয়ে যাচ্ছি দুইটা।”

সেই থেকে স্টোরি ডেভেলপমেন্টের পুরো অংশটাই সামলেছেন জিশান কাদরি। সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন অখিলেশ জাইসওয়াল এবং অনুরাগ কাশ্যপ নিজে। স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্টের সময় ফোনে বেশ কয়েকবার হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছিল অনুরাগ কাশ্যপকে। সব বাঁধা অতিক্রম করে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো তিনি ছুটে চলেছেন আপন গতিতে।

রগচটা সুলতান কুইরাইশি; Image Source: Viacom18 Studios

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক অংশটি গড়ে উঠেছে সিনেমার কুশীলবদের নিয়ে। অসাধারণ নির্মাণশৈলীর যোগ্য পরিপূরক অনুরাগ কাশ্যপ বলতে গেলে গভীর সমুদ্র সেঁচে মুক্তো বের করে এনেছেন। ঘটিয়েছেন প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন। এই ছায়াছবিকে বলিউডের সবচেয়ে বড় এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট বলার কারণ হচ্ছে, নবাগত এবং অপরিচিত সকল মুখকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন অনুরাগ। বর্তমানের পঙ্কজ ত্রিপাঠি, রিচা ছড্ডা, মনোজ বাজপেয়ী, হুমা কুরাইশি বা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী; কেউ আজকের মতো খ্যাতির চূড়ায় আসীন ছিলেন না। নতুন স্ক্রিপ্ট-রাইটার, নতুন কুশীলবদের নিয়ে সাজিয়ে ফেলেন ওয়াসিপুরের বেদনা-বিরহের ক্ষুদ্র উপন্যাস।

প্রথমদিকে প্রযোজক চেয়েছিলেন রামাধীর সিং চরিত্রে অজয় দেবগণকে কাস্ট করবেন। কিন্তু বাঁধ সাধলেন অনুরাগ কাশ্যপ। তার ইচ্ছা ছিল সিনেমাতে বড় মাপের কোনো অভিনেতা কাস্ট করাবেন না। সেজন্য তিনি তিগমানশু ঢুলিয়াকে রামাধীর চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করে ফেলেন। আর অভিনয়ের কথা বললে, পাথরে ফুল ফুটিয়েছেন কাশ্যপ সাহেব। সহজাত অভিনয় দিয়ে সকলে অনায়াসেই নিজ নিজ চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন।

পারপেন্ডিকুলার; Image Source: Viacom18 Studios

ভালো-মন্দের বিচারে মাপা ছোট ছোট চরিত্রগুলোর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতিও দর্শকের নজর এড়ায়নি তাদের অভিনয়ের নৈপুণ্যে। কারণ পরিচালক তিগমানশু বা আনাড়ি জিশান কাদরি এই গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের মাধ্যমেই অভিনয়ে অভিষিক্ত হন। কিন্তু এক মূহুর্তও বোঝার জো নেই, এটা তাদের অভিনীত প্রথম সিনেমা। মনোজ বাজপেয়ী, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, নওয়াজউদ্দিনদের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় রথকে টেনে নিয়ে গেছেন রীমা সেন, রিচা ছড্ডা, পীযুষ মিত্র, ভিনিত কুমার সিং, জামিল খান, হুমা কুরাইশিরা। যে সিনেমায় সকলের অভিনয় প্রাঞ্জল ও স্বাভাবিক থাকে, সে সিনেমা দর্শক আকর্ষণ অর্জন না করে যাবে কোথায়?

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর যে শুধু নবাগতদের বলিউডে এনেছে তাই নয়, বরঞ্চ জন্ম দিয়েছে গোটাকতক ক্ষণজন্মা অভিনেতা। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা হালের নওয়াজউদ্দিন, পঙ্কজ ত্রিপাঠি, জয়দীপ আহলাওয়াত, রাজকুমার রাও, ভিনিত কুমার, হুমা কুরাইশিরা সবার সামনে ভালো করে দৃষ্টিগোচর হয়েছেন এই গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের মাধ্যমেই। বলিউড ইন্ডাস্ট্রি পেয়েছে গোটাকতক উজ্জ্বল প্রদীপ, যারা বলিপাড়ায় তাদের লণ্ঠনের দীপ্তিময় আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর সিনেমার কুশীলবগণ; Image Source: NDTV

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর পরবর্তী সময়ে ভারতে যেসকল গ্যাংস্টার বা ক্রাইম থ্রিলার সিরিজ এসেছে তাদের সবকটাতেই গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর কাস্টের ছড়াছড়ি। লক্ষ্য করে দেখুন, ‘পাতাল লোক’ এবং বার্ড অভ ব্লাড সিরিজে জয়দীপ আহলাওয়াত, সেক্রেড গেমস সিরিজে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, মির্জাপুর সিরিজে পঙ্কজ ত্রিপাঠী, প্রমোদ পাঠক, দ্য ফ্যামিলি ম্যান সিরিজে মনোজ বাজপেয়ী, ভিপিন শর্মা; সবাই কিন্তু গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরেরই চরিত্র। সোজা ভাষায়, যে নওয়াজউদ্দিন, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, বা রাজকুমার রাও এতদিন ছোটখাটো সাইড রোলে অভিনয়ে করে আসছিলেন, এই গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাদের ভাগ্য-রথের চাকা। এক ফয়জাল খানের চরিত্র নওয়াজকে রাতারাতি বানিয়ে দিলো সুপারস্টার।

নেপোটিজমকে একপাশে রেখে অনুরাগ কাশ্যপ সবসময়ই মেধা ও প্রতিভাকে জোর মূল্যায়ন করে এসেছেন। ফিল্মের জন্য অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই ছিলেন খুঁতখুঁতে স্বভাবের। সেজন্যই হয়ত আজগর খান চরিত্রের জন্য অডিশন দিতে হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার মানুষকে। শেষমেশ তিনি সবুজ বাতি দিলেন জামিল খানকে। ছাড় দেননি স্বয়ং জিশান কাদরিকেও। ডেফিনিট রোলের জন্য অনুরাগ কাশ্যপের নির্দেশে জিশানকে শরীর থেকে প্রায় দশ কেজি ওজন ঝরাতে হয়েছিল।

বন্দুক ও বোমা হাতে গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের গ্যাংস্টারগণ; Image Source: Viacom18 Studios

সিনেমার গানগুলো একদমই ব্যতিক্রম ধাঁচের। অন্যান্য সিনেমার গান বানানো হয় চার্টবাস্ট হবার লক্ষ্য নিয়ে, সিনেমার প্রমোশনের বা এভারগ্রিন হিসেবে লোকমুখে যুগ যুগ বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের গানগুলো রচনা করা হয়েছে শুধু এই সিনেমার জন্যই। গানগুলো সিনেমার প্রতি বিশেষ ভাবাবেগ সৃষ্টিতে অনুকূল আবহ তৈরি করে দেয়। না এই সিনেমার গান কোনো পার্টিতে বেজেছে, না ঝুলিতে পুরে নিয়েছে ইউটিউবের ২০০-৩০০ মিলিয়ন ভিউ। তবুও এই সিনেমার গানগুলো অনন্য, অনুপম ও অপ্রতিম। কারণটাও সোজা। গানের মূল আকর্ষণ এর লিরিক এবং বৈচিত্র্যময় ভাবভঙ্গি।

পীযুষ মিত্রকে সাথে নিয়ে সুর ঘর সামলেছেন মিউজিক ডিরেক্টর স্নেহা খানওয়াকার। সিনেমা তৈরির এক বছর আগেই অনন্ত ছন্দে সুর বাধতে নেমে যান তিনি। ঘুরেছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, হরেক রকমের সঙ্গীত অভিজ্ঞতা ঢুকিয়েছেন মস্তিষ্কে। দুই পার্ট মিলিয়ে মোট গানের সংখ্যা ২৭টি, যার স্থিতিকাল ৫৬ মিনিট ১২ সেকেন্ড।

গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর সিনেমায় সুর মিলিয়েছেন অমিত ত্রিবেদী, পীযূষ মিশ্রের মতো প্রতিভাবান শিল্পীরা। বাদ যায়নি ট্রেনে গায় গেয়ে ভিক্ষা পেট চালানো ১১ বছর বয়সী দুর্গা কিংবা পাটনার গৃহবধূ রেখা ঝাঁ-এর মতো অচেনা-অজানা শিল্পীরাও। বৈচিত্র্যতার অনুপম মিশ্রণে তৈরি করা সঙ্গীত আবহ মুভিকে দিয়েছে প্রাণ, যে কৃতিত্বটা পুরোপুরি স্নেহার। সেজন্যই ২৮ বছর পর কোনো নারী মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার এওয়ার্ডের নমিনেশন পেয়েছিলেন স্নেহা।

প্রতিটা গানের জন্য কী পরিমাণ কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল, তা একটা উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। ফিল্মের জন্য প্রথম লেখা গানের নাম হচ্ছে, ‘ভুস কে ধার’, যেটাতে জেলখানায় কয়েদিরা ঢোল, করতাল সমেত সুর মিলিয়েছিল। গানের লিরিক রচয়িতা ভরুন চেয়েছিলেন, গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের প্রতিটা গানেই কিছু পলিটিকাল স্টেটমেন্ট ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।

সিনেমার প্লট অনুযায়ী, তখন নতুন সরকার গঠন হয়েছে ভারতে। জহরলাল নেহেরু ভারতবাসীদের যে আশার আলো দেখিয়েছিলেন (ছবির শুরুতে ছোট্ট একটা ক্লিপে তা দেখানো হয়), তা ধীরে ধীরে নিভে যেতে থাকে। হতাশার পঙ্কিল সরোবরে আবারও ডুবতে শুরু করে ভারতবাসীর অধরা স্বপ্ন। গানের একটি অংশ আছে, ‘না মিলিহে, না মিলিহে, না মিলিহে…’ এ দ্বারা বোঝানো হয়েছে তাদের স্বপ্নমুখর আশা-আকাঙ্ক্ষার নামে মূলত মুলা ঝুলানো হয়েছে। প্রতিটা জিনিসেই দেয়া হয়েছে ধোঁকা, প্রতিটা প্রতিশ্রুতিই মিথ্যা।

তৎকালীন ভারতের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে পুঁজি করেই রূপক অর্থে রচনা করা হয়েছে গানটি। জেলখানায় গানটি শুট করা কারণ হচ্ছে, দেশের মানুষ যে পরাধীনতার অদৃশ্য এক নাগপাশে বন্দি তা বোঝানোর জন্য। পরাধীনতার এই শিকল ভেঙে মুক্ত হবার দৃঢ় আশা নিয়ে বসে আছে মুক্তি-পাগল জনতা। এই গানে গলা মিলিয়েছে মুম্বাইয়ের তিনজন রিকশাওয়ালা, পাটনা থিয়েটারের গোটাকতক কিশোর, ভুপেশ কুমার এবং বিহারের শিল্পী মনিষ টিপু।

হাতে সময় কম থাকায়, রাস্তায় যেতে যেতে পর্যন্ত সমস্বরে রিহার্সাল করেছে পাটনা থিয়েটারের কিশোরেরা। সিনেমার প্রত্যেকটা গানই এরকম সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং রূপকের ছদ্মবেশে তৈরি। এবং এর লিরিকগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতিটা গানই সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে মুভির গল্পকে, এবং নতুন অধ্যায় শুরুর আভাস নিহিত থাকে গানের এই লিরিকেই।

গানের বেশিরভাগ লিরিক উঠে এসেছে পীযুষ মিশ্র এবং ভরুন গ্রোভারের হাত ধরে। সিনেমার ডার্ক কমেডি, সিচুয়েশন এবং গ্যাংস্টার ভাইবের সাথে পাল্লা দিয়ে গানগুলো বেশ জমে উঠেছিল। যেমন, ‘জিয়া তু বিহার কা লালা’, ‘এক বাগাল’, কেহ কে লুঙ্গা, ‘ও ওমানিয়া’, হান্টার, ‘ভোস’, ‘জুতা ব্ল্যাক লেদার’  প্রত্যেকটা গানের আবহ এবং লিরিক ছিল সে পরিস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত। ছবিতে বিনোদনের ষোলকলা পূর্ণ করতে গানগুলো যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই সিনেমা শেষ হলেও মনে রেষ যায় গানগুলোর। হৃদয়ে কোণে আপন সুরেই বেজে ওঠে ‘আই এম অ্যা হান্টার, অ্যান্ড শি ওয়ান্ট টু সি মাই গান’, বা ‘জিয়া হো বিহার কে লালা, জিয়া তু হাজার সালা’ 

স্নেহা খানওয়াকার; Image Source: Stars Unfolded

শুধু সেলুলয়েডের ফিতায় নয়, ওয়াসিপুরের এই সংঘাত, সংঘর্ষ ও রেষারেষি বাস্তবেও বিদ্যমান। ক্ষেত্রবিশেষে নামগুলো পালটে ফেলা হয়েছে। ফিল্মের শহিদ খান, সরদার খানের অস্তিত্ব বাস্তবেও ছিল। শফিক খানের নাম পালটে রাখা হয়েছে সরদার খান, যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপেয়ী। কিন্তু শফিক খানের বর্তমান বংশধরেরা এসব কাহিনীর সত্যতার ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

ঝাড়খণ্ডের ধনবাদের এই রেষারেষি জিশান কাদরি রূপালি পর্দায় তুলে আনলেও কাহিনীতে কিছু ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। ফয়জাল খানের কাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে বাস্তবে জীবনের ফাহিম খান থেকে। সিনেমায় দেখা যায়, সাঁইসাঁই বুলেটের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ফয়জাল খান। কিন্তু বাস্তবের ফাহিম খান এখনো জীবিত, এবং যাবজ্জীবনের সাজা-সমেত হাজারীবাগ কারাগারের এক অন্ধকার কুঠরিতে সময় পার করছেন। ছবিতে সরদার খান বাঙালী দুর্গার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, কিন্তু বাস্তবে সে নারীর সাথে বিয়ে হয়নি সরদার খানের।

আরেকটা দৃশ্যে দেখা যায়, রামাধীর সিংয়ের লোকের এক মুসলিম মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আদতে ওয়াসিপুরের কিছু জড়-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক অপহরণ করেছিল এক হিন্দু মেয়েকে। ওয়াসিপুরের জনগণ সিং পরিবারকে হুমকি দিয়েছিল, যাতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনা হয়।

ফয়জাল খানের বন্ধু ফজলুর চরিত্রটা তৈরি করা হয়েছে সাবির আলমকে কেন্দ্র করে। ছবিতে দেখানো হয়েছে, ফয়জাল খান ফজলুকে নিরস্ত্র অবস্থায় নির্মমভাবে গলা আলগা করে হত্যা করে। কিন্তু ছেলেবেলায় সাবির আলম আর ফাহিম খানের গলায় গলায় ভাব থাকলেও, পরবর্তীতে তাদের এই গভীর বন্ধুত্ব পরিণত ঘৃণিত শত্রুতায়। ২০০৭ সালে ফাহিম খানের মা এবং খালাকে হত্যার দায়ে সাবিরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

প্রেক্ষাগৃহে এই সিনেমা মুক্তির পর ওয়াসিপুরের বাসিন্দারা প্রকাশ করেছে তীব্র ক্ষোভ, তাদের মধ্যে দেখা গিয়েছে প্রতিবাদের জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। তাদের ধারণা, এই ছবি ওয়াসিপুরের গায়ে কলঙ্কের আঁচড় দিচ্ছে। তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রীকে তারা চিঠি পাঠানোর পর তার জল রাঁচি হাইকোর্টের রিট পিটিশান দাখিল পর্যন্ত গড়িয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের বেনারসে শুটিংয়ের সময় আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন সিনেমার চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর সোহিল শাহ্। মৃত্যুটা নিছকই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পনা-মাফিক খুন, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। উল্লেখ যে, ফিল্মটিকে উৎসর্গ করা হয়েছে সোহিল শাহ্’র নামে। যার ছবি ওপেনিং টাইটেলের দেয়া আছে।

ফাহিম খান; Image Source: Cinema Express

কথার পিঠে কথা সাজিয়ে যেভাবে তৈরি হয়েছে গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের সংলাপ, তাতে কাহিনীকার পৌঁছে গেছেন চরিত্রগুলোর গভীরে। আর চরিত্র-প্রধান এই সিনেমাকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সিনেমাটোগ্রাফার রাজিব রবি সুকৌশলী ট্র্যাকিং শট। তিনি এমনভাবে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল করেছেন, যাতে পর্দার দিকে তাকিয়েই চরিত্রগুলোর অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যায় দর্শকদের কাছে।

এছাড়াও এই সিনেমা ডার্ক বা ব্ল্যাক কমেডির অফুরন্ত যোগানদাতা, যার প্রমাণ সিনেমার প্রতিটা ফ্রেমেই বিদ্যমান। সিনেমায় নিহিত অবারিত সৌন্দর্য-ভেলায় আনন্দ উপাদানের কমতি নেই। ব্ল্যাক কমেডি মহলে পদার্পণের কাহিনীটা অনুরাগের নিকট নতুন নয়, কারণ তার পরিচালনার ঝুলিতে আগে থেকেই ‘দেব ডি’র মতো ডার্ক হিউমার সমৃদ্ধ মুভির বিদ্যমান ছিল।

পিস্তলের বাঁট টেপার সময় সরদার খানের হাত থেকে সে পিস্তল ছিটকে যাওয়া, শমসেরকে গুলি করার উদ্দেশ্যে ডেফিনিট পিস্তল বের করলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়া, সরদার খান দুর্গার সাথে বসে হাস্যকর ভঙ্গিতে বসে কাপড় কাচার অভিনয় করা, পারপেন্ডিকুলার এবং ডেফিনিটের মধ্যকার বাইক স্টান্ট চ্যালেঞ্জ, ডেফিনিটের নামের ব্যবচ্ছেদ, গুলি খাওয়ার পর দানিশ খানকে নিয়ে হাসপাতালে বাধা তুমুল কাণ্ড; প্রত্যেকটা সিনই ডার্ক কমেডির অনবদ্য উৎস।

এর ব্ল্যাক কমেডি সিনের পরিমাণ হয়ত গুণে শেষ করা যাবে না, কারণ এই ধাঁচেই সিনেমাটা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন অনুরাগ। এবং তিনি সফলও হয়েছেন। স্থানীয় গালি, এবং ভাষার আলাদা টান সিনেমাকে বানিয়ে তুলেছে আরও জীবন্ত। যেন, প্রাত্যহিক জীবনে ঘটা কর্মকাণ্ডকেই কেউ সকলের অগোচরে ক্যামেরা-বন্দি করে নিয়ে এসেছে।

সুলতান কুরাইশির সাথে শামশাদ আলম (ডানে); Image Source: Viacom18 Studios

এ ব্যাপারে মনোজ বাজপেয়ী বলেছেন,

“এই সিনেমা অন্ধকার এবং কৌতুক রসবোধের এক অনুপম মিশ্রণ, যা সচরাচর আপনার চোখে পড়বে না। অন্ধকার বলেছি এখানে উল্লেখিত চরিত্রগুলোর জন্য, এখানের মানুষজনের জন্য। তাদের জন্য অপরাধ এবং দুষ্কর্ম একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অপরাধ জগৎকে তারা আলাদাভাবে চিন্তা করে না। এটা তাদের প্রতিদিনকার জীবনের সাথে মিশে আছে। এভাবেই তারা জীবন অতিবাহিত করে। ওদের কাছে খুন-খারাবি হলো আপনার দুপুরের বা রাতের খাবারের মতো স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু তাদের জীবনের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে কৌতুক ও রসবোধের ছায়া। যেভাবে তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখছে, যেভাবে তারা একে অন্যকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিচ্ছে, যেভাবে তারা সবকিছুর জবাব দিচ্ছে, সবকিছুই হাস্যরসে পরিপূর্ণ এবং একই সাথে আঁধারে আচ্ছন্ন।”

দূর্গার সাথে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে সরদার খান; Image Source: Viacom18 Studios

অন্য সবকিছুর পাল্লা দিয়ে প্রচার-প্রচারণাতেও অনন্যতার আশ্রয় নিয়েছে গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর টিম। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সকল কুশীলবদের গলায় ছিল গামছা। এরপর লাল গামছা পরে ওয়াসিপুর টিম রাস্তাতেও নেচেছিল। দর্শকদের কাছে আরও সহজে পৌঁছানোর জন্য ওয়াসিপুর পত্রিকা নামে খোলা হয়েছিল এক কল্পিত অনলাইন সংবাদ পত্র। দেয়ালে সিনেমার পোস্টার সাঁটানোর বদলে নেয়া হয়েছিল ওয়াল পেইন্টিংয়ের আশ্রয়। কমপক্ষে বিশটি শহরের দেয়াল রাঙানো হয়েছিল সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগে, ‘Goli Nahi Marenge, Keh Ke Lenge– Gangs of Wasseypur’

ফয়জাল-মোহসিনার সেই বিখ্যাত অনুমতির দৃশ্য; Image Source: Viacom18 Studios

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুরের ক্ষেত্রে অনুরাগ ছিলেন বলিউডি রেনেসাঁর সব্যসাচী জাদুকর। অভিনয়, পরিচালনা, চিত্রনাট্য এমনভাবে খাপে খাপে মিলে গেছে যে বলিউড তথা ভারতের ইতিহাসে এই সিনেমা যুগ যুগ ধরে রয়ে যাবে চিরযৌবনা, এর অফুরন্ত আবেদন কখনোই ফুরোবে না। কোনো নৈতিক মূল্যবোধ না থাকলেও প্রতিটা চরিত্রের প্রতি অদ্ভুত এক টান অনুভব করবেন দর্শক। রক্ত-রাঙা হয়ে উঠা পুবের আকাশ, পাখপাখালির কলতানে মুখরিত পরিবেশ, জ্যোৎস্না প্লাবিত রাত, সকালের কাঁচা রোদ, অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়া গুলির আওয়াজ, ক্ষুদা আর দারিদ্রতার ছাপ, নিখাদ ভালোবাসা, প্রতিশোধের অন্ধ নেশা, লোভ-লালসার বিষ-বাষ্প, অস্ত্রের ঝনৎকার সবই বিদ্যমান এই ওয়াসিপুরে।

ফয়জাল খান এবং ডেফিনিট; Image Source: Viacom18 Studios

গ্যাংস অভ ওয়াসিপুর শোণিত উপাখ্যানের মোড়কে এক বিস্তৃত সভ্যতার গল্প। যে সভ্যতা পই পই করে বেড়ে উঠেছে কয়লাখনির পাশে। যে সভ্যতা নিজের স্বাধীনতার নামে লুট করেছে ট্রেন, খনি, লোহা ও জনপদের সর্বস্ব। যে সভ্যতার কাছে বলি হয়েছে আস্থা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ভরসা। যে সভ্যতা বিশ্বাসঘাতকতা, বেইমানি, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার নামান্তর।

তাই সিনেমার শেষে অজান্তেই মুখে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে,

“হামারে জিন্দেগী কা এক হি মাকসাদ হ্যাঁয়। বাদলা!”

This Bangla article is a review of the Gangs of Wassypur movie. Featured image- Viacom18 Studios

Related Articles