Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হ্যানা-বি: তাকেশী কিটানোর মাস্টারপিস

জাপানের শিল্পাঙ্গনে তাকেশী কিটানো আত্মপ্রকাশ করেন সত্তরের দশকে। শুরুতে তিনি ছিলেন একটি দ্বৈত কমেডি দলের সদস্য। বন্ধু কানেশী কানেরোর সাথে মিলে গঠন করা এই স্ল্যাপস্টিক কমেডি দলের নাম ছিল ‘টু বিট’, যার ফলশ্রুতিতে তিনি পান নিজের স্টেজ নেম ‘বিট তাকেশী’। কমেডিতে সফলতার পর তাকে দেখা যায় টিভি শোর উপস্থাপক রূপে। ছোটবেলায় জাভেদ জাফরির হিন্দি ধারাবিবরণীতে আমরা ‘তাকেশী’স ক্যাসল’ নামে যে গেম শো দেখেছিলাম, তার মূল উপস্থাপক ছিলেন কিটানো। 

পরবর্তীতে, ১৯৮৩ সালে কিটানোকে বড় পর্দায় দেখা যায় তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে; ‘মেরি ক্রিসমাস, মি. লরেন্স’ চলচ্চিত্রে। ১৯৮৯ সালে তাকে কাস্ট করা হয় ‘ভায়োলেন্ট কপ’ নামে একটি ডার্টি হ্যারি টাইপের সিনেমায়। ডিরেক্টরের অসুস্থতা তাকে এনে দেয় এই প্রজেক্টের সর্বেসর্বা হওয়ার সুযোগ। প্রথমেই তিনি চিত্রনাট্য পুনর্লিখনে মনোনিবেশ করেন, যাতে ছিল পরবর্তীকালে তার সিগনেচারে পরিণত হওয়া ডেডপ্যান হিউমার, উদাসীনতা, হঠাৎ করে ভায়োলেন্সের উদগীরণ হওয়া, সূক্ষ্ণ সামাজিক সমালোচনা, এবং অন্যান্য প্রতীকী ইঙ্গিতের নির্যাস। সিনেমাটি দর্শক এবং সমালোচক উভয় মহলের হৃদয় জয় করে নেয়। একজন আর্ট-হাউজ ফিল্মমেকার হিসেবেও তাকে পরিচিতি এনে দেয় এটি। 

তাকেশী কিটানো; Image Source : filmaffinity.com

 

আন্তর্জাতিক দর্শকেরা কিটানোর মেধার সাথে পরিচিত হন তার স্বতন্ত্র গ্যাংস্টার ফিল্ম ‘সোনাটাইন’ (১৯৯৩)-এর মাধ্যমে। ১৯৯৭ সালের হ্যানা-বি তার প্রতি সিনেমানুরাগীদের শ্রদ্ধা আরো প্রগাঢ় করে তোলে। ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন জিতে নেওয়া চলচ্চিত্রটি দেশে-বিদেশে আরো অনেক পুরষ্কারে ভূষিত হয়। তবে বরাবরের মতো তখনও জাপানী অ্যাকাডেমি কিটানোকে উপেক্ষা করে। বেশ কিছু ক্যাটাগরিতে মনোনীত হলেও তারা কেবল জো হিসাইশীকে ‘বেস্ট মিউজিক্যাল স্কোর’-এর পুরষ্কার প্রদান করে। তবে এ ঘটনা জাপানের পাশাপাশি তার বিশ্বব্যাপী একজন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পরিচালক হিসেবে পরিচিতি লাভে বাধা হতে পারেনি। যদিও তার বেশিরভাগ সিনেমাতেই ঘুরে-ফিরে এসেছে পুলিশ এবং ইয়াকুজা নামে পরিচিত জাপানী মাফিয়ারা; তথাপি অন্য ঘরানার সিনেমাতেও রয়েছে তার অবাধ বিচরণ। ‘অ্যা সিন অ্যাট দ্য সী’ (১৯৯১), ‘কিডস রিটার্ন’ (১৯৯৬), বা ‘কিকুজিরো’ (১৯৯৯); এ সমস্ত সিনেমা কিটানোর ডাই হার্ড ফ্যানবেসের বাইরেও জনপ্রিয় হয়েছে। 

ডিটেকটিভ নিশী (তাকেশী কিটানো; পর্দায় তার ছদ্মনাম বিট তাকেশী ব্যবহৃত হয়েছে) ইতোমধ্যেই হারিয়েছেন নিজের সন্তানকে। ভাগ্যের ফেরে এবার হারাতে চলেছেন প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মিউকিকে (কায়োকো কিশিমোতো)। তার থাকার কথা ছিল একটি স্টেকআউটে। কিন্তু বন্ধু হোরিবে (রেন অসুগি) তাকে রাজি করান মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে দেখতে যেতে। হাসপাতালে গিয়ে সে পরিচিত হয় স্রষ্টার নিকষ সেন্স অব হিউমারের সাথে। কেননা, সেখানে গিয়ে সে জানতে পারে- মিউকির মৃত্যু অবধারিত, ডাক্তারদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না। এখানে রাখার চেয়ে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে বলেও পরামর্শ দেয়া হয়। এ সময় এক সহকর্মী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে খবর দেয়, স্টেকআউটে গোলাগুলি হয়েছে। নিশীর পার্টনার হোরিবের গায়ে গুলি লেগেছে, এবং সে গুরুতর আহত। 

নিশীর স্ত্রী মিউকো; Image Source : twitter.com

 

পরবর্তীতে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ হোরিবেকে দেখতে নিশী যায় তার সমুদ্রতীরবর্তী বাসায়। পরিবার-পরিজন পরিত্যক্ত এই সাবেক ডিটেকটিভ পেইন্টিংয়ে মনোনিবেশ করার কথা ভাবেন। কিন্তু এই দামী শখ চরিতার্থ করতে প্রয়োজন নানা দ্রব্যের, যা কেনার সাধ্য তার নেই। এজন্য এগিয়ে আসে নিশী। ইয়াকুজাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সে বন্ধুকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে দেয়। কিছু অর্থ সে দেয় এক অল্পবয়সী বিধবাকে (ইউকো ডাইকে), স্বামী হারানোর পর যাকে বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে ফাস্টফুডের দোকানে। 

সহকর্মীদের নৃশংস মৃত্যুর স্মৃতি পীড়া দেয় নিশীকে। সাথে যুক্ত হয় শীঘ্রই প্রিয়তমাকে হারানোর অনুতাপ। সে ঠিক করে- জীবনের কিছু ভুল শোধরাতে হবে। পুলিশের চাকরি ছেড়ে সে একটি পুরাতন ট্যাক্সি কেনে। এবং পুনরায় রং করে একে পুলিশের গাড়ির রূপ দেয়। তারপর নিজের পুরনো ইউনিফর্ম পরে একলাই ডাকাতি করতে চলে যায় একটি ব্যাংকে। ডাকাতির এই সিকোয়েন্সটি ধারণ করা হয়েছে চিত্তাকর্ষকভাবে। একে আমরা দেখি একটি সিকিউরিটি ক্যামেরার চোখে। লুটের অর্থ দিয়ে সে কর্তব্য পালন করে, এবং ইয়াকুজাদের দেনা শোধ করে। তারপর বাকি অর্থ দিয়ে ভ্রমণের পরিকল্পনা করে, যা হবে স্ত্রীর সাথে তার শেষ সুখস্মৃতি। কিন্তু তাতে বাধ সাধে সন্ত্রাসীরা। এতক্ষণে আমরা নিশীকে যতটুকু চিনেছি, তাতে মনে হয় না সে কারো হুমকিতে ভীত হওয়ার মতো মানুষ/ কারো সাতেপাঁচে নেই এটা ঠিক। কিন্তু গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগতে এলে সে-ও বসে থাকবে না। এরপর কী হয় জানতে দেখতে হবে সিনেমার বাকি অংশ। 

একা সমুদ্রতীরে বসে আছে হোরিবে; Image Source : twitter.com

 

১০৩ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি মিনিম্যালিস্টিক, ভাবাবেগ এবং চারিত্রিক পঙ্কিলতা মুক্তির আবহে টইটম্বুর এক যাত্রার কথা বর্ণনা করে। এটি পরিচালকের মানবীয় অভিব্যক্তি এবং রীতিবিরুদ্ধ ঝোঁকের নিখুঁত সংমিশ্রণ। সাথে যুক্ত হয়েছে তার স্বভাবসিদ্ধ সেন্স অব হিউমার, যা একাধারে সূক্ষ্ম, আকস্মিক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্ল্যাপস্টিক। এগুলো সিনেমার বিনোদনের দিক ত্বরান্বিত করেছে। কিটানো এখানে বেশ কিছু মোটিফ এবং প্রতীক ব্যবহার করেছেন। সিনেমার প্লটে এগুলোর ব্যাপক প্রভাব থাকলেও লেখায় তুলে ধরা অসম্ভব। যেমন- সৈকতে ছোট্ট একটি মেয়ের সাথে ঘুড়ি ওড়ানোতে মেতে ওঠা, কখনো কখনো পর্দায় ভেসে ওঠা কিছু প্রাণীর চিত্রকর্ম, যেগুলোর মাথার জায়গায় রয়েছে ফুল। অথবা শান্ত, স্থবির জলরাশির দৃশ্যের কথাও বলা যায়। 

হ্যানাবি শব্দটিকে একসাথে লিখলে তার অর্থ ফায়ারওয়ার্কস। আবার মাঝে হাইফেন দিয়ে লিখলে (হ্যানা-বি); তার অর্থ ফায়ার অ্যান্ড ফ্লাওয়ার। এভাবে সিনেমার নামের সাথেও মিশে আছে খানিকটা হেঁয়ালি। মুখের পাশে আঘাতের চিহ্ন এবং রোদচশমায় অভিব্যক্তি ঢাকা পড়া নিশী পর্দায় দেখানো জলরাশির মতোই নিশ্চল, উদাসীন থাকে বেশিরভাগ সময়। কিন্তু কেউ ঝামেলা পাকাতে আসলে তাকে ছেড়ে দেওয়ার বান্দাও সে নয়। তাই দরকারের সময় আতশবাজির মতোই ফুটে উঠতে দেখা যায় তাকে। অন্যদিকে, সিনেমার নামে যদি আগুন আর ফুলের কথা বলা হয়, তাহলে এটি নিশীর চরিত্রের দ্বিমুখীতা ফুটিয়ে তোলে। নিজের স্ত্রী এবং কাছের মানুষের জন্য তার মন পুষ্পের মতোই কোমল। কিন্তু শত্রুদের জন্য তা আগুনের মতো ভয়াবহ। নিশী চরিত্রের উভয় দিক ফুটিয়ে তোলায় কিটানো দেখিয়েছেন অনবদ্য পারঙ্গমতা, যা তার বর্ণিল ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ বলে বিবেচিত সকলের কাছে। 

মিউকোর সাথে নিশী; Image Source : filmaffinity.com

 

হ্যানা-বির গল্প কাল্পনিক হলেও তার সাথে মিশ্রিত হয়েছে কিটানোর বাস্তব জীবনের কিছু উপকরণ। ১৯৯৪ সালে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। তার মুখের বিখ্যাত কাটা দাগ ঐ দুর্ঘটনা থেকেই পাওয়া। আবার আহতাবস্থা থেকে সেরে ওঠার সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন পেইন্টিংয়ের প্রতি। সিনেমায় যেসব চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে, সেগুলো আসলে কিটানোরই আঁকা। নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন হোরিবের চরিত্র দিয়ে। পাশাপাশি স্থাপন করেছেন নৃশংস ঘটনার পর বিপরীত মুখে অভিগমন করা দুই বন্ধুর যাত্রা। করিৎকর্মা ব্যক্তি থেকে হঠাৎ হুইল চেয়ারে চৌহদ্দিতে বন্দী হয়ে পড়া হোরিবে চরিত্রে রেন ছিলেন অসাধারণ। বিষণ্নতা এবং তা থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণ করার অভিব্যক্তি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণ দক্ষতায়। গল্পের কথক বা যুক্তির কণ্ঠস্বর নাকামুরা রূপে সুসুমা তেরাজিমাও দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। 

নিশীর স্বল্পভাষীতা এবং কথোপকথনে অনীহার মতো মুভিতেও ডায়লগ খুব বেশি নেই। তাই আবহ সৃষ্টি এবং স্টোরি টেলিং অনেকাংশে নির্ভর করেছে সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের উপর। ইয়ামামোতো আর হিসাইশীর অনবদ্যতা তাই সাহায্য করেছে গল্পে প্রগাঢ়তা আনয়নে। এডিটিংয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে, যাতে যুক্ত ছিলেন কিটানো নিজে। 

হ্যানা-বি যতটা না অপরাধ সংক্রান্ত, তার চেয়েও বেশি মনস্তাত্ত্বিক। তাই সিনেমার প্রগাঢ়তা অনেকাংশে দর্শকের উপর নির্ভরশীল। সময় করে তাই দেখে নিতে পারেন জাপানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা পরিচালকের ক্যারিয়ারের অনন্য এই চলচ্চিত্র।

Related Articles