তৌকীর আহমেদের স্ফুলিঙ্গ কি রং দে বাসন্তী সিনেমার নকল?

তৌকীর আহমেদ গুণী নির্মাতা। এপর্যন্ত ছয়টি সিনেমা নির্মাণ করেছেন তিনি। জয়যাত্রা থেকে সবশেষ ফাগুন হাওয়ায়- তার প্রতিটি সিনেমার বিষয়বস্তু ছিল আলাদা, নির্মাণশৈলীও ছিল অনন্য। তৌকীরের সপ্তম সিনেমা স্ফুলিঙ্গ’র ট্রেলার মুক্তি পেয়েছে কয়েকদিন আগেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বর্তমান সময়ের তারুণ্যের প্রেক্ষাপটকে এক বিন্দুতে এনে সিনেমার গল্প সাজিয়েছেন পরিচালক। তবে ট্রেলার রিলিজের পর থেকেই ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডি সিনেমা রং দে বাসন্তীর সঙ্গে স্ফুলিঙ্গকে তুলনা করতে শুরু করেছেন অনেকে। কেউ কেউ তো বলছেন, স্ফুলিঙ্গ’র গল্প নাকি বলিউডি এই সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত! আসলেই কি তাই?

রং দে বাসন্তী: দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত একটি কাল্ট ক্ল্যাসিক সিনেমা

রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার এই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে। এতে অভিনয় করেছিলেন আমির খান, শারমান যোশি, অতুল কুলকার্নি, কুনাল কাপুর, মাধবন, সোহা আলী খান, ওয়াহিদা রেহমানসহ আরও অনেকে। সিনেমার গল্পটি সমানতালে এগিয়েছে দুটো আলাদা সময়কে ঘিরে, একদিকে ছিল সিনেমা নির্মাণের সময়কার প্রেক্ষাপট, তখনকার তরুণদের মানসিকতা ও দেশ নিয়ে তাদের ভাবনা। পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এসেছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত বিপ্লবীদের অবদানের কথাও, যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন মাতৃভূমিকে ইংরেজদের কবল থেকে স্বাধীন করার জন্য। 

রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার এই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে © Rakeysh Omprakash Mehra Pictures

২০০৬ সালের বাস্তবতায় বর্তমান সময়কার তারুণ্যের একটি চিত্রপট এঁকেছিলেন রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা। সেখানে আমরা দেখতে পাই একদল ছন্নছাড়া তরুণকে, জীবন নিয়ে যারা উদাসীন, দেশ নিয়ে যাদের ভাবনা নেই। রাজনীতিবিদেরা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে, সিস্টেম ভেঙে পড়েছে- এটুকুই তারা জানে। কিন্ত সিস্টেমের ভেতর ঢুকে সেটাকে বদলে দেওয়ার ইচ্ছেটা তাদের নেই, বরং দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনো সুযোগ পেলে সেটাই তারা নিতে চায়। আবার এর বিপরীতে আমরা দেখি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অজয় রাঠোড়কে, দেশ নিয়ে যার অগাধ স্বপ্ন, যে বুক ফুলিয়ে বলে, কোনো দেশ পারফেক্ট হয় না, তাকে পারফেক্ট বানাতে হয়। পাশাপাশি আমরা পাই লক্ষ্মণ পাণ্ডেকেও, যার কাছে নিজের ধর্মের নামে, সমাজের নামে গোঁড়া আচরণ করাটাই দেশপ্রেম!

এই তরুণেরাই আমূল বদলে গেল তাদের ইংরেজ বন্ধু স্যু ম্যাককিনলের ফিল্মে কাজ করতে গিয়ে। তাদের মধ্যে এসে ভর করল চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগত সিং, রামপ্রসাদ বিসমিল, শিবরাম রাজগুরু, আশফাকুল্লাহ খান বা দূর্গাবতী দেবীর মতো স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয়া যোদ্ধারা। দেশপ্রেম কী, সেটা তারা নতুন করে উপলব্ধি করতে পারল, দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ানো একদল তরুণ আচমকাই যেন খুঁজে পেল জীবনের মানে। 

এরইমধ্যে বিমান চালাতে গিয়ে করুণ মৃত্যু ঘটল তাদের বন্ধু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট অজয় রাঠোরের। যে তরুণ নিজের প্রাণ বিপন্ন করে, বিমান থেকে ঝাঁপিয়ে না পড়ে আম্বালা শহরের শত শত নিরীহ মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছিল, তাকেই অপবাদ দেওয়া হলো আনাড়ি পাইলট হিসেবে, বলা হলো, অজয়ের ভুলেই ঘটেছে বিমান দুর্ঘটনা। গর্জে উঠলো তার বন্ধুরা, তারা প্রতিবাদ জানাল রাজপথে নেমে, জবাবে সইতে হলো পুলিশি নির্যাতন। 

সিনেমার গল্পটি সমানতালে এগিয়েছে দুটো আলাদা সময়কে ঘিরে © Rakeysh Omprakash Mehra Pictures

তাহলে কি থেমে যাবে এই অগ্নিস্পৃহা? সাঙ্গ হবে সব আয়োজন? তা কী করে হয়? ওদের মনের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা বিপ্লবী সত্তারা যে জেগে উঠেছে ততদিনে। স্বাধীনতার দাবিতে যেভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল চন্দ্রশেখর আজাদ বা ভগত সিংয়ের অস্ত্র, যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে লড়তে প্রাণ বিলিয়েছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল আর আশফাকুল্লাহ খান, সেভাবেই আরও একবার সিস্টেমকে নাড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে পাশাপাশি দাঁড়াল দলজিত এবং করণ, ক্ষমতাবানদের অন্যায়টা সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার স্পৃহায় একে অন্যের হাত ধরল লক্ষ্মণ পাণ্ডে এবং আসলাম খান। তারপরের গল্পটা নাহয় দর্শকদের জন্যেই তোলা রইল। 

স্ফুলিঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বর্তমানের তারুণ্যের মেলবন্ধন

তৌকীর আহমেদের স্ফুলিঙ্গ সিনেমার গল্পটা এগিয়েছে মূলত একটি ব্যান্ড দলকে নিয়ে, বিজয় দিবসের কনসার্টে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছে যারা। এমন একটি সময়কে তৌকীর ধারণ করেছেন এই সিনেমায়, যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলাটাকে ‘রাজনীতি করা’ হিসেবে দেখা হয়, কেউ দেশের গান গাইলে বলা হয় ‘পলিটিক্যাল গান’ গাইছে। এই তরুণদের মধ্যে সাম্য আছে, ভাতৃত্ব আছে, আছে প্রতিবাদী চেতনা। গল্পের প্রয়োজনে সিনেমায় একাত্তর এসেছে, এসেছে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী, এসেছে সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া তেজোদীপ্ত ভাষণও। পাশাপাশি আছে বন্ধুত্ব, প্রেম আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্পৃহাও। আছে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির আস্ফালন আর এসবের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানোর গল্পও। 

স্ফুলিঙ্গ সিনেমার গল্পটা এগিয়েছে মূলত একটি ব্যান্ড দলকে নিয়ে © Shopner Bangladesh Foundation

রং দে বাসন্তী ও স্ফুলিঙ্গ: যত মিল, তারচেয়ে বেশি অমিল

রং দে বাসন্তীতে যেমন দুটো আলাদা সময়ের গল্প বলা হয়েছে, স্ফুলিঙ্গতেও তৌকীর আহমেদ সেই কাজটিই করেছেন। দুটো সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রেই আছে বন্ধুদের দুটো দল, যারা সিনেমার একটা পর্যায়ে গিয়ে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। দুটো সিনেমাতেই বন্ধুত্বের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে প্রেম, আছে মাথা নত না করার দুঃসাহস, আছে তারুণ্যের দুর্বিনীত স্পর্ধা। রং দে বাসন্তীতে রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা যেমন বর্তমান সময়কে রঙিন ফ্রেমে, এবং অতীতটাকে গ্রে শেডের একটি ফ্রেমে ধরার চেষ্টা করেছেন, একই ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় স্ফুলিঙ্গের কালার গ্রেডিংয়েও। এখানেও বর্তমান সময়টাকে আধুনিক ধাঁচের রঙে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে একটু ক্লাসিক ধাঁচের রঙে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। মোটাদাগে দুটো সিনেমার মধ্যে আপাতত এটুকুই মিল চোখে পড়ে।

বর্তমান সময়টাকে আধুনিক ধাঁচের রঙে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে একটু ক্লাসিক ধাঁচের রঙে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক © Shopner Bangladesh Foundation

কিন্ত এর চেয়ে অনেক বেশি আছে অমিল। সবচেয়ে বড় অমিলের জায়গাটি হচ্ছে, রং দে বাসন্তী সিনেমায় চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগত সিং, রামপ্রসাদ বিসমিল, শিবরাম রাজগুরু, আশফাকুল্লাহ খান বা দূর্গাবতী দেবীর মতো কিংবদন্তী চরিত্রগুলো উঠে এসেছিল গল্পের নিরিখে। তাদের দৃশ্যায়ন করতে গিয়ে পরিচালক নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছিলেন ট্রেন ডাকাতি, বোমা নিক্ষেপ করে ইংরেজ সাহেবকে হত্যার চেষ্টা, জেলখানায় বন্দিদের অনশন ধর্মঘট, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড বা ধরা না পড়ার অভিপ্রায়ে চন্দ্রশেখর আজাদের আত্মাহুতি দেওয়ার সত্যি ঘটনাগুলো। স্ফুলিঙ্গতে সেটি অনুপস্থিত। 

তাছাড়া রং দে বাসন্তীর প্রেক্ষাপট এবং স্ফুলিঙ্গ সিনেমার প্রেক্ষাপটও সম্পূর্ণ আলাদা। রং দে বাসন্তী বর্তমান প্রেক্ষাপটের গল্পে কথা বলেছে সরকারের এক দুঁদে মন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে, অন্যায় এবং সিস্টেমের ধসে পড়া নিয়ে। রং দে বাসন্তী একদল ক্ষুব্ধ তরুণের প্রতিশোধস্পৃহায় মাতোয়ারা হবার গল্প বলেছে। এই ক্ষুব্ধ তারুণ্য স্ফুলিঙ্গ সিনেমাতেও উপস্থিত, কিন্ত সেখানে প্রতিশোধ নেই, আছে ন্যায়ের পক্ষে অবস্থানের দৃঢ়তা, আছে নিজ অধিকার আদায়ের অভিপ্রায়। রং দে বাসন্তীতে যতটা বৃহৎ ক্যানভাসে, বড় পরিসরে গোটা জাতিকে টার্গেট অডিয়েন্স বানিয়ে গল্প বলা হয়েছে, সেটি স্ফুলিঙ্গে অনুপস্থিত। 

রং দে বাসন্তী একদল ক্ষুব্ধ তরুণের প্রতিশোধস্পৃহায় মাতোয়ারা হবার গল্প বলেছে © Rakeysh Omprakash Mehra Pictures

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, রং দে বাসন্তীতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেয়েছে। কিন্ত স্ফুলিঙ্গ সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, বরং পরিচালক চেষ্টা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং বঙ্গবন্ধুর চেতনার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মকে সংযুক্ত করতে। তৌকীর আহমেদ নিজেই বলেছেন, তিনি চেষ্টা করেছেন, বর্তমান তারুণ্যের চোখে ৭১ সালের তারুণ্যকে দেখাতে। এসময়ে বসে যেখানে একজন দর্শক মুক্তিযুদ্ধের সময়কে খুঁজে পাবেন, যেখানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, সংগ্রামের কথাও উঠে এসেছে। 

তাছাড়া রং দে বাসন্তী সিনেমায় আমরা গল্পের একটি বড় অংশ ইংরেজ ফিল্মমেকার স্যু ম্যাককার্থির স্মৃতিচারণে দেখতে পাই, কিন্ত স্ফুলিঙ্গতে এরকম কোনো চরিত্র রাখেননি পরিচালক। আর রং দে বাসন্তীর শেষটা হয়েছে বিয়োগাত্মক পরিণতিতে, সেখানে একটি মিশন ছিল, চরিত্রগুলোর করুণ পরিণাম দর্শকের মন খারাপের কারণ হয়েছে এই সিনেমায়। কিন্ত স্ফুলিঙ্গতে শেষ প্রান্তে সমবেত কণ্ঠে বিজয় দিবস কনসার্টে গান গাওয়ার একটা হ্যাপি এন্ডিং দিয়ে সিনেমাটির সমাপ্তি টেনেছেন পরিচালক, ট্রেলারে এমনটাই দেখা গেছে।

স্ফুলিঙ্গতে হ্যাপি এন্ডিং দিয়ে সিনেমাটির সমাপ্তি টেনেছেন পরিচালক © Shopner Bangladesh Foundation

কাজেই একথা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, রং দে বাসন্তীর সঙ্গে তৌকীর আহমেদের স্ফুলিঙ্গ সিনেমার মিল থাকা বা গল্পটি নকল হওয়া নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠছে, সেগুলো অমূলক। দুটো সিনেমার বেশ কিছু বিষয়ে মিল আছে, এটি সত্যি। কিন্ত দুটো পৃথক সময়কে ধরার চেষ্টা এর আগেও নানান দেশের নানা ইন্ডাস্ট্রির সিনেমায় হয়েছে, সেসব সিনেমাতেও দেশপ্রেম ছিল, তারুণ্য ছিল, ছিল বন্ধুত্ব, প্রেম কিংবা ভালোবাসাও। কিন্ত গল্পের বিষয়বস্তু ছিল আলাদা, উপস্থাপনেও ছিল পার্থক্য। রং দে বাসন্তী এবং স্ফুলিঙ্গ সিনেমাতেও এসব মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান, কাজেই স্ফুলিঙ্গকে রং দে বাসন্তীর নকল কিংবা রং দে বাসন্তী থেকে স্ফুলিঙ্গ’র গল্পটি অনুপ্রাণিত- এমন অভিযোগ করার সুযোগ নেই বললেই চলে।

This article has been written on the discussion of comparison between Sphulingo and Rang De Basanti. 

Featured Image Source: © Shopner Bangladesh Foundation

Related Articles