Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বঙ্গবন্ধুকন্যার হৃদয়ছোঁয়া গল্প

♪ মা আমার সাধ না মিটিলো, আশা না পুরিলো
সকলই ফুরায়ে যায় মা… ♪

বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় গান ছিল পান্নালাল ভট্টাচার্যের গাওয়া এ শ্যামা সঙ্গীতটি। করাচি থেকে ফিরবার পর এই গান তিনি বারবার শুনছিলেন। এই কথাটি হয়তো অনেকেই জানতেন না। না জানাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী- এগুলো পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কতটুকুই বা জানা যায়? মেয়ের সাথে তাঁর যে খুনসুটি, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পরম ভালোবাসায় স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরার মুহূর্তগুলোকে কি আদৌ আর অনুভব করা যায়?  হয়তো সেগুলোরই একটু স্বাদ দিতে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ছোটখাট আবেগগুলোকে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কণ্ঠে সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী করার মতো কঠিন কাজটি করেছেন পিপলু খান, সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ডকুমেন্টারি ‘Hasina: A Daughter’s Tale’-এ। পুরো সিনেমাজুড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ‘সাধ না মিটিলো, আশা না পুরিলো’ গানটি ফিরে এসেছে আবহ সংগীত হিসেবে, দর্শকের মনে সৃষ্টি করেছে এক অজানা হাহাকার। 

তথ্যচিত্রগুলো সাধারণত নির্ভর করে গল্পের ওপর, তবে এই সিনেমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি আসলে ছিল এর সিনেমাটোগ্রাফির কাজ। পুরো সিনেমা জুড়ে ধীরগতির চিত্রের সাথে আলো-আঁধারির মিশেল সিনেমাটির বিষাদ ভাবের সাথে পুরোপুরিই মিলে গেছে। বিষাদ বলার কারণ, অ্যা ডটার’স টেল এর ক্লাইম্যাক্স মুহূর্তগুলো আসলে পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময়কাল এবং ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা। দুটো হামলাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু সেগুলো তার জীবনে দাগ ফেলে যায়। পঁচাত্তরের ঘটনার সময় তিনি ছিলেন বেলজিয়ামে, হারান নিজের বোন বাদে পরিবারের সকলকে। আর ২০০৪ সালে হামলাটা হয় তাকে হত্যা করবার জন্যই; কিন্তু সেবার তিনি আহত হলেও হারান কাছের মানুষদের। এ দুই নির্মমতার প্রতিধ্বনি পুরো সিনেমাজুড়ে শুনতে পাওয়া যায়। বাদ যায়নি নূর হোসেনের ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ কাঁধে লিখে নিহত হবার ঘটনাও।   

পরিচালক পিপলু খান; Image Source: IMDb

এবারে একটু ভিন্ন গল্পে ফিরি। আমরা সাধারণত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আলোচনা সভাতে বা সংসদের বক্তৃতারত অবস্থায় দেখি। কিন্তু রান্নাঘরে খুব সাধারণভাবে রান্না করা, বাড়ির পেছনে পরিবারের সদস্যদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলা, সবাই মিলে খাবার টেবিলে বসে খাওয়া- এমন দৃশ্যগুলোতে কখনও কল্পনা করেছি তাকে? কিংবা যখন ছোট ছিলেন তখন মায়ের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক, সব কাহিনী একে অন্যকে খুলে বলা, কিংবা ছোট ভাইদের দুষ্টুমি, বোনদের নামে প্রেমপত্র এলে সেগুলো গিয়ে বাবা-মাকে বলে দেয়া, শেখ কামাল আর জামালের গল্পগুলো- এত সাবলীলভাবে ছোটখাট বিষয়গুলো উঠে এসেছে যে, মনেই হবে না এতগুলো বছর ধরে তিনি একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। একটি দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।

পরিবারের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; Image Source: Applebox Films 

আরেকটি বিষয় সিনেমায় প্রাধান্য পেয়েছে। সেটি হলো টুঙ্গিপাড়ার প্রতি শেখ হাসিনার টান। পরিচালক সেখানেও সফল, পুরো ব্যাপারটি ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণভাবে।

যখন টুঙ্গিপাড়া আসি, ভীষণ ভালো লাগে। খুবই ভালো লাগে। মনে হয় যেন, আমি আমার মাটির কাছে ফিরে এসেছি, মানুষের কাছে চলে এসেছি। আমার তো মনে হয় যে, পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা টুঙ্গিপাড়া। খালের পাড়ে একটা হিজল গাছ ছিল। আর হিজল গাছের তো অনেক শিকড় হয়। তো, আমরা ছোটবেলা এই হিজল গাছের শিকড়ের উপর থেকে লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে খালে ঝাঁপাতাম।

এখানেই শায়িত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিপলু খানের ক্যামেরার জাদুতে এই টুঙ্গিপাড়া বাংলার যেনতেন এক গ্রাম থাকেনি, ঠিক যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা সকলের স্বপ্নপুরী।

যে মুহূর্তটি শেখ হাসিনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, সেই পনেরো আগস্টের কথায় আসা যাক। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি যে ভোরবেলা পরিণত হয়েছিল এক টুকরো নরকে। নরপিশাচদের গুলি থেকে রেহাই পাননি নারী-শিশু কেউই। সেই একেকটি গুলির আওয়াজ যখন শোনানো হচ্ছিল ডকুমেন্টারিতে, মনে হচ্ছিলো সেগুলো বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দু’বোনই তখন বিদেশে, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। এ অংশের বর্ণনা ব্রাসেলসে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের বাসায় থাকা তাদের মুখে না শুনলে আসলে পূর্ণতা পায় না।

ডকুমেন্টারিতে ব্রাসেলসের ঘটনা বর্ণনা করবার সময় দেখানো বাড়ি; Image Source: Applebox Films

“চৌদ্দ তারিখ রাত্রে (১৯৭৫) ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। তো আমাদের কাছে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার ঐ বয়সে, ব্রাসেলসে… মেয়েরা সব আমার বয়সী, আমাদের তো খুব হাসাহাসি, গল্প! তো, দুলাভাই এসে আমাদের খুব বকলেন, যে, কান্না আছে সারা জীবন, এত হাসছে- উনি তো ঘুমাতে পারছেন না। উনি যত এসে বকে, আমরা তত হাসি।

সকালে একটা ফোন বাজলো। আমার মনে হয়, ফোনের আওয়াজটা, মানে, আমার জীবনে এত কর্কশ ফোনের আওয়াজ আমি জীবনে শুনিনি। কেন যেন আমার কাছে এমন মনে হলো। তো আমরা যে রুমটায় ছিলাম সেখান থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, ঠিক সিঁড়ির কোণায় ফোনটা। তো উনি ফোনটা ধরলেন, তারপর আমাকে বললেন তোমার হাজবেন্ডকে ডাকো।

আমি বললাম, কেন কী হয়েছে? আমাকে বলো।

উনি বললেন, না, ডাকো।

আমি উঠালাম, আসলো। তখন জানলাম, বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে।

ক্যু হয়েছে শুনেই আমি বললাম, তাহলে তো আমার আর কেউ বেঁচে নেই। এটুকুই আমার মুখ থেকে আসলো।”

এটুকু বলে শেখ হাসিনা চোখের পানি আটকাতে পারলেন না। তা-ও বলে চললেন, “তো, তারপর থেকে যেকোনো ফোন ওভাবে বাজলেই খুব… হঠাৎ ভেতরে, মানে, বুকের ভেতরে ইয়ে করে উঠতো। কেমন যেন একটা অন্যরকম কষ্ট। ফোনের আওয়াজটাই সহ্য করতে পারতাম না।

ডকুমেন্টারিতে অশ্রুসিক্ত শেখ হাসিনা; Image Source: Applebox Films

হুমায়ূন রশিদ সাহেবকে অ্যাম্বাস্যাডর সানাউল হক সাহেব বললেন, আপনি যে বিপদটা আমার ঘাড়ে দিয়েছেন, এখন এটা নিয়ে যান। 

কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মানুষের যে পরিবর্তন- ক্যান্ডেল লাইট ডিনার থেকে ঘরের থেকে বের করে দেয়া, এই অবস্থা। আমাদেরকে ওদের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার কথা (জার্মানির)। উনি নিজের গাড়িটা দিলেন না। সোজা বলে দিলেন যে, গাড়িটা নষ্ট। তো ওখানে আরেকজন অফিসার ছিলেন, তার স্ত্রী আর আমি ক্লাস সেভেন থেকে একসাথে পড়তাম। তো সেই ভদ্রলোক একটু খাতির করলো। তখন বেলজিয়ান ভাষায় টিভিতে নিউজ হচ্ছে, বারবার আব্বার ছবি দেখাচ্ছে, কিন্তু আমরা কিছু বুঝতে পারছি না।

বেলজিয়ামের বর্ডারে আমরা এ পাশে নামলাম। তারপর নো ম্যান্স ল্যান্ডটা হেঁটে মালপত্র সব হাতে করে নিয়ে ইমিগ্রেশন করে আমরা ওপারে গিয়ে…”

ডকুমেন্টারিতে জার্মান বর্ডারে পৌঁছে যাবার সময়ের দৃশ্য; Image Source: Applebox Films

এর পরের গল্পটা ডকুমেন্টারি থেকেই দেখে নেয়া সমীচীন। বিদেশ বিভূঁইতে দুই বোনের স্বজনহীন জীবন কাটানো, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর হাত বাড়িয়ে দেয়া, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহতে গিয়ে বহু বছর আগে বাবার একই তারিখে সই করবার হৃদয়স্পর্শী ঘটনাগুলো দাগ কেটে যায়।

“বাংলাদেশের বাঙালিরা আমার বাবাকে মারবে এটা তো ধারণারও বাইরে ছিল,” বলছিলেন শেখ রেহানা। তার এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরো ব্যাপারটা যদি স্বপ্ন হতো? কেবল এক দুঃস্বপ্ন? “ডিকেন্সের একটা বই ছিল- টেল অফ টু সিটিজ। দুই বোন রিপাবলিকান, উলের কাঁটা দিয়ে বুনছে, আর ওদের যারা অত্যাচার করতো তাদের কথা ভাবছে। তো যখন শেষটাকে মারলো তখন বলল, থার্টি টু। মানে কয়জনকে মারছে সেটা গুনছিল দুই বোন মিলে। তো আমি ঐটা দিল্লিতে থাকতে আপাকে বলতাম, আপা, আমরা এরকম করবো। তখন কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বলতে পারবা না। আপা বলতো, মাথা ঠাণ্ডা কর, মাথা ঠাণ্ডা কর।”

সুন্দর পরিচালনা আর সিনেমাটোগ্রাফির ডকুমেন্টারিটি অবশ্য ক্রোনোলজিক্যাল নয়, অর্থাৎ সাল অনুযায়ী এগিয়ে যায়নি। গুরুত্ব অনুযায়ী যখন যা বলবার সেভাবে এগিয়ে গিয়েছে। ‘আমার সাধ না মিটিলো’ গানটা যে এত সুন্দর করে ব্যবহার করা যায়, এই সিনেমাটি না দেখলে বোঝা যেত না!

পিপলু খান বলেন, তার মাত্র পাঁচ মিনিট লেগেছিল পরিস্থিতি একদম হালকা করে ফেলতে, শেখ হাসিনার সাথে প্রথমবার যখন বসেছিলেন এ প্রোজেক্টের কাজে। দুই বোন একসাথে বসেই অনেকবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বছরের পর বছরের সেই সাক্ষাৎকারগুলো থেকেই তৈরি এ সিনেমা, শেষ করতে লেগেছে পাঁচটি বছর। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে তারা শুটিং করেছিলেন ১৪ দিন ধরে, শেখ হাসিনাও ছিলেন মাঝে মাঝে।

দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা একত্রে; Image Source: www.thedailystar.net

এ মুভির সাথে জড়িত গুণীদের নামের তালিকা বেশ লম্বা। সিআরআই (CRI বা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন) আর অ্যাপলবক্স ফিল্মসের (Applebox Films) এর যৌথ কাজ এটি। প্রযোজক ছিলেন রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও নসরুল হামিদ বিপু, পরিচালক পিপলু খান, সিনেমাটোগ্রাফার সাদিক আহমেদ, এডিটর নবনীতা সেন এবং সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র। শেখ হাসিনার ৭১তম জন্মদিনে গত ২৮ সেপ্টেম্বর সিনেমাটির ট্রেইলার মুক্তি দেয়া হয়। আর চূড়ান্তভাবে এই ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট দীর্ঘ ছবিটি দেশব্যাপী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর।

পরিচালক পিপলু খানের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; Image Source:thedailystar.net

‘হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল’ শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জীবনের গল্প- তার বেড়ে ওঠা, তার নিজের জীবনের ওপর হামলা, তার অতীতের হাসিখুশি পারিবারিক সুখস্মৃতিচারণ আর সবার ওপরে তার বাবা বঙ্গবন্ধুর সাথে সম্পর্ক, তাকে হারানোর বেদনা- এক পিতৃহারা কন্যার বেড়ে ওঠার গল্প, নিজের দেশের হাল ধরবার কাহিনী। এ ছবিতেই একপর্যায়ে আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বলছেন, “We don’t believe in revenge, we believe in the philosophy of Bengali life- love, love and love.”,আমরা প্রতিশোধে বিশ্বাসী না, আমরা বিশ্বাস রাখি বাঙালির জীবনদর্শনে, আর সেটা হলো- ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা।” সেই পিতা-মাতার ভালোবাসা কন্যা হারিয়ে ফেলেন জীবনের নতুন এক অধ্যায় সূচনার প্রাক্কালে। সেই ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তোলা বাবা দেখে যেতে পারেননি, তার সেই মেয়েটি বিশ্বদরবারে আজ বাংলাদেশের নেতৃত্বদানকারী। ভালোবাসা হারিয়েই গিয়েছিল সেদিন থেকে।

♪ “পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসে না
এ পৃথিবী ভালোবাসিতে জানে না
যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি
সেথা যেতে প্রাণ চায় মা
সকলি ফুরায়ে যায় মা…” ♪

This article is in Bangla language and reviews the 2018 documentary film 'Hasina: A Daughter's Tale'. For references, please visit the hyperlinked websites.

Featured Image: CRI/Applebox Films

Related Articles