Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জটায়ুর বয়স বাড়লেও চলে, কিন্তু ফেলুদার বয়স বাড়লে চলে না: সব্যসাচী চক্রবর্তী

ঝাড়া প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার কন্যা রাশির জাতক তিনি। জন্ম ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতায়। ৬২ বছর বয়সী এই অভিনেতার বাবার নাম জগদীশ চন্দ্র চক্রবর্তী আর মা মনিকা চক্রবর্তী। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করা বিখ্যাত এই ব্যক্তি অভিনয় ছাড়াও জল-জঙ্গলের প্রতি মারাত্মক আসক্ত। বন্যপ্রাণীর ছবি তোলায় তার আগ্রহ একেবারে আকাশচুম্বী। ১৯৮৭ সালে দূরদর্শন চ্যানেলে প্রচারিত টেলিভিশন সিরিজ ‘তেরো পার্বণ’ এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে প্রথমবারের মতো সবার নজরে পড়েন তিনি। মঞ্চ নাটক থেকে শুরু করে টেলিভিশন আর সিনেমা জগৎ মাতিয়ে রাখা এই অভিনেতা বাংলা সাহিত্যের খুব জনপ্রিয় একটি গোয়েন্দা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছেন। ফেলুদার নাম শুনলে সৌমিত্র চ্যাটার্জির পর চোখ বন্ধ করে যার ছবি সবার আগে মানসপটে ভেসে ওঠে, বলা হচ্ছিলো সেই শক্তিমান অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তীর কথা।

২০১১ সালের বড়দিনে মুক্তি দেয়া হয় ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ চলচ্চিত্রটি। ফেলুদা হিসেবে এটিই ছিল সব্যসাচীর আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ সিনেমা। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ‘ডাবল ফেলুদা’ সিনেমায় ফেলুদার পঞ্চাশ বছর উদযাপন উপলক্ষে বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ আবারো ফেলুদার চরিত্রে অবতীর্ণ হন সব্যসাচী। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিকারী ‘ফেলুদা’ চরিত্রের রূপায়ণ করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেন তিনি। তার পরে কে ফেলুদা হতে পারে, তিনি নিজেই বা কেন ফেলুদা করছেন না সেসব সম্পর্কে খোলামেলাভাবে নিজের মতামত জানান এখানে। ফেলুদার কথাগুলো তবে শুনে আসা যাক সব্যসাচী চক্রবর্তীর মুখ থেকে।

সব্যসাচী চক্রবর্তী; Source: amazon.com

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: কেমন ছিল সত্যিকারের ফেলুদা হয়ে রূপালী পর্দার ফেলুদাকে চিত্রায়িত করার এই সুদীর্ঘ যাত্রাটি?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: আগেই বলে নিচ্ছি, আমি মোটেও সত্যিকারের ফেলুদা নই। রূপালী পর্দাতেই কেবল আমার উপস্থিতি চোখে পড়ে। আমার মতে, সত্যিকারের ফেলুদা হলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। ১৯৯৫ সালে ছোট পর্দায় ‘বাক্স রহস্য’ এর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই যাত্রাটি আমার জন্য খুবই আকর্ষণীয় ছিল। সন্দ্বীপ রায়ের ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ সিনেমাটি ফেলুদাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। আমি সবসময়ই ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করতে চাইতাম। সত্যজিৎ রায়ের কাছে নিজে গিয়ে বলেছিলাম, আমার স্বপ্নের এই চরিত্রটিতে একবারের জন্য হলেও যেন আমাকে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, “আমি আর ফেলুদা বানাব না, কারণ সন্তোষ দত্ত বেঁচে নেই”

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: শোনা যাচ্ছে এই সিনেমাটির সাথে সাথে ফেলুদা হিসেবে আপনার যাত্রা শেষ হতে যাচ্ছে…

সব্যসাচী চক্রবর্তী: (হেসে) ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ দেখার পর দর্শকের যদি মনে হয় ফেলুদা হিসেবে সব্যসাচী চক্রবর্তী খুব বেশি বুড়িয়ে যায়নি, তবে নিশ্চয়ই আমি খেলায় টিকে থাকব। দর্শকের কথা তো আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, তবে প্রযোজক এবং পরিচালকেরও অনুভব করতে হবে ফেলুদা চরিত্রটির প্রতি আমি কোনো অন্যায় করছি না। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, ফেলুদা চরিত্রটির জন্য আমি আসলে বুড়িয়ে গেছি। তাছাড়া আমার ছোটখাটো এই গোলুমলু ভুঁড়িটা কোনোভাবেই ফেলুদার সাথে যায় না। তবে দর্শক, পরিচালক, প্রযোজক যদি আবারও আমাকে ফেলুদারূপে দেখতে চান, তাহলে এই ভুঁড়ি কমাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। কষ্টকর কাজ হবে সেটা, জানি আমি, তবুও পারতেই হবে। কেন ভুঁড়ি কমাতে পারছি না বলতে গেলে ব্লেমিং গেম হয়ে যাবে, এর দোষ ওর ঘাড়ে চাপানোর মতো। ফেলুদা একজন আদর্শ, এই চরিত্রে অভিনয় করতে হলে অভিনেতাকে অবশ্যই তার মতো করে ভাবতে হবে, তার মতো করে বাঁচতে হবে। পরের ফেলুদার ব্যাপারে এখনই ভাবছি না। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পার? বিভুদা (বিভু ভট্টাচার্য) তো চলে গেলেন।

ফেলুদার শ্যুটিংয়ে সব্যসাচী; Source: amazon.com

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: আপনি কি মনে করেন ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হতে পারে?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: নিশ্চয়ই! আমাদের সবার প্রিয় লালমোহন বাবু ছিলেন তিনি, তার প্রতি এটুকু শ্রদ্ধা না দেখালে কী চলে? বিভুদা আমাকে প্রায়ই বলতেন, “আপনি ফেলুদা না করলে আমিও ফেলুদা করব না”। আর আমি তাকে বোঝাতাম, “লালমোহন বাবুর বয়স বাড়লেও চলে, কিন্তু ফেলুদার বয়স বাড়লে চলে না, দাদা”। কাজেই বিভুদা চলে যাওয়ার পর, আমারও উচিত ফেলুদা থেকে ছুটি নেয়া। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) নতুন একজন জটায়ু খুঁজে বের করার সময় এসে গেছে।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: তা তো বটেই। কিন্তু কে হতে পারে আগামী ফেলুদা? অনেকেই বলছেন আপনার বড় ছেলে গৌরবের সেই ক্ষমতা রয়েছে।

সব্যসাচী চক্রবর্তী: নিঃসন্দেহে গৌরবের ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করার প্রতিভা রয়েছে, কিন্তু উচ্চতাটা নেই। ও তো ছয় ফুট লম্বাও না। ফেলুদাকে অবশ্যই ছয় ফুটের বেশি লম্বা হতে হবে। তবে এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই, গৌরব ফেলুদা সম্পর্কে আমার চেয়েও ভালো জানে। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, তোতা রায়চৌধুরী, পরমব্রত চ্যাটার্জী কিংবা আবীর চ্যাটার্জী নয় কেন?

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: কিন্তু আবীর তো ইতোমধ্যে ব্যোমকেশের চরিত্রে অভিনয় করছে।

সব্যসাচী চক্রবর্তী: তো? আমিও কাকাবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেছি।

৫০ বছরে ফেলুদা; Source: amazon.com

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: প্রথমবারের মতো শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারে ফেলুদা প্রযোজিত হতে যাচ্ছে…

সব্যসাচী চক্রবর্তী: আমি খুব খুশি হয়েছি যে তারা ফেলুদা প্রযোজনায় উৎসাহী হয়েছে। তাদের সাথে কাজ করতে বেশ ভালো লেগেছে। একটা সময় ছিল, যখন সবার দোরে দোরে ঘুরেও ফেলুদার জন্য কোনো প্রযোজক পাইনি। আমি খালি বাবুদাকে বলতাম, চলুন বড় পর্দার জন্য ফেলুদা বানাই। কিন্তু কোনো প্রযোজনা সংস্থাই এমন একটি কাজে হাত দেয়ার সাহস করতে পারছিল না। কাজেই ১৯৯৯ সালে ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ সিনেমার জন্য প্রযোজক পাওয়ার পর আমি রীতিমতো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: এই এত বছরে ফেলুদার কী কোনো পরিবর্তন এসেছে?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের চরিত্রে তো কোনো পরিবর্তন আসেনি, তবে চরিত্রের উপস্থাপনে তো কম-বেশি পরিবর্তন অবশ্যই এসেছে। বাবুদা (সন্দ্বীপ রায়) সবসময় ফেলুদাকে একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। তার বাবা যেভাবে ফেলুদার ছবি এঁকে গেছেন, তিনিও সেই ধারাটি বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। বাবুদা খুব ভালো করে জানেন, ফেলুদা কখনো ল্যাপটপ ব্যবহার করবে না, গাড়ি কিনবে না, মুঠোফোন নিয়ে ঘুরবে না। ডেনিম-কোর্তা আর কোলাপুরি স্যান্ডেল পরেই জীবন কাটাবে সে (একবার অবশ্য ‘গোরস্তানে সাবধান’ সিনেমার জন্য উনি আমাকে স্লিপার পরার অনুমতি দিয়েছিলেন)। আরেকটি ব্যাপার খুব কঠোরভাবে মেনে চলেন বাবুদা, সেটা হলো ফেলুদা কখনো নড়বড়ে ভূমিকায় থাকতে পারে না। আমি যদি কোনো ছোটখাটো ভুল করে ফেলি সাথে সাথে তিনি বলেন, “ফেলুদা হোঁচট খায় না”। সে অংশটুকু কাট করে দিয়ে আবার ধারণ করতেন তিনি।

বড় পর্দায় ফেলুদারূপী সব্যসাচী; Source: amazon.com

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: ফেলুদার বৈশিষ্ট্যগুলো একটু ব্যাখ্যা করবেন কী?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: ফেলুদা সবসময় মেরুদণ্ড সোজা করে বসবে, পায়ের উপর পা আড়াআড়ি করে তুলবে, কথা বলার আগে সোজা চোখের দিকে তাকাবে। সে কখনো বলবে না “এটা আমাকে দিন”, বরং সে বলবে “এটা কি আমাকে দেয়া যায়?” ‘অবশ্য’ কথাটিকে সে ‘অবিশ্যি’ বলবে। প্রচুর চা পান করবে, সাথে থাকবে চানাচুর। কড়া পাকের সন্দেশ, খয়ের ছাড়া মিষ্টি পান খুব পছন্দ তার। ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে জানে। আর তিনটি ভাষায় ভীষণ রকমের পারদর্শী সে- বাংলা, হিন্দি আর ইংরেজি।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: দু’ধরনের গোয়েন্দা গল্প আছে। একধরনের গল্পে আপনি আগে থেকেই জানেন খলনায়ক কে আর গোয়েন্দা তাকে কীভাবে কুপোকাত করবে। আরেক রকম গল্পে শেষ দৃশ্যের আগপর্যন্ত বোঝাই যায় না আসল অপরাধী কে। কোন ফরম্যাটটি আপনার বেশি পছন্দ?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: থ্রিলার ফরম্যাটটাই আমার বেশি ভালো লাগে। বড় পর্দায় জমজমাট গল্প না হলে দর্শক ধরে রাখা মুশকিল। ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ গল্পে অবশ্য এমন কোনো খলনায়ক নেই।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: আপনারা কী সত্যিকারের বাঘ নিয়ে কাজ করেছেন নাকি ডিজিটাল বাঘ দিয়েই ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ সিনেমার কাজ চালিয়েছেন?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: সিনেমাটিতে দর্শক সত্যিকারের বাঘের দেখা পাবেন।

সব্যসাচী ও তার পরিবারের সদস্যরা; Source: youtube.com

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: কথিত আছে, ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ সিনেমাটির শ্যুটিংয়ে জঙ্গলে আপনি গাইডের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর বন্যপ্রাণীর ছবি তোলার প্রতি আপনার নেশার কথা তো সবাই জানে। জঙ্গল সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের কথাও তো বেশ প্রচলিত।

সব্যসাচী চক্রবর্তী: (হেসে) ফেলুদার যেকোনো সিনেমার শ্যুটিংই আমি খুব উপভোগ করি। তবে ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ আমার প্রিয় একটি সিনেমা। কিছুদিন আগেও জাতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি আমি। কাজেই ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্য অনুমতি আনতে সাহায্য করেছিলাম। জঙ্গলে শ্যুটিং করার সময় অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, বেগতিক কিছু দেখলেই শ্যুটিং বাতিল হবার সম্ভাবনা ছিল। বন্যপ্রাণীর আক্রমণের ঝুঁকি থাকায় জঙ্গলে কাজ করার সময় সাথে কয়েকজন সশস্ত্র প্রহরী রাখার পরামর্শ দেয় তারা। কাজের সময় একদল বুনো হাতির পাল্লায় পড়ি আমরা, তবে প্রহরীরা সেসব সামলে নিয়েছে।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: ছোট পর্দা, বড় পর্দা, থিয়েটার, রেডিও সব জায়গাতেই তো ফেলুদাকে উপস্থাপন করলেন। আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ কোনটি?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: বড় পর্দার ফেলুদা আমার খুব পছন্দের। তবে মঞ্চ সবসময়ই আমার প্রথম ভালোবাসা।

সত্যজিতের ঘুরঘুটিয়ার ঘটনায় সব্যসাচী; Source: youtube.com

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: শ্যুটিং শুরু করার আগে ফেলুদার কোনো বই পড়া হয়?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: চিত্রনাট্য হাতে পাওয়ার পরপরই বই নিয়ে বসে যাই। বইয়ের উপরই বেশি মনোযোগ দেই আমি।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া: এখনো পর্যন্ত আপনার দেখা সেরা ফেলুদা ভক্ত কে?

সব্যসাচী চক্রবর্তী: আমার ঔরস থেকে জন্ম নেয়া দুই মহান ব্যক্তি- গৌরব আর অর্জুন!

ফিচার ইমেজ- youtube.com

Related Articles