Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মধ্যযুগের জ্ঞানসাধনার অনন্য এক নক্ষত্র ইবনে খালদুন: অমর কীর্তি যার আল মুকাদ্দিমাহ

হবস, লক ও রুশো তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না; এবং এ সকল নাম তাঁর নামের সাথে উচ্চারণ করার জন্যও উপযুক্ত নয়।

তাঁর স্বতন্ত্র চিন্তা ও মৌলিক অবদানের কথা বিবেচনা করে রবার্ট ফ্লিন্ট এই অভিমত ব্যক্ত করেন। ইতিহাস বিজ্ঞানে তাঁর স্থান নির্ধারণে প্রখ্যাত আরব গবেষক পি. কে. হিট্টির এ মন্তব্য স্মরণ করা যায়,

কোনো আরব লেখক, এমনকি কোনো ইউরোপিয়ানও ইতিহাসচর্চাকে এত সর্বাত্মক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ করে তুলতে পারেননি।

লোকটির নাম ওয়ালি উদ্দিন আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর মুহাম্মাদ আল-হাসান ইবনে খালদুন, যিনি ইবনে খালদুন নামেই সমধিক পরিচিত। ইতিহাসশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্রে যার অবদান ভুলবার নয়। ইতিহাসচর্চাকে যিনি অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, সেই মহান জ্ঞানসাধককে নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন।

দুই পর্বের সিরিজের প্রথম এই পর্বটিতে আমরা ইবনে খালদুনের সংক্ষিপ্ত জীবনী জানব। সাথে থাকবে তাঁর মুকাদ্দিমাহ, যে সৃষ্টিকর্মে তিনি বেঁচে থাকবেন হাজার বছর ধরে। আর দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখব তাঁর আরেক বিখ্যাত তত্ত্ব আসাবিয়াত বা আসাবিয়াহ কী। চলুন প্রিয় পাঠক, শুরু করা যাক!

flint
Robert Flint: Source: Art UK / University of Edinburgh

 

ইবনে খালদুন ১৩৩২ সালে তিউনিসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ মুসলিম স্পেন (আন্দালুস) থেকে হিজরি সপ্তম শতকের মাঝামাঝি আফ্রিকায় অভিবাসিত হয়। তাঁর পরিবার মূলত হাজরামাউতের ইয়ামেনি আরব বংশোদ্ভূত। তবে তিনি নিজেকে একজন আরব হিসেবে পরিচয় দেন না। তিনি তাঁর বিখ্যাত পুস্তক কিতাব আল ইবার এর শেষ খণ্ডের কিছু অংশে তাঁর জীবন ও কর্ম সম্বন্ধে আলোকপাত করেছেন। তাঁর বাবাও ধর্মতত্ত্ব, আইন ও কবিতায় বিজ্ঞ ছিলেন। ১৩৪৯ সালের ব্ল্যাক ডেথ তাঁর বাবা-মা দুজনকেই কেড়ে নেয়।  

cordoba
কর্ডোবার গ্রেট মসজিদের ভিতরের অংশ, মুসলিম স্পেন, আন্দালুস; Source: Britannica

 

ইবনে খালদুন ১৩৬২ সালে গ্রানাডার সুলতান পঞ্চম মোহাম্মদের অধীনে সরকারি কাজে যোগদান করেন। তিনি স্পেনের ক্যাস্টিলিয়ান রাজা পিটার (১৩৫০-১৩৬৯ খ্রি.) এর দরবারে প্রেরিত শান্তি মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দু’বছর পর তার এক ক্ষমতাধর বন্ধু আল খতিবের ঈর্ষার রোষানলে পড়ে তিনি মাগরিব বা উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় চলে আসেন। এখানে তিনি বহু উচ্চ পদ অলংকৃত করেন। পরিশেষে তিনি উত্তর আলজেরিয়ার তাভঘখুট নামক শহরে চলে আসেন। এখানে তিনি ১৩৭৮ খ্রি. পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং ইতিহাস লিখনে আত্মনিয়োগ করেন।

১৩৮২ ইবনে খালদুন তিনি হজ্জব্রত পালনে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তিনি কায়রোতে যাত্রাবিরতি নেন এবং আল আযহার মসজিদে বক্তৃতা প্রদান করেন। দু’বছর পর মামলুক সুলতান আল জহির বারকুক (১৩৮২-৯০ খ্রি.) তাঁকে কায়রোর প্রধান মালিকীয় কাজি হিসেবে নিযুক্ত করে। ১৪০১ সালে তিনি সুলতান বারকুকের উত্তরাধিকারী আন-নাসির ফারাজের তৈমুর লং (১৩৬৬-১৪০৪ খ্রি.) বিরোধী অভিযানের সঙ্গী হয়ে দামাস্কাসে আসেন। তৈমুর লং এখানে তাকে একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ১৪০৬ সালে মিশরের কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর ইবনে রুশদের কিছু বইয়ের সারমর্মও তিনি লিখেছিলেন। 

timur
তৈমুর লং; Source: War History Online

 

উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইবনে খালদুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসব অভিজ্ঞতাই তাকে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল ইবার ওয়া দিওয়ান আল মুবতাদা ওয়া আল খবর ফি আয়্যাম আল আজম ওয়া আল বার্বার (Book of instructive examples and register of subject and predicate dealing with the history of the Arabs, Persians and Berbers) সংক্ষেপে কিতাব আল ইবার রচনা করতে মালমশলার যোগান দিয়েছে। এ গ্রন্থটি মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত: 

  1. মুকাদ্দিমাহ (Muqaddimah–Prolegomena) অর্থাৎ ভূমিকা অংশ
  2. আরব ও পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠী, যেমন- ব্যবিলনীয়, নাবাতিয়ান, কপটস, ইসরাইলি, ইহুদি, পারসিক, গ্রিক, রোমান, গথ, তুর্কি, ফ্রাঙ্ক প্রভৃতির বর্ণনা এবং ইসলামের প্রাথমিক রাজবংশ অর্থাৎ উমাইয়া ও আব্বাসিদের বর্ণনা সংবলিত মূল অংশ এবং
  3. শেষভাগ বার্বার ও উত্তর-আফ্রিকার মুসলিম রাজবংশের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট

এগুলো সাত খণ্ডে ১২৮৪ হিজরিতে কায়রো থেকে প্রকাশিত হয়। মুকাদ্দিমা অংশে যে সূক্ষ্ম সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে অন্যান্য অংশে তার প্রতিফলন ঘটেনি। এতদসত্ত্বেও আরব ও মাগরিবের বার্বার জনগোষ্ঠীসংক্রান্ত বিষয়বস্তু সর্বদাই অমূল্য পথনির্দেশক তথ্যের উৎস হিসেবে পরিগণিত। পঞ্চম খণ্ডে ইবনে খালদুন তাতার, চেঙ্গিস খান ও তার পুত্রদের এবং ১৩৯৫ এ তৈমুর লং এর প্রাথমিক অভিযানসমূহের বর্ণনা দিয়েছেন। এ পুস্তকের শেষ অধ্যায়ে অর্থাৎ আত্মজীবনীমূলক পর্বে ১৪০১ পর্যন্ত তৈমুরের জীবনবৃত্তান্ত ও কার্যাবলির ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে। ইতিহাসের প্রাথমিক উত্স হিসেবে এসব তথ্য অত্যন্ত মূল্যবান।

genghis khan
চেঙ্গিস খান; Source: Britannaica 

 

ডি বোয়েরের মতে,

ইবনে খালদুন নতুন দার্শনিক পথ নিয়ে উপস্থিত হন, যে সম্বন্ধে এরিস্টটলেরও কোনো ধারণা ছিল না।

আর মার্গোলিয়থের বিবেচনায় ইবনে খালদুন এরিস্টটলের ন্যায় আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেননি। তাঁর মতে,

ইবনে খালদুনের মাধ্যমে মানব বিষয়াবলি প্রাকৃতিক গতি অনুসরণ করে এবং পর্যায়ক্রমে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি ঘটে।

বস্তুত ইবনে খালদুনের স্বতন্ত্র চিন্তনের বিকাশে তাঁর পূর্বসূরি আত-তাবারি (৮৩৩-৯২৩ খ্রি.) ও আল মাসুদির (মৃ. ৯৫৭ খ্রি.) অগাধ প্রভাব ছিল। তিনি অনারব জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত তথ্য ও তার সামাজিক-দার্শনিক মতাদর্শ গঠনে আত-তাবারি থেকে পর্যাপ্ত উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।

tabari
আত-তাবারি; Source: Wikimedia Commons

অন্যদিকে ইতিহাস লিখনে আল-মাসুদি অবলম্বন করা সমাজ ও মানবজীবনের সামাজিক উপাদান সমূহের ব্যবহারের পদ্ধতি পুরোমাত্রায় বিকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি ইতিহাস অধ্যয়নকে বিশ্লেষণাত্মক ও বিজ্ঞানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছান। এটাই মূলত ইতিহাসকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দান করেছে। ফলে ইতিহাস এখন আর ঘটনাসমূহের ক্যাটালগ বা পূর্বে সংঘটিত বিষয়াবলির তালিকা বা বর্ণনামাত্র নয়, বরং একটি বিজ্ঞান যাকে দেশ ও জাতির উত্থান-পতনের কারণ জানার জন্য অধ্যয়ন করতে হয়।

ইবনে মিশকাওয়াইহর (মৃ. ১০৩৭ খ্রি.) ন্যায় ইবনে খালদুন তার ইতিহাসতত্ত্বে সনাতনী ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পরস্পর-বিরোধী দুটো অস্তিত্বের স্তরকে বিবেচনায় নিয়েছেন; অতিপ্রাকৃত বা ঈশ্বরীয় এবং মানবীয়, এ দুটোই তাঁর মতে স্বতন্ত্র। মানব ইতিহাস চক্রাকারে ঘুরে মানবীয় বস্তুবাদী চাহিদার মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই চক্ৰায়ণ প্রায়শই, তবে অনিয়মিতভাবে, স্বেচ্ছাচারী অথচ শক্তিশালী অতিপ্রাকৃত শক্তির হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্থ হয়। ইতিহাসের এ দর্শন তার কিতাব আল ইবারে অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রস্ফূটিত হয়েছে।

ইবনে খালদুনের সুনাম ও গৌরব মূলত তার মুকাদ্দিমাহকে কেন্দ্র করে। গ্রন্থটি এফ. রজেন্থাল কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এ. জে. টয়েনবির মতে,

আল-মুকাদ্দিমাহ সর্বজনের, ও সর্বকালের লিখিত এ ধরনের কাজের মধ্যে সর্বোত্তম শ্রেণীর।

আর জর্জ সার্টনের দৃষ্টিতে,

আল-মুকাদ্দিমাহ, মধ্যযুগের চিন্তন জগতের মহত্তম ও সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় নিদর্শন।

মুকাদ্দিমাহকে বলা হয় একমাত্র আরবি পুস্তক যা ঐতিহাসিক জ্ঞান ও মানবীয় সামাজিক দল বিষয়ক লেখনী। তবে একথা সত্য নয়, কেননা ইতোপূর্বে আল ইজি (মৃ. ১৩৮২ খ্রি.) তাঁর তুহফা এবং পরে আল-কাফিজি (মৃ. ১৪৭৪ খ্রি.) আল মুখতাসার ফি আল ইলম ও আল সাকাভি আল-ইলান নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন।

ইবনে খালদুন মনে করতেন, ইতিহাস লেখার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য ও বিভিন্নমুখী প্রতিভার প্রয়োজন। তাঁর মতে, ঐতিহাসিককে সত্য উদঘাটনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং ভ্রম বা বিচ্যুতি যাতে না ঘটে তজ্জন্য সতর্ক থাকতে হবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ঐতিহাসিককে কখনও অসন্দিগ্ধ চিত্তের হলে চলবে না। যেকোনো তথ্য তাঁর কাছে পৌঁছালে তা বিনা মূল্যায়নে গ্রহণ করা উচিত হবে না। ইবনে খালদুনকে তাঁর যুগের অপর্যাপ্ত স্বল্প ইতিহাস-উৎস নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এজন্যই চার্লস ইসাবি বলেন,

তাঁর মতবাদসমূহের অধিকাংশ দুর্বলতার কারণ হলো তার যুগের অপ্রতুল ও অবিশ্বস্ত তথ্য।

ইতিহাস বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আকারে আমরা দ্বিতীয় পর্বে জানব। আরও জানব আসবিয়াহ সম্পর্কেও!

The Muqaddimah – An Introduction to History বইটি কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে।

This is a bengali article discussing about Ibn Khaldun and Al Muqaddimah.

References:

1. S. Margoliouth, Lectures On Arabic Historions, Calcutta, 1930

2. De Boer, The History of Philosophy in Islam, 1903

3. Franz Rosenthal, The Influence of the Biblical Tradition on Muslim Historiography - Historians of the Middle East, (ed) B. Lewis & P. M. Holt, London, 1962

4. Toynbee, A Study of History, London, 1934

5. George Sarton, Introduction to the History of Science, Baltimore, 1948

6. A. Enan, Life and Works of Ibn Khaldun, Rosenthal, A History of Muslim Historiography

7. K. Hitti, History of the Arabs, 10th ed. Macmillan, 1979

8. Rosenthal, Muqaddimah, Routledge and Kegan Paul, 1958

9. M. Sharif, A History of Muslim Philosophy, Wiesbaden, 1966

10. Khuda Bakhsh, Contribution to the History of Islamic Civilization, Calcutta, 1930

11. Buddha Prakash, Ibn Khaldun's Philosophy of History - Islamic Culture, January, 1954

12. Charlse Issawi, An Arab Philosophy of History, London, 1950

13. J. Fischel, Ibn Khaldun on the Bible - Judaism and the Jews, Ignace Goldziher Memorial, Jerusalem, 1956

14. Richter Gustav, Medieval Arabic Historiography - Islamic Culture, 1959

15. A. Nicholson, A Literary History of the Arabs, London, 1923

16. A. Enan, Life and Work of Ibn Khaldun K. Sherwani, A Study in Muslim Political Thought and Administration, Lahore, 1945

 

Related Articles