সায়মন পেশায় প্রত্নতত্ত্ববিদ। সে রোম থেকে ইতালিতে এসেছে এক রহস্যের অনুসন্ধানে। আজ প্রথমবার নয়। হাজার হাজার বছর ধরে সে আসছে। এক ইন্দ্রজালে মোড়া তার জীবন। এই সায়মন আর তার জীবনের ইন্দ্রজাল নিয়ে এই বইয়ের সিরিজ। দ্বিতীয় বই য়ে শেষে লেখা আছে অসমাপ্ত; এর মানে সায়মনের ইন্দ্রজালের রহস্য আজও অভেদ্য। 'ইন্দ্রজাল' আর 'ইন্দ্রজাল ২' নিয়ে আপাতত আমাদের বর্তমান থেকে অতীতের যাত্রা শুরু হোক।
অতিরিক্ত কৌতূহল কিন্তু ভাল কিছু না। সময়টা ১৮১২ সাল। চিত্রশিল্পী এবং বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ তরুণ সায়মন। নিজে কিছু আবিষ্কার করা, কৃতিত্ব নিজে নেয়ার জন্য দলবল ফেলে একাই চলে এসেছে গ্রিসে। লক্ষ্য- হাজার হাজার বছরের পুরোনো কাভালো মন্দির। সেই মন্দির দেখা-শোনা করে একদল প্যাগান পুরোহিত। শোনা যায়, সেই মন্দিরের তলায় আছে বহু প্রাচীন প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শন। অনেকে অনেকবার দলবলে কিংবা একা গিয়েছে সেখানে। কিন্তু কেউ পুরোহিতদের মন গলাতে পারেনি।
প্রতিবারের মতো এবারও ছোট্ট এক কুটিরে আশ্রয় নিল সে। তিন হাজার বছরের বেশি পুরোনো সেই মন্দিরের রহস্য খুঁজতে বের হয়ে পড়ল। মন্দির পেলেও অনুমতি সে পেল না গুপ্তকক্ষে যাবার। কিন্তু নাছোড়বান্দা সায়মন। খুব গোপনে সে হাজির হলো মন্দিরের তলায়। কিছু দুর্বোধ্য সংকেত, কিছু বিচ্ছিন্ন শব্দ আর এক দরজা খুঁজে পেল। বাক্সবন্দী এক রহস্যময় দরজা। ১০ ফুট উচ্চতা ও ৪ ফুট প্রস্থের সেই দরজা সুন্দর এক বাক্সে বন্দী, সাথে চাবিও আছে। মিশরের মানুষ মমি বাক্স বন্দী করে রাখত। কিন্তু এখানে বাক্সে বন্দী দরজা?
মন্দিরের পাতালদেশ থেকে সেই বাক্সবন্দী দরজা, সাথে কিছু টুকরো টুকরো শব্দ নিয়ে নিজের কুটিরে ফিরল সায়মন। মেধাবী এবং বলবান সে, নাহলে এত বড় ভারী বাক্স কেউ নিতে পারে? সেই রহস্যময় দরজার অমোঘটান। একদিন সে আবিষ্কার করে বসল সেই দরজার পেছনের ইতিহাস।
দেবতা জিউসের কন্যা, ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি কিংবা ভেনাস। সে প্রেমে পড়ে এক মানুষের। এডোনাইস নামের সেই জন্তু শিকারী প্রথমে পাত্তা না দিলেও একসময় দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেলে।
মানুষ মরণশীল। সেই হিসেবে শিকারী এডোনাইস একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার মৃত্যুর পরে আফ্রোদিতি ভেঙে পড়েন। দেবতা জিউস কন্যার জন্মদিনে তাকে এক দরজা উপহার দেন, যা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেত অতীতে। প্রতি পূর্ণিমা রাতে এই দরজা দিয়ে অতীতে ফিরে যেতেন তিনি। মিলিত হতেন প্রেমিকের সাথে। সবকিছু স্বামী হেফাস্টাস জানতে পেরে শাশুড়ি হেরাকে জানান। অভিশপ্ত হয়ে অতীতে আটকে যান প্রেমের এই সুন্দরী দেবী।
এরপরে নানা অভিশাপ, কান্না, কঠোর শাস্তি পার হয়ে অতীত থেকে একসময় নিজের সময়ে ফিরে আসেন। এরপরে সেই দরজা খুব গোপনে লুকিয়ে রাখা হয় কোনো এক মন্দিরের তলদেশে। কিন্তু এগুলো তো উপকথা। সেই দরজা আর এই দরজা কি এক হতে পারে?
এরই মধ্যে সে একটা কংকাল খুঁজে পেল। ১,৫০০ বছর আগে সেই কংকাল। কংকাল আর সেই দরজা বয়ে নিয়ে ফিরবে নিজের দেশে। তাই জাহাজের টিকেট কেটে এলো। কিন্তু রাতে ঘুম ভেঙে শোনা অদ্ভুত মায়াবী কন্ঠস্বর আর দরজা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক রাতে সায়মন সেই দরজা খুলে পৌঁছে গেল রোমে। কিন্তু না, সেটা আজকের রোম না; শত শত বছর আগের রোম। যখন শাসন চলছিল জুলিয়াস সিজারের।
এভাবে আজ প্রথমবারের মতো যায়নি সায়মন। শত শত বছর ধরে চলছে এই ঘটনা। কখনও সেই দরজা বয়ে নিয়ে এসেছে তার কুটিরে, কখনও সেই মন্দিরের তলা থেকেই চলে গেছে অতীতে। রোমে গিয়ে সে বার বার পেয়েছে জুলিয়াস সিজার, অক্টাভিয়ান, অক্টাভিয়া, আটিয়া, ব্রুটাসের দেখা। বার বার ছবি এঁকেছে রাজপ্রাসাদের অন্দর মহলের। কতবার নিজের অতীতে আঁকা ছবি দেখে নিজেই চমকে উঠেছে। তার আত্মা জানে, সে সময়ের জালে বন্দী। সে চাইছে বের হতে, কিন্তু পারছে না।
প্রতিবার ইসাবেলা নামে এক নারী তার জীবনে আসে। সুদখোর টোবাইসের কাছ থেকে ইসাবেলা আর তার বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে ইসাবেলার সাথে পরিচয়। কোনোবার সায়মন অসহায় মেয়েটির বাবাকে বাঁচাতে পারেনি। ইসাবেলার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও সে অগ্রাহ্য করে গেছে সেটি। এদিকে চিত্রবিক্রেতা রুফাসের সাথে সায়মনের খাতিরও প্রতিবার খুব ভাল হয়। এই রুফাসের জন্য সে প্রাচীন রোমে জীবিকা নির্বাহের উপায় খুঁজে পায়।
সায়মন নিজে কখনও ফাঁসির আসামী হয়েছে , জুলিয়াস সিজারকে অনেকবার সাবধানও সে করেছে। কিন্তু নিয়তি। সে চাইলেও পারেনি ইতিহাসকে বদলে দিতে। ক্রন্দনরত ইসাবেলাকে ভালবাসলেও এড়িয়ে গিয়েছে। সায়মন কি পারবে ইসাবেলাকে ভালবাসতে, নাকি মেয়েটা একা একা কেঁদে যাবে মানে-অভিমানে?
আফ্রোদিতি বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছেন সায়মনকে, যাতে সে একই ভুল বারবার না করে। কিন্তু সায়মন কি সাড়া দিয়েছিল? সে কি দেবীর ইঙ্গিত আজও বুঝতে পারেনি? হাজার বছরের পুরোনো আত্মা সে বয়ে চলেছে, সে বয়ে চলেছে এক অভিশাপ। কী তার শেষ পরিণতি? বারবার ফিরে আসা, আর নিজের তীরবিদ্ধ কংকাল খুঁজে পাওয়া? নাকি অন্য কিছু?
এখনও এই বইয়ের কাহিনী অসমাপ্ত। পৃথিবী সুস্থ হলে আশা করি খুব দ্রুত এই রহস্য উন্মোচিত হবে।
লেখিকা জিমি তানহাব-এর লেখার সাথে পরিচয় 'রক্ততৃষ্ণা' বইটি দিয়ে; সেই বইও অদ্ভুত রহস্যের খনি। প্রথমে বইগুলো পড়লে বিদেশি গল্পের অনুকরণে লেখা বলে মনে হবে। বাংলায় এত বিশ্লেষণধর্মী রহস্য, থ্রিলার উপন্যাস খুব কমই রয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী জিমি তানহাবের ফোর্থ সেঞ্চুরি বইগুলো গত বছর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। লেখিকার কাছে এ ধরনের লেখার প্রত্যাশা থাকবে সামনের দিনগুলোতেও।
সময়ের অভাবে বই পড়া হয় না আর আগের মতো। বাসা থেকে অফিস করার ফাঁকে দুটো বই দুদিনে শেষ করে মনে হচ্ছে এরপরের খণ্ড কবে পড়ব। সায়মন আর ইসাবেলার মিলন কি হবে? সায়মন কি ইন্দ্রজাল থেকে বের হতে পেরেছিল? সেটা জানতে যে বড্ড ইচ্ছে করছে!
This is a bengali article that gives review on the 'Indrajal' book series.
Feature Image: তাসফিয়া প্রমি