এ বছরের স্টপ মোশন অ্যানিমেটেড ফিল্ম আইল অফ ডগসকে ভালো না বেসে পারা যায় না। ওয়েস অ্যান্ডারসনের আগের নয়টি কাজের মতো এখানেও চরিত্রপ্রধান কমেডি গল্প, উজ্জ্বল দৃশ্যায়ন আর ডেডপ্যান হিউমারের মধ্য দিয়ে মানুষের নিষ্ঠুর মনোবৃত্তিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শিশুতোষ উপস্থাপন হলেও কাহিনীর একটু গভীরে গেলে বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ আর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রুপটা ভালোমতোই টের পাওয়া যায়।
কাহিনী শুরু হয় এখনকার বিশ বছর পরে জাপানের এক কল্পিত ডিস্টোপিয়ান শহর মেগাসাকিতে। কুকুরদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এক বিশেষ সংক্রামক ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ। মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধুদের এই বিপদে বেশিরভাগ মানুষকেই তেমন কিছু করতে দেখা যায় না। অবশ্য সবাই না, বিজ্ঞানী ওয়াতানাবি নিজে এর প্রতিষেধক বানানোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু কিটেন পার্টির সদস্য মেয়র কোবায়েশি আগে থেকেই কুকুরবিদ্বেষী। ফলে নতুন আইন জারি করে শহরের সকল কুকুরকে ধুঁকে ধুঁকে মরার জন্য আবর্জনায় ভর্তি ট্র্যাশ আইল্যান্ডে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অ্যান্টি-ডগ ক্যাম্পেইনের নামে এ অবিচারের প্রথম শিকার হয় মেয়রের ভাগ্নে আতারি কোবায়েশির বডিগার্ড কুকুর স্পট।
ক্রমাগত হাঁচি দিতে থাকা কুকুরগুলো অসহায়ভাবে জীবন কাটাতে থাকে সেখানে। আবর্জনার স্তুপে খাবার কিংবা পানি নিয়ে বিবাদ চলতে থাকে নিরন্তর। বাড়ির পোষা কুকুর আর রাস্তার তথাকথিত অসভ্য কুকুরদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়। ঘটনার ছয় মাস পরে ১২ বছর বয়সী আতারি একটি বাষ্পচালিত প্লেন চুরি করে একা একাই দুর্গম দ্বীপটায় চলে যায়। দ্বীপের অন্য কুকুরেরা স্পটকে খুঁজতে আতারিকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অবশ্য মানুষদের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়া কুকুর চিফ এ ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ দেখায় না। দ্বীপে আরো আছে সার্কাসে নানা কসরৎ দেখানো রহস্যময়ী মুকুর নাটমেগ আর স্বমাংসভোজী কুকুরের দল।
মুভির প্রধান কুকুর পাঁচটি- চিফ, রেক্স, ডিউক, বস আর কিং। মিলিটারি প্যারালালে এদের প্রত্যেকের নামের অর্থই নেতা। মুভির প্রধান আকর্ষণ এই কুকুরদের মুখে প্রিয় অভিনেতাদের কন্ঠ শুনতে পাওয়া। ব্রায়ান ক্র্যানস্টন, এডওয়ার্ড নর্টন, জেফ গোল্ডবাম, বিল মারে আর বব বালাবানদেরকে একসাথে কথা চালাচালি করতে দিয়েই ওয়েস অ্যান্ডারসন ক্ষান্ত হননি। তার সাথে যোগ করেছেন নাটমেগের কণ্ঠে স্কারলেট জোহানসন আর স্পটের কণ্ঠে লিভ শ্রাইবারকে। কণ্ঠদাতাদের মধ্যে আছেন চারজন অস্কারজয়ী- এফ মুর আব্রাহাম, ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড, টিলডা সুইনটন এবং ফিশার স্টিভেনস। আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন এমন আছেন সাত জন- গ্রেটা গারউইগ, এডওয়ার্ড নর্টন, বিল মারে, জেফ গোল্ডবাম, হারভে কেইটেল, ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড আর বব বালাবান।
মুভির রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। দূষিত বসবাসের অযোগ্য ট্র্যাশ আইল্যান্ড মুভির প্রধান সেটআপ। পরিবেশ দূষণ তুলে ধরার পাশাপাশি একে রূপক অর্থে বসবাসের অযোগ্য তৃতীয় বিশ্বও ধরে নেয়া যায়, যেখানে ক্ষমতাহীনেরা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। মিথ্যা অভিযোগ করে ইমিগ্রান্টদের বিরুদ্ধে জেনোফোবিয়া সৃষ্টি করার কাহিনীটাও এসেছে সরাসরি।
মুভির একটি অনন্য দিক ছিল জাপানি ভাষার ব্যবহার। শুরুতেই একটি সাইন দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় যে কুকুরদের কথা ছাড়া আর কোনো কিছুই ইংরেজিতে অনুবাদ করা হবে না। ঠিক সেই কারণেই আতারি, কোবায়েশি কিংবা অন্য কোনো চরিত্রের সংলাপই ইংরেজি সাবটাইটেল ব্যবহার করা হয়নি, তবে কিছু অংশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুবাদ করে দেয়া হছে। কুকুরদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মানুষদের কথাবার্তা কেমন অপরিচিত শোনায়, তা দর্শককে বোঝানোর জন্য এটা ছিল একটা দারুণ প্লট ডিভাইস।
কাহিনী এগোনোর জন্য জাপানি সংলাপগুলোর বিপরীতে কুকুরদের ইংরেজিতে বলা সংলাপগুলোই ছিল যথেষ্ট। তবে এই প্লট ডিভাইসটি অবশ্য জাপানী ভাষীদের ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে দেবে না। আরো একটা খটকা আছে, ফরেন এক্সচেঞ্জ ছাত্রী ট্রেসি ওয়াকার জাপানী স্কুলে পড়লেও ইংরেজিতে কথোপকথন চালিয়ে গেছে। সেটা কাহিনীর প্রয়োজনেই হোক বা অন্য কোনো কারণে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে ঐতিহ্যবাহী জাপানী সংস্কৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। পাখির চোখে দেখানো জাপানী বাবুর্চির হাতে জ্যান্ত মাছ কিংবা অক্টোপাসকে দক্ষ হাতে কেটেকুটে রান্না করা মুভির অন্যতম একটি সেরা দৃশ্য। ২০১১ সালের সুমো কুস্তির ম্যাচ ফিক্সিং স্ক্যান্ডাল রেফারেন্সও দেয়া হয়েছে।
ওয়েস অ্যান্ডারসনের এর আগের স্টপ মোশন মুভি ফ্যান্টাস্টিক মিস্টার ফক্স। তরুণ বয়সে পরিচালনা শুরু করলেও তার প্রথম চলচ্চিত্র বটল রকেট থেকেই নিজের কিছু সিগনেচার স্টাইল ফুটিয়ে তুলতে কখনো দ্বিধা করেননি। দৃষ্টিনন্দন বর্ণিল সিনেমাটোগ্রাফি, সময়োপযোগী মিউজিক আর বুদ্ধিদীপ্ত স্টোরিটেলিং তার বৈশিষ্ট্য। অনেকে মজা করে বলে থাকেন, ওয়েস অ্যান্ডারসনের কালার গ্রেডিং দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এখনকার ইন্সটাগ্রামের ফিল্টারগুলো জনপ্রিয় হয়েছে! নিরাবেগ ডায়লগ ডেলিভারি কিন্তু ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট কিংবা ফ্যামিলি মোমেন্টের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল, মুনরাইজ কিংডম, রাশমোর, দ্য রয়্যাল টেনেনবামস, দ্য লাইফ অ্যাকুয়াটিক উইথ স্টিভ জিসৌ মুভিগুলো দেখে থাকলে ওয়েস অ্যান্ডারসনের ভিন্ন ধাঁচের নির্মাণ আর ডেডপ্যান হিউমারের সাথে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না।
এই মুভির জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে অ্যান্ডারসন উল্লেখ করেছেন র্যাংকিন/ব্যাস কোম্পানির বিভিন্ন স্টপ মোশন মুভি আর কালজয়ী পরিচালক আকিয়া কুরোসাওয়ার বিভিন্ন কাজকে। আলাদা করে কোনো কিছুর কথা উল্লেখ না করলেও কুরোসাওয়াপ্রেমীরা এক দেখাতেই বিভিন্ন রেফারেন্স বেশ সহজেই ধরে ফেলতে পারবে। প্রথমেই আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানে এক হোমিসাইড ডিটেকটিভের অভিযান আর যুদ্ধাহত এবং যুদ্ধজয়ীদের শ্রেণীবিভাজন নিয়ে নির্মিত স্ট্রে ডগের কথা। আইল অফ ডগসেও দ্বীপের কুকুরগুলো বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদিকে অকালেই বাবা-মাকে হারানো আতারি একসময় মেয়র কোবায়েশির উদ্দেশ্যে বলে,
You took me in, like a stray dog.
কুরোসাওয়ার আরেক ঐতিহাসিক কীর্তি সেভেন সামুরাইয়ের সাথে প্রায় ফ্রেম বাই ফ্রেম মিলে যায় দ্বীপে কুকুরদের দুইপক্ষের বিবাদের দৃশ্য। নান্দনিক ওয়াইড শট আর যুদ্ধের আগে সবাই মুখে ক্লোজআপ শট নেয়া সবকিছুই ছিল এর মধ্যে। নিষ্ঠুর শাসক মেয়র কোবায়েশির সাথে চারিত্রিক উপস্থাপনের দিক দিয়ে অনেকটাই মিল পাওয়া যায় কুরোসাওয়া ১৯৬৩ সালের কর্পোরেট থ্রিলার হাই এন্ড লো এর ভিলেন কিংগো গন্ডোর। আবার শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কুরোসাওয়ার রান চলচ্চিত্রটির সাথে কালার গ্রেডিং এর ভালোই মিল আছে আইল অফ ডগস এর।
কুকুরদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নেওয়া শটগুলোর কোথাও লাল কিংবা সবুজ রঙ ছিল না, কারণ কুকুরেরা বর্ণান্ধ, তারা এ দুটো রঙের কোনোটাই দেখতে পায় না। আইল অফ ডগস নামটাও কিন্তু কিছুটা শব্দের খেলা, কারণ তাড়াতাড়ি বললে নামটা শোনায় “আই লাভ ডগস”। আর নামটা কিন্তু একেবারে অবাস্তবও নয়। ইংল্যান্ডের পূর্ব লন্ডনের যে স্টুডিওতে মুভিতে নির্মিত হয়েছে, তার থেকে মাইল তিনেক দূরে “আইল অফ ডগস” নামে আসলেই একটি জায়গা আছে। আরেকটি মজার ব্যাপার, মুভির শেষে “মিউট পুডল” এর চরিত্রে, ওয়েস অ্যান্ডারসনের বেশ কয়েকটি মুভিতে অভিনয় করা অ্যাঞ্জেলিকা হিউস্টনের নাম দেয়া হয়।
মুভিটি প্রথমে বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মুক্তি পায়। সেখানে ওয়েস অ্যান্ডারসন পেয়ে যান সেরা পরিচালকের পুরষ্কার সিলভার বিয়ার। বড় পর্দায় মুক্তির পরে আইল অফ ডগস সকলের মন জয় করে নিতে সময় নেয়নি একেবারেই। বক্স অফিসে ৬২ মিলিয়ন ডলার আয়, আইএমডিবিতে ৮.১/১০, রোটেন টমাটোসে ৮৯% ফ্রেশ রেটিং আর মেটাক্রিটিকে ৮৪% রেটিং তারই প্রমাণ দেয়। অ্যানিমেটেড মোশন পিকচার অস্কারের জন্য জোর দাবিদার বলেও মানা হচ্ছে একে।
This article is in Bengali Language. It is about Isle of Dogs, a 2018 stop-motion-animated science-fiction comedy-drama film written, produced and directed by Wes Anderson. For references please check the hyperlinked texts in the article.
Featured Image: Fox Searchlight Pictures