Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জ্যাক রায়ান: টম ক্ল্যান্সির জমজমাট এসপিওনাজ থ্রিলার

মুভি প্রেমিকদের কাছে জ্যাক রায়ান নামটি নতুন না। মূলত সিআইএ অ্যানালিস্ট, কিন্তু প্রয়োজনে ফিল্ডে গিয়ে অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়তেও দ্বিধা না করা এই চরিত্রটি নিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। প্রথমটি ছিল ১৯৯০ সালে, দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর। ঐ মুভিতে জ্যাক রায়ান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অ্যালেক বাল্ডউইন। এরপর জ্যাক রায়ানকে নিয়ে একে একে নির্মিত হয় আরো চারটি মুভি, যেগুলোর দুটিতে অভিনয় করেন হ্যারিসন ফোর্ড, আর বাকি দুটির একটিতে অভিনয় করেন বেন অ্যাফ্লেক, এবং অপরটিতে ক্রিস পাইন।

জ্যাক রায়ান সিরিজের পোস্টার; Image Source: IMDB

জ্যাক রায়ান চরিত্রটির স্রষ্টা বিখ্যাত এসপিওনাজ থ্রিলার লেখক টম ক্ল্যান্সি। ১৯৮৪ সালে স্নায়ুযুদ্ধের পটভূমিতে দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর উপন্যাসের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পাঠকদেরকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন জ্যাক রায়ানের সাথে। ২০১৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জ্যাক রায়ানকে নিয়ে রচনা করেন মোট ১৭টি উপন্যাস, যার অনেকগুলোই বেস্ট সেলার হয়। তার মৃত্যুর পরেও তার অতীতের সহ-লেখকরা সিরিজটিকে চালিয়ে নিয়ে যান। এছাড়াও জ্যাক রায়ানকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক ভিডিও গেমস। সব মিলিয়ে এসপিওনাজ থ্রিলারের জগতে জ্যাক রায়ান এক নতুন জগত সৃষ্টি করেছে, যা রায়ানভার্স নামে পরিচিত।  

জ্যাক রায়ানকে নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও এর আগে কখনো টিভি সিরিজ নির্মিত হয়নি। কিন্তু নেটফ্লিক্সের মতো সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক স্ট্রিমিং সাইটগুলো যখন একের এক নতুন নতুন সিরিজ নিয়ে দর্শকদের সামনে নিয়ে হাজির হচ্ছে, তখন জ্যাক রায়ান টিভি সিরিজ নির্মিত হওয়াটা ছিল শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। শেষপর্যন্ত গত ৩১ আগস্ট মুক্তি পায় জ্যাক রায়ানকে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত ৮ পর্বের টিভি সিরিজ – টম ক্ল্যান্সি’জ জ্যাক রায়ান, সংক্ষেপে শুধু জ্যাক রায়ান। তবে নেটফ্লিক্স না, সিরিজটি দর্শকদেরকে উপহার দিয়েছে নেটফ্লিক্সের মতোই আরেকটি সার্ভিস, অ্যামাজন প্রাইম

সিআইএ হেডকোয়ার্টারে জ্যাক রায়ান; Image Source: Amazon
বসের সাথে তুরস্কে অপারেশনে জ্যাক রায়ান; Image Source: Amazon

টম ক্ল্যান্সির জ্যাক রায়ান উপন্যাসগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য আছে। অধিকাংশ বইয়ের কাহিনী গড়ে উঠেছে তার প্রকাশকালীন সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচিত কোনো সংকটকে ঘিরে। সিরিজেও এর বত্যয় ঘটানো হয়নি। লেখক টম ক্ল্যান্সি ২০১৩ সালেই মৃত্যুবরণ করায় সিরিজটির কাহিনী হিসেবে তার লিখে যাওয়া কোনো উপন্যাস ব্যবহার না করে তার নির্মিত চরিত্রগুলোকে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নতুন একটি কাহিনী রচনা করা হয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই এই কাহিনী গড়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম প্রধান সংকট, আইসিস জাতীয় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ঘিরে। সিরিজটির নির্মাণ করেছেন কার্লটন কিউজ এবং গ্রাহাম রোল্যান্ড, যারা এর আগে লস্ট এবং ফ্রিঞ্জের মতো জনপ্রিয় সিরিজের প্রযোজক ছিলেন।

সিরিজের মূল চরিত্র সিআইএ অ্যানালিস্ট জ্যাক রায়ান, যিনি সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের গতিবিধির উপর নজরদারি করতে গিয়ে সুলেমান নামে এক জিহাদীর সন্ধান পান। সুলেমানের ইয়েমেনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠানো হচ্ছিল, যা দিয়ে বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। জ্যাক রায়ানের ধারণা হয়, এই সুলেমানই হয়তো হতে যাচ্ছে পরবর্তী বিন লাদেন। রায়ানের বস প্রথমে তার কথায় খুব একটা পাত্তা না দিলেও শীঘ্রই ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং রায়ানকে নিয়ে ইয়েমেনে উপস্থিত হয় ব্যাংকের টাকা তুলতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া দুই সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।

ইয়েমেনে সুলেমান এবং তার সঙ্গী; Image Source: Amazon
ইয়েমেনে এক সন্ত্রাসীর সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে জ্যাক রায়ান; Image Source: Amazon

শুরু হয় অ্যানালিস্ট জ্যাক রায়ানের ফিল্ড অপারেটরের জীবন। ইয়েমেন থেকে একে একে কাহিনী গড়াতে থাকে সিরিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক, লাইবেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। একদিকে রায়ান এবং তার বস মিলে সুলেমানকে খুঁজে বের করার জন্য অভিযান চালাতে থাকে, অন্যদিকে সুলেমানের আয়োজনে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা সংগঠিত হতে থাকে। এরমধ্যে কাহিনী আরো জটিল হয়ে পড়ে, যখন জানা যায় সুলেমানের হাতে বন্দী আছে ১২ জন মার্কিন ডাক্তার, যাদের মধ্যে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জ্যাক রায়ান কী পারবে সুলেমানের পরবর্তী পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে?

সিরিজের মূল চরিত্র জ্যাক রায়ান হলেও এর বিশাল একটি অংশ জুড়ে দেখানো হয় জিহাদী নেতা মুসা বিন সুলেমানকে। সুলেমান ঠিক আইসিস সদস্য কি না, সিরিজে সেটা পরিষ্কার করা হয়নি। কিন্তু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরে সে যে আইসিসের মতোই কোনো এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে, সেটা পরিষ্কারভাবেই উঠে এসেছে। তবে অন্যান্য হলিউড মুভির মতো এই সিরিজে সুলেমানকে শুধুই সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থিত করা হয়নি, বরং একইসাথে মুসলমানদের জন্য ইউরোপের প্রতিকূল সামাজিক ব্যবস্থা কীভাবে তাকে ধীরে ধীরে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে, সেটারও এক ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

সুইসাইড ভেস্ট পরা এক নারী আত্মঘাতী হামলাকারী; Image Source: Amazon

সুলেমানের পাশাপাশি প্রায় একইরকম গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে তার স্ত্রী হানিন এবং তার তিন ছেলেমেয়ের কাহিনীও। বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা পর্যন্ত সুলেমানের কর্মকান্ডে হানিন সন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু এরপর জিহাদীদের সাথে মিশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া তার পছন্দ ছিল না। এর মধ্যে সুলেমানের অনুপস্থিতে সিরিয়ার মরুময় এলাকায় তার বাড়িতে অন্যান্য যোদ্ধাদের আনাগোনার কারণেও হানিন নিজেদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে কি পারবে সুলেমানকে প্রভাবিত করে সঠিক পথে আনতে, অথবা সুলেমানের কাছ থেকে পালিয়ে নিজের আর সন্তানদের জীবন রক্ষা করতে?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে সিরিজটি দেখার পরেই। এক ঘন্টা করে মাত্র ৮ পর্বের সিরিজ হলেও এতে একাধিক সাবপ্লটের মাধ্যমে বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বেশ সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। সিরিয়া এবং ইয়েমেনের দৃশ্যগুলো মরক্কোতে শ্যূটিং করা হলেও চমৎকার প্রোডাকশন ডিজাইন এবং সেট ডেকোরেশনের কল্যাণে সেগুলো ইয়েমেন ও সিরিয়ার বাস্তব দৃশ্যের মতোই ফুটে উঠেছে। তবে সন্ত্রাসীদের চিত্রায়নের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গায় অতি নাটকীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেমন- সন্ত্রাসীদের নেতার ট্রাকের উপর দামী সিংহাসনে বসে থাকা কিংবা এক সন্ত্রাসীর প্রকাশ্য দিবালোকে বাজারের মধ্যে ধর্ষণ করার চেষ্টা সিরিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য যুদ্ধ কবলিত দেশের ক্ষেত্রে ঠিক বাস্তবসম্মত না।

সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভীত মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সুলেমানের স্ত্রী হানিন; Image Source: Amazon
আত্মরক্ষার জন্য দৌড়াচ্ছেন সুলেমানের স্ত্রী হানিন; Image Source: Amazon

জ্যাক রায়ান সিরিজের মূল চরিত্রে, অর্থাৎ রায়ান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জন ক্রাসিনস্কি, যিনি এ বছর এ কোয়াইট প্লেস চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের নজর কেড়েছেন। এর আগে তিনি মূলত দ্য অফিস নামের কমেডি সিরিয়ালের জিম হারপেল্ট চরিত্রের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন। তার দৈহিক গঠন এবং চেহারা এ ধরনের চরিত্রের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত, কিন্তু জ্যাক রায়ান চরিত্রটিকে তিনি সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক অাছে। কেউ কেউ তার অভিনয়কে অভিব্যক্তিহীন বলে বর্ণনা করেছেন, যদিও চিত্রনাট্যের কারণে তার চরিত্রের খুব বেশি কিছু করার সুযোগও ছিল না।

জ্যাক রায়ানের তুলনায় মুসা বিন সুলেমানের চরিত্রটি ছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয়। এই চরিত্রে অভিনয় করা ইসরায়েলি আরব অভিনেতা আলি সুলেমানের অভিনয়ও ছিল অত্যন্ত চমৎকার। সুলেমানের স্ত্রী হানিনের চরিত্রে অভিনয় করা সৌদি অভিনেত্রী দিনা শিহাবিও বেশ ভালো অভিনয় করেছে। সিরিজের যেসব অংশে জ্যাক রায়ানকে দেখানো হয়, তার তুলনায় যেসব অংশে সুলেমানকে দেখানো হয়, সেগুলো অনেক বেশি বহুমাত্রিক, ঘটনাবহুল এবং আগ্রহ সৃষ্টিকারী। সিরিজটির নাম টম ক্ল্যান্সি’জ জ্যাক রায়ান হলেও একটা বড় অংশ জুড়ে দর্শকের কাছে মনে হতে পারে, তিনি টম ক্ল্যান্সি’জ মুসা বিন সুলেমান উপভোগ করছেন।

জ্যাক রায়ান সিরিজটি শেষপর্যন্ত আর দশটি হলিউড চলচ্চিত্রের মতোই শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সেনাদের মহত্ত্বকেই তুলে ধরার চেষ্টা করে। এখানে এক ড্রোন পাইলট ভুল হামলা করার পর অনুতপ্ত হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত ছুটে যায়। নায়ক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সম্ভাব্য সন্ত্রাসীকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে যায়। কিন্তু এই গতানুগতিক ত্রুটিগুলো উপেক্ষা করলে জ্যাক রায়ান চমৎকার উপভোগ্য একটি অ্যাকশন থ্রিলার সিরিজ। অনেকে এটাকে বছরের সেরা নতুন সিরিজ বলেও সম্বোধন করছেন। বর্তমানে এর আইএমডিবি রেটিং ৮.৩। অবশ্য রটেন টমাটোজে সমালোচকদের ভোটে এর রেটিং মাত্র ৬.২২। সেখানে ৭৭ শতাংশ বিচারক একে ফ্রেশ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

জ্যাক রায়ান সিরিজটি ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় সিজনের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এর কাহিনী হবে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো একটি দেশের রাজনৈতিক সংকটের উপর ভিত্তি করে। মূল বইগুলোতে জ্যাক রায়ানের পদোন্নতি হতে হতে একপর্যায়ে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নির্বাচিত হন। সিরিজ নির্মাতারাও যদি ভবিষ্যতে সে পর্যন্ত যেতে চান, তাহলে আশা করা যায় দর্শকরা আগামী বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত সিরিজটির নতুন নতুন সিজন উপহার পেতে থাকবে।

ফিচার ইমেজ: bookmyshow.com

Related Articles