Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘কালপুরুষ’: অন্তরতম অনুভূতির গল্প

সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের পর বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে যে ক’জন শুদ্ধতম স্রষ্টা রয়েছেন তাদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অন্যতম। তার চলচ্চিত্রগুলো ঘটনার ঘনঘোরে আচ্ছন্ন নয়, বরং প্রতিটিই জীবনের গভীরতর বোধ থেকে উৎসরিত। চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি তিনি কবিতাও লিখেন, এজন্যই একধরনের কাব্যিক অনুভূতি যেন তার নির্মাণগুলির ফ্রেমে ফ্রেমে অনুভূত হয়।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত; Image Source: imdb.com

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নির্মাণগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত চলচ্চিত্র ‘কালপুরুষ’। পরিচালনার পাশাপাশি এর কাহিনী এবং চিত্রনাট্য তার নিজের। ২০০৫ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি ‘টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল’, দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভাল’সহ বেশ কয়েকটি উৎসবে প্রথমে প্রদর্শিত হয়। পরে ২০০৮ সালের ২৫ এপ্রিল এটি ভারতে মুক্তি পায়।

‘কালপুরুষ’ সময়ের দু’টি ভিন্ন ফ্রেমে একই সাথে আবর্তনের গল্প। জীবনের অর্থ অনুসন্ধানের একটি প্রচেষ্টাও এখানে প্রবল। ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রের পুরোটা জুড়ে একটা মোহাচ্ছন্নতা কাজ করে। অন্তরের গভীরে লুকায়িত বেদনা এবং প্রশ্নগুলো যেন জেগে উঠতে থাকে।

‘কালপুরুষ’ (২০০৫) চলচ্চিত্রের একটি পোস্টার; Image Source: imdb.com

এ গল্পের নায়ক সুমন্ত কলকাতা শহরের এক অফিসের কর্মকর্তা। একই বাড়িতে থাকলেও তার স্ত্রী সুপ্রিয়ার সাথে কোনো সদ্ভাব নেই। স্কুল শিক্ষক সুপ্রিয়া আরেকজন পুরুষের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত। এমনকি তাদের সন্তান দু’টি- শান্তা এবং শান্তনুও সুপ্রিয়ার সেই পরকীয়ার ফসল।

কাজেই মনে হতে পারে, অসুখী দাম্পত্যজীবনের হতাশা এবং বিষাদে ক্লান্ত একজন মানুষ সুমন্ত। কিন্তু তা নয়, এ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুমন্ত প্রচণ্ড আশাবাদী একজন মানুষ এবং জীবনের প্রতি তার গভীর ভালবাসা আছে। সন্তান দুটি তার নিজের না, এটা জানা সত্ত্বেও তাদের প্রতি তার গভীর ভালবাসা। শান্তা এবং শান্তনুও তাদের বাবা সুমন্তকে প্রচণ্ড ভালবাসে। তারা বাবার পিঠে ছবি আঁকে। সুমন্ত তাদেরকে স্কুলে নিয়ে যায়। ঘুমানোর সময় গান শোনায়,

“নাক কামড়াই, কান কামড়াই, কামড়ে দিলাম মন,
তুমি আমার আঙুর লতা, আমার ত্রিভুবন।”

বাচ্চা দু’টো তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। এই বাচ্চা দু’টোর পাশাপাশি একটা কালো কুকুর ছাড়া তার জীবনে আর কোনো সঙ্গী নেই। তার স্ত্রী সুপ্রিয়া যখন ধীর কণ্ঠে পাশের ঘরে টেলিফোনে তার গোপন প্রেমিকের সাথে কথা বলে, সুমন্ত তা শুনতে পায়। কিন্তু কখনও তার বিরুদ্ধে উচ্চস্বরে কোন কথা বলে না। কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করে না, বাচ্চা দু’টোর মানসিক শান্তি নিশ্চিত করাই তার কাছে গুরুত্ব লাভ করে।

সুমন্ত চরিত্রে রাহুল বোস; Image Source: Youtube

সুমন্তের এই গল্পের পাশাপাশি সমান্তরালে বর্ণিত হয়েছে সুমন্তের বাবা অশ্বিনীর গল্প। পেশায় তিনি ছিলেন চিকিৎসক। স্ত্রী পুতুল এবং ছেলে সুমন্তকে নিয়ে বহরমপুরে এক বাড়িতে তিনি থাকতেন। আভা নামে একটি মেয়ের সাথে যৌবনে ভাব ছিল অশ্বিনীর। বহুকাল পরে তার সাথে দেখা হলে মুহূর্তের অসতর্কতায় তার সাথে একটি অন্তরঙ্গ দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তটি দেখে ফেলে তার স্ত্রী পুতুল। ছেলে সুমন্তকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। পুত্র সুমন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বাবার দিকে রাইফেল নিয়ে গুলি ছোঁড়ে। হাতে গুলি লাগায় বেঁচে যায় অশ্বিনী। কিন্তু স্ত্রী এবং পুত্রের এমন ভুল বোঝাবুঝিতে বেদনাহত হয়ে এবং একাকীত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এক সময় তিনি আত্মহত্যা করেন।

কয়েকমাস পরে পুতুল এবং সুমন্ত বরহমপুরের বাড়িতে আবার ফিরে আসে। কিন্তু অশ্বিনীকে আর খুঁজে পায় না তারা। পুত্র সুমন্ত যে তাকে ভুল বুঝেছে, এই বেদনা অশ্বিনীকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। মৃত্যুর পরেও হয়তো শান্তি হয় না তার। আবার বাবাকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার মতো একটা ভয়ংকর কাজ কেন সে করল, এই বেদনা তাড়িয়ে বেড়ায় সুমন্তকে। পুত্র সুমন্তের পিছু পিছু ছায়ার মত ঘুরতে দেখা যায় পিতা অশ্বিনীকে।

একই ফ্রেমে পুত্র সুমন্ত এবং পিতা অশ্বিনী; Image Source: Youtube

সরলরৈখিকভাবে এ চলচ্চিত্রের গল্পটি বলা হয়নি। চলচ্চিত্রজুড়ে ধীরে ধীরে সুমন্ত এবং অশ্বিনী দু’জনের গল্পই উন্মোচিত হয়েছে। চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যে ট্রাম থেকে নামতে দেখা যায় সুমন্তকে। তার পিছু পিছু অশ্বিনীও ট্রাম থেকে নেমে যায়। এরপর তাকে বলতে শোনা যায়,

“আরেকটু আগে আমার আগে আগে যে হাঁটছিল, ওর নাম সুমন্ত। আমার ছেলে। কতদিন হয়ে গেল আমি ওর সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। ও বুঝতে পারে না। ওকে আমার অনেক কথা বলার আছে। সুমন্তরও অনেক কথা আছে আমার সঙ্গে।”

প্রথমে এই অশ্বিনী চরিত্রটিকে নিয়ে দর্শকরা বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। তবে চলচ্চিত্রের শেষে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সুমন্তের অবচেতন মন থেকে অশ্বিনীর আবির্ভাব ঘটেছে।

এই চলচ্চিত্রে সুমন্ত চরিত্রে রাহুল বোস, অশ্বিনী চরিত্রে মিঠুন চক্রবর্তী, সুপ্রিয়া চরিত্রে সামিরা রেড্ডি প্রমুখ অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রের গল্পের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে প্রত্যেকেই তাদের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘কালপুরুষ’ দেখার সময় কেমন এক বিষণ্নতা এসে দর্শকদের ভর করে। কিন্তু যাকে ঘিরে এই বিষণ্নতার সৃষ্টি হয়, তাকে চলচ্চিত্রকার সৃষ্টি করেছেন ভিন্নরূপে। চারপাশের সবার প্রতি গভীর মমত্ববোধ অনুভব করে সুমন্ত। চলতি বাসে পকেটমারকে পকেট কাটতে দেখে সে ইশারাতে তাকে নিষেধ করে, কিন্তু চিৎকার করে তাকে গণরোষের মধ্যে ফেলে দেয় না। বরং বাস থেকে নেমে তাকে জিজ্ঞেস করে,

“এ লাইনে কত দিন? ঘরে কে আছে তোমার? বৌ? বৌয়ের নাম কি? তোমাকে খুব ভালবাসে, তাই না?”

এমন ছোট ছোট আগ্রহে তার জিজ্ঞাসু মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

একদিন রাতে সে পতিতা পল্লীতেও হাজির হয়। কিন্তু পতিতার চেহারায় সে তার নিজের স্ত্রীর সাদৃশ্য খুঁজে পায়। তার কামনাবোধ আর থাকে না। সে বলে বসে, “তোমাদের এখানে ছাদ আছে? আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ছাদে ঘুমাব।”

অর্থবিত্ত, প্রোমোশন এবং জাগতিক বিভিন্ন অর্জন দ্বারা জীবনের সাফল্য বিচার করার নিয়মকে এ চলচ্চিত্রে স্পষ্ট কটাক্ষ করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আপাতদৃষ্টিতে সুমন্তকে একজন অসফল মানুষ হিসেবে মনে হয়। একদিকে দাম্পত্য জীবনে সে অসুখী, আবার পেশাগত জীবনেও তার তেমন কোন সাফল্য নেই। দুর্নীতির সাথে আপোস করতে না পারায় তাকে বাদ দিয়ে তার অপর তিন সহকর্মীর প্রোমোশন হয়ে যায়। তার বস তাকে অবজ্ঞা করে, “You are always a failure.” এমনকি তার স্ত্রীও এক রাতে বলে বসে, “তোমাকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। মনে করেছিলাম তুমি কিছু করবে!”

অপরদিকে সুপ্রিয়া এক ছুটিতে আমেরিকায় তার ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যায়। আমেরিকা পুরোটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা থাকলেও সেটা সম্ভব হয় না। সে ভাইয়ের বাড়িতে বসে ভিডিও ক্যাসেটে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানের ভিডিও দেখে ট্রাভেলগ লেখা শুরু করে- ‘নিউইয়র্কে ন’দিন’, ‘সেই আমি মিয়ামিতে’, ‘ভুলি নি তোমাকে নিউইয়র্ক’, ‘ওরেব্বাস কলম্বাস’ ইত্যাদি ইত্যাদি নামে একের পর এক। যে জায়গাগুলো নিয়ে সে ভ্রমণকাহিনী লিখছে, সে জায়গাগুলো সে নিজে চোখেও দেখে নি, শুধু ভিডিওতে দেখে লিখেছে। এমনকি প্যারিসে না যেয়েও সে লিখে ফেলে ‘প্যারী আমার প্যারী’ নামের ট্রাভেলগ। সেসব বই বাজারে আবার ভাল বিক্রিও হতে থাকে। সুমন্ত সুপ্রিয়াকে ঠাট্টা করে বলে, “গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডকে জানিয়ে দাও!” দেখা যায় সত্যিই কিছুদিন পর সুপ্রিয়ার কাছে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস থেকে চিঠি এসেছে। আমেরিকা নিয়ে স্বল্পতম সময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক শব্দ লিখে সে একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তাকে আবারও আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সাফল্য ব্যর্থতার এসব জাগতিক হিসাবনিকাশ সুমন্তকে বিচলিত করে না। সে বিশ্বাস করে, জীবন নানা রকমের হয়। তার জীবন তার মতন।

পরিচর্যার অভাব এবং সাফল্য- ব্যর্থতার চক্করে ভালবাসা কিভাবে করুণা এবং ঘৃণায় পরিণত হয় তা চলচ্চিত্রকার এখানে আমাদেরকে দেখিয়েছেন। দীর্ঘ সাত বছর পর এক রাতে সুমন্তর কামনাবোধ জেগে ওঠে। স্ত্রী সুপ্রিয়ার ঘরে গিয়ে সেটা জানালে সে জিজ্ঞেস করে, “সাবান মেখেছ? ব্রাশ করেছ? ওয়াশ করেছ? তাহলে?” তখন সুমন্ত উত্তর দেয়,

“আমি যদি একটা আস্ত সাবান, ব্রাশ, পেস্ট, পুরো বোতল ডেটল ছিপিসুদ্ধ চিবিয়ে খেয়ে ফেলি, তাহলেও তোমার ঘেন্না যাবে না।”

নিজের জীবনের এসব কথা অবচেতন মনে শুধুমাত্র বাবা অশ্বিনীর কাছে ব্যক্ত করতে পারে সে। অশ্বিনী তাকে বলে, “আসলে আমাদের ভালবাসা ততক্ষণ, যতক্ষণ ভালবাসার হিসেবনিকেশ ঠিকঠাক থাকে। হিসেব না মিললেই…।” এ চলচ্চিত্রের শেষে অবশ্য জয় ঘটে সুমন্তেরই। সকল ক্ষুদ্রতা, বেদনা, প্রেমহীনতার উর্ধ্বে উঠে সে অন্তরে সবার প্রতি যে গভীর মমত্ববোধ লালন করে সেটিই চলচ্চিত্রের শেষে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।

কন্যা শান্তা এবং পুত্র শান্তুনুর সাথে সুমন্ত; Image Source: Youtube

চেতন এবং অবচেতন স্তরের এই পুনঃক্রমিক প্রবাহের পাশাপাশি সুমন্তের স্মৃতিময়তা, অতীতে পরিভ্রমণ এবং সন্তান দু’টিকে দেখে শৈশবের চিরকালীনতার অনুভব চলচ্চিত্রজু্ড়ে বিশেষ আচ্ছন্নতার জন্ম দেয়। এজন্যই এ ইংরেজিতে এ চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয়েছে ‘Memories in the Mist’. শৈশবে শোনা ইদ্রিস এবং তার পুত্র আবদুলের বাঁশির শব্দ একটু আনমনা হলেই সুমন্তের কানে বাজতে থাকে। এই বাঁশির শব্দ তাকে অতীতে নিয়ে যায়, সকল ক্ষুদ্রতার বিপরীতে আত্মময়তার দেয়াল সৃষ্টি করে আর দর্শক হৃদয়ে হাহাকার সৃষ্টি করে।

‘কালপুরুষ’ ২০০৫ সালের ‘শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্ম’ হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিল এবং মিঠুন চক্রবর্তী এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’র পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।

মানুষের অন্তরতম অনুভূতির একটি আধুনিক এবং কাব্যিক চলচ্চিত্র ‘কালপুরুষ’। এই বিশাল পৃথিবীর সকল ক্ষুদ্রতাকে উপেক্ষা করে কীভাবে নির্বাণ লাভ করা যায় তারই প্রতিচ্ছবি এটি। তাই দেখামাত্রই ‘কালপুরুষে’র মোহনীয়তা শেষ হয় না, বরং জীবন অনুসন্ধানী দর্শকদের হৃদয়ে এটি বিশেষ ছাপ রেখে যায়।

This is a reiview of the film Kaalpurush (Memories in the Mist).

Released in 2005, this Indian Bengali drama film was directed and written by Buddhadev Dasgupta. The film stars Mithun Chakraborty and Rahul Bose in lead roles.

Featured Image Credit: Nafis Sadik.

Related Articles