Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলায় মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারের জমাট প্রদর্শনী ‘কালের পুতুল’

চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ধুরন্ধর জনরা কোনটি? এমন প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশই বলবে থ্রিলারের কথা। দর্শককে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা থ্রিলারের চেয়ে বেশি আর কোন জনরা রাখে? থ্রিলারের আলাদা একটা বিভাগ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। দর্শকের মনস্তত্ত্বকে এমনভাবে নাড়াবে, সিনেমা শেষেও যার রেশ কাটে না। হলিউড বলিউডে এমন সিনেমা দেখে অভ্যস্ত আমাদের আফসোস জাগে, বাংলাদেশে খুব একটা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ঘরানার ছবি নেই। সেই আক্ষেপ কিঞ্চিৎ মেটাবার ক্ষমতা রাখে ২০১৮ সালের ৩০শে মার্চ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কালের পুতুল।’ কিঞ্চিৎ না বলে বলা ভালো, ভালোভাবেই মেটাবে। বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, এখানে এক্সপেরিমেন্ট হয় না তেমন। নির্মাতা রেজা গালিব সেই সাহস দেখিয়েছেন। চলচ্চিত্রটিতে তিনি দেখালেন, চাইলে আমাদের দেশেও ভিন্নতা উপহার দেওয়া যেতে পারে।

গল্পটা যেমন

লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন পাহাড়। একটাই সংযোগ সেতু। সেটিও দোদুল্যমান। ফোনের নেটওয়ার্ক নেই, চারদিকে জনমানবের চিহ্ন নেই। দিনের বেলাতেও গা শিউরে উঠবে। তেমন এক নীরব রাস্তা ধরে চলতে থাকে চাঁদের গাড়ি। তাতে দশজন মানুষ। ভিন্ন দশ পেশার, সম্পূর্ণ অপরিচিত। গন্তব্য পাহাড়ের চূড়ায় থাকা গেস্ট হাউজ। 

রশিদ আহমেদ নামক ব্যক্তির আমন্ত্রণে সবাই এসেছেন। গাড়ি থেকে নামার পর লক্ষণ দাশ পেয়ে যান রাকিব তরফদারকে। দুজনের চেনাজানা ছিল আগে। এর বাইরে বাকিরা একেবারে অপরিচিত। বিপরীত মেরুর একেকজন মানুষকে পথের শেষ মাথায় অভ্যর্থনা জানায় রশিদ আহমেদের কেয়ারটেকার কেনেডি। তার পিছু নিয়ে গেস্ট হাউজে ওঠে অতিথিরা। ভয়ংকর সুন্দর বলে যে টার্ম আছে, সেটি পাহাড়ের চূড়ায় এই কটেজে এসে আগত অতিথিরা বুঝেছে। এমনকি পানিরও সংকট এখানে। অথচ চারপাশে জমাট মেঘেরা এত কাছে, যেন ছুঁলেই বৃষ্টি নামবে।

কালের পুতুল; image: screenshots/picsart edit

কেনেডির কাছ হতে চাবি নিয়ে যে যার ঘরে প্রবেশ করে। সেখানে অপেক্ষা করে প্রথম ধাক্কা। কারও ওয়্যারড্রোবে, কারও টেবিলের ড্রয়ারে, কারও বালিশের নিচে এক এক করে প্রত্যেকেই পায় রিভলবার, সিরিঞ্জ, দড়ি, তীর-ধনুক ইত্যাদি। এসব দিয়ে সহজে মেরে ফেলা যাবে যে কাউকে। দুপুরে খাবার টেবিলে আসলে প্রাথমিক ধাক্কার ব্যাপার গোপন করে প্রত্যেকে। ওরা কেউই জানতো না, খানিক বাদে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে সবচেয়ে বড় ধাক্কা! ঘরের কোণায় থাকা টেলিভিশন আচমকা চালু হয়। একজন বিচারকের সামনে অপরাধীদের অপরাধনামা পেশ করছেন উকিল। অতিথিদের প্রত্যেকে চমকে ওঠেন! এ তো তাদের গোপন অপরাধের ফিরিস্তি! নির্জন পাহাড়ে এদের ডেকে আনা এই কারণে। তাদের সাজা দেওয়া হবে। বিচ্ছিন্ন পাহাড় থেকে পালাবে কী করে? নিজেদের রক্ষা করার কোনো পথ আছে কি? কে করছে এসব? কেন করছে?

বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে আটকে পড়ে অতিথিরা; image: channel i youtube

পর্দায় হিচকক-ক্রিস্টির দ্বৈত স্বাদ দিয়েছেন পরিচালক!

জনপ্রিয় লেখিকা আগাথা ক্রিস্টির ১৯৩৯ সালের রহস্যোপন্যাস ‘অ্যান্ড দ্যান দেয়ার ওয়্যার নান’ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন পরিচালক রেজা গালিব। মিস্ট্রি কিংবা থ্রিলার বানাতে কিংবদন্তি পরিচালক আলফ্রেড হিচককের জুড়ি নেই। ষাটের দশকে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ডায়াল এম ফর মার্ডার, ভার্টিগো, সাইকোর মতোন দুর্দান্ত সব সিনেমা। কালের পুতুলে হিচককের ছোঁয়া পাবেন। চিত্রনাট্য হতে শুরু করে মেকিং, সাসপেন্স, টুইস্টে নিজের সর্বোচ্চ দিয়েছেন পরিচালক। রেজা গালিবের ব্যাখ্যা বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলেছে সুন্দরভাবে…

“আমি এমন একটা প্লট চেয়েছিলাম, যাতে স্বল্প বাজেট এবং কম জায়গায় শ্যুটিং সম্পন্ন করতে পারি। গল্পটিকে বেছে নেওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ। আগাথা ক্রিস্টির ‘অ্যান্ড দ্যান দেয়ার ওয়্যার নান’ উপন্যাস থেকে স্রেফ ধারণা নিয়েছি। চেয়েছি হিচককের স্টাইলে চেষ্টা করে দেখতে। এতে সিনেমার বুনট যেমন পোক্ত হবে, দর্শকও ভিন্ন স্বাদ পাবে।”

পরিচালক কথা ও কাজে মিল রেখেছেন। সিনেমার পরতে পরতে উত্তেজনায় ঠাসা! নিজের পরিচালিত প্রথম সিনেমাতে দর্শককে নিয়ে ভালোভাবে খেলেছেন তিনি।

সেটে নির্মাতা রেজা গালিব ও অভিনেতা ফেরদৌস; image: channel i online

আন্তরিকতায় অনন্য নির্মাণ

একটা কাজ কখন সফল হয়? সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা এবং পরিশ্রম যখন মিলেমিশে একাকার হয়! ‘কালের পুতুল’ ঠিক এই ব্যাপারটিই উপলব্ধি করাবে। দশজন অভিনেতা অভিনেত্রী, যাদের প্রত্যেকের দর্শন আলাদা। সালেকের ভূমিকা করা ফেরদৌস আহমেদ আর রাকিব তরফদারের চরিত্রের রাইসুল ইসলাম আসাদ ছাড়া চলচ্চিত্রের পূর্ব অভিজ্ঞ কেউ ছিল না। লুৎফর রহমান জর্জ, মাহমুদুল ইসলাম মিঠু, শাহেদ আলি, রিতু সাত্তার, বিথী সরকার ছোটপর্দার চেনা মুখ হলেও বড়পর্দায় আনাড়ি। 

সিনেমায় ফেরদৌস ছিলেন দুর্দান্ত; image: screenshots/picsart edit

নিজেদের জায়গায় প্রত্যেকে সেরাটা দিয়েছেন। একটা সিনেমায় আপনি কতক্ষণ স্ক্রিনটাইম পাচ্ছেন, তার চেয়েও বড় হচ্ছে ওই সময়টুকুতে নিজেকে কতটুকু উপস্থাপন করতে পেরেছেন! কালের পুতুলে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল, চিত্রনাট্যের কোথাও সিনেমার শেষ অংশ উল্লেখ না থাকা! মানে পুরোদস্তুর থ্রিলারে দর্শক যেমন শেষ পর্যন্ত বসে থাকে উপসংহার দেখতে, এখানে অভিনেতারাও আক্ষরিক অর্থেই অপেক্ষায় ছিলেন শেষ অংশে কী চমক আছে তাদের জন্য তা জানতে!

ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় কিছু অংশ চ্যানেল আই স্টুডিওতে ধারণ করা হলেও বান্দরবানের পাহাড়ে শ্যুট করা হয়েছে সিনেমার বেশিরভাগ অংশ। প্রচন্ড বৃষ্টিতে জায়গাটা ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিল। শুরুতে দেখানো ঝুলন্ত সাঁকোটি বাস্তবেও ছিল একমাত্র সংযোগ পথ। সেটির দড়ি কোনোভাবে কেটে গেলে বিপাকে পড়ে কালের পুতুল টিম! সিনেমায় বেশ কিছু শট আছে, যেগুলো এক টেকে অনেকক্ষণ চলেছে। ধন্যবাদ প্রাপ্য চিত্রগ্রাহক সৈয়দ কাশেফ শাহবাজির। প্রতিকূল পরিবেশেও দারুণ মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন ক্যামেরায়। বৃষ্টির শব্দ, পাহাড়ি হাওয়া আর জুতসই আবহ সঙ্গীতে দর্শকের চমৎকার সময় কাটাতে নিজেকে উজাড় করেছেন ‘অনিল বাগচীর একদিন’ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীত পরিচালক স্বোয়ানি জোবায়ের।

ঝুলন্ত এই সাঁকোটি বাস্তবেও ছিল একমাত্র সংযোগ পথ; image: screenshots/picsart edit

কালের পুতুলে পরিচালক জীবন দর্শনের হালকা চর্চা করেছেন। নাসিফুল ওয়ালিদের জমাটি চিত্রনাট্য যার খোরাক! আমরা সবাই অপরাধী। ভুলের ঊর্ধ্বে কেউ নই। কেউ কেউ ভুলকে চাপা দিতে নতুন ভুলের জন্ম দিচ্ছি। ভুলের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উপরে ওঠার সময়ে কখনও কি মনে অনুতাপ জাগে না? হয়তো জাগে, ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে যায়। মানুষ সবকিছু থেকে পালাতে পারলেও নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারে না। একসময় তা মনের মধ্যে বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি করে। ভেতরের সত্তা বনাম বাইরের সত্তার।

Language: Bangla
Topic: 'Kaler Putul' bangla movie review
Feature Image: picsart photo edit/Jahirul Quayum Feroz

Related Articles