Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাম্মাতিপাদাম: এক শহরের বেড়ে উঠার গল্প

একটা শহর কীভাবে গড়ে ওঠে? শংকর বলেছেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের পাপ আর দীর্ঘশ্বাস জড়ো হয়ে সৃষ্টি হয় এক একটা মহানগরী। শুধু কি পাপ আর দীর্ঘশ্বাস? লাখ লাখ মানুষের কান্না আর রক্ত- এগুলোর উপরই তো দাঁড়ায় এক একটা কংক্রিটের জঙ্গল। যে মানুষটা ঘরছাড়া হয়, তার কান্না যেমন মিশে থাকে নগরের বাতাসে, যে মানুষটা তাকে ঘরছাড়া করে, তার কান্নাও একদিন এসে মিশে এই নগরের বাতাসে। এইসব কান্না আর রক্ত দলা পাকিয়েই তৈরি হয় ঢাকা, কলকাতা কিংবা কোচি।

এমন এক শহরের গল্প নিয়েই নির্মাতা রাজীব রবি বানিয়েছেন মালায়ালাম সিনেমা কাম্মাতিপাদাম। উন্নয়নের নামে, নগরায়নের নামে ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষজনকে কীভাবে ভিটেমাটি ছড়া করা হয়েছে, সেই গল্পই একেবারে চাঁছাছোলাভাবে ক্যামেরার সামনে তুলে এনেছেন রাজীব। গল্পের নায়ক কৃষ্ণান (দুলকার সালমান)। মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের ছেলে সে।

গল্পের শুরু যখন, তখন সে যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়। মুম্বাইয়ের এক গ্যারেজে কাজ করে সে। তার বন্ধু গাঙ্গা দলিত সম্প্রদায়ের। বহুদিন গাঙ্গার সাথে যোগাযোগ নেই তার। হঠাৎ একদিন গাঙ্গার কাছ থেকে ফোন আসে তার কাছে। কারা যেন গাঙ্গার পেছনে লেগেছে। তাকে মেরে ফেলতে চায়। ফোনটা হঠাৎ করেই কেটে যায়। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দুলকার। গাঙ্গার সাথে দেখা করতে হবে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। মূলত গাঙ্গা ও তার পরিবারের সাথে দুলকারের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে সিনেমার গল্প।

সিনেমার পোস্টার; Image: behance.net

সিনেমাটি প্রসঙ্গে rediff.com রিভিউ আকারে অনেকটা এরকম বলছেন- অন্য অনেক সিনেমার মতোই ফ্ল্যাশব্যাকে গল্প এগোয়। জিগস পাজলের মতো অনেকগুলো টুকরো মেলাতে হয় দর্শকদের। দুলকারের স্মৃতিতে আমরা এমন একটা জনপদে এসে পড়ি, যেখানে ভায়োলেন্স খুব নৈমিত্তিক ব্যাপার। এরনাকুলামে এই ভায়োলেন্সের নেতৃত্ব দেয় গাঙ্গার বড় ভাই বালাম। বালামের হিরোয়িজমে মুগ্ধ হয়ে দুলকার কৈশোরেই পাড়ার মাস্তানিতে হাতেখড়ি হয়। পুলিশ খুন করে জেলেও যায়। জেল থেকে বের হয়ে পাকাপোক্তভাবে এলাকার মাস্তান হিসেবে নাম লেখায়। দল বেঁধে ভয়ের বিজনেস করে বেড়ায় এরা। মানুষকে ঘরছাড়া করা, দরকার হলে খুন করা ইত্যাদি সব।

সে অনেক কাল আগের কথা। যখন এরনাকুলাম ছিল ছোট্ট একটা গ্রামের মতো। সেই এরনাকুলামে বিল্ডারদের চোখ পড়ে। দুলকার-বালামরা সেই বিল্ডারদের খেলার ঘুটি হিসেবে কাজ করে। একটা সময় আসে যখন বালামদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। এক সময় যারা ছিল ইমেডিয়েট বস, তারা খুব দূরে চলে যায়। তাদের কর্পোরেট অফিস হয়। সেই অফিসে মধ্যবিত্ত সুবোধেরা চাকুরি করে। এমন অফিসে দুলকারের মতো মাস্তান এলে তাদের ইমেজের ক্ষতিবৃদ্ধি হয়। স্যাররা তখন আর দুলকারদের সাথে অফিসে দেখা করে না। অফিসের পেছনে আলাদা রুমে দেখা করে। দুলকার, বালাম- এরা অনেকটা রাস্তার কুকুরের মতো। মালিক যতদিন দরকার এদের খাওয়া-খাদ্য দিয়ে পুষে রাখে। প্রয়োজন শেষ হলে এদের সাথে ভিক্ষুকের মতো ব্যবহার করে।

এই গল্পের সমান্তরালে আরেকটা গল্পের দেখা পাই আমরা। সেই গল্প প্রেমের গল্প। চিরন্তন প্রেমের গল্প। দুলকার ভালবাসে আনিথাকে। আনিথা দলিত সম্প্রদায়ের মেয়ে। এই বিয়ে দুলকারের পরিবার মেনে নেবে না। সেটা দুলকার জানে। জানে গাঙ্গাও। কেননা, গাঙ্গাও যে আনিথাকে ভালবাসে। এক সময় মনে হয়, এ তো সেই টিপিক্যাল ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। গল্পে তিনটা বাহু আছে বটে। কিন্তু এই গল্প তার চেয়েও বেশি কিছু। এই গল্প গাঙ্গার প্রতি দুলকারের ভালবাসার গল্প। এই গল্প আনিথার অসহায়ত্বের গল্প। সমাজ যে অদৃশ্য কিছু শেকলে আমাদের বেঁধে রেখেছে, এটি সেই শেকল পায়ে হেঁটে বেড়ানোর গল্প।

গল্পের শেষ নিয়ে দর্শকের তুষ্টি থাকতে পারে, বিশেষত দুলকার সালমানের ভক্তদের জন্য এ যে ‘Treat for eyes’. সমালোচকরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। যে গল্পের শুরু দুলকারকে করা গাঙ্গার ফোন দিয়ে, যে বন্ধুকে খোঁজার জন্য দুলকার কোচির এমাথা ওমাথা চষে বেড়িয়েছে, সেই গল্পের পরিণতি দর্শককে তৃপ্ত করে হয়তো। কিন্তু বাস্তবসম্মত হয় না। কিঞ্চিৎ ড্রামাটিক সেই পরিণতি। 

রাজীব রবিকে তবুও কৃতিত্ব দিতে হয় মালায়ালাম সিনেমার যে একটা নান্দনিক ছাঁচ আছে, যেই ছাঁচ থেকে বেরিয়ে  একদম ‘র’ একটা জীবন ফুটিয়ে তোলার জন্য। বিশেষত বালামের কথাবার্তা, তার মুখভঙ্গি, শারীরিক ভাষা সবকিছুই একদম পাড়ার সন্ত্রাসীদের বাস্তব প্রতিবিম্ব। আমাদের মধ্যবিত্ত মন এই সন্ত্রাসীদের স্বভাবতই ঘৃণা করে। তাদের ভয় করে। তাদের থেকে দূরে দূরে থাকে। নিজের সন্তানদের এদের ছায়া থেকেও দূরে দূরে রাখে। কিন্তু এই সিনেমা দেখলে কখনো হয়তো আপনি এদের প্রতি একটা টানও অনুভব করতে পারেন। এদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না, মান-অভিমান, সব মিলিয়ে এ এক মহাকাব্যের চেয়ে কম কিছু না।

Image: Deskgram.net

সিনেমার বেশ কিছু দৃশ্য একদম হৃদয় ছুঁয়ে যায়। একটা দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। দুলকার সালমান জেল থেকে ছাড়া পায় তখন। তার বাবা তাকে জেল থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে। এর মধ্যেও দুলকারের বন্ধুরা এসে হাজির। তারা ওকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বাবার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। না রাগ, না অভিমান। ছেলে বড় হয়েছে। তার পথ বেছে নিয়েছে। গাড়ির রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে দুলকার তার বাবাকে দেখে। সেও বন্ধুদের ‘না’ করতে পারে না। কান্না বা চোখের জল নয়, কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে এই দৃশ্য দেখে।

আরেকটা দৃশ্য খুব পছন্দের। এই দৃশ্যে গাঙ্গা তার আগের বসের সাথে দেখা করতে যায় বসের বাংলো ধাঁচের বাড়িতে। বাড়ির দারোয়ানরা তাকে ঢুকতে দেয় না। গাঙ্গা তখন দুঃখ করে বলে, এই বাড়ির জমি সে ম্যানেজ করে দিয়েছিল। সে বিধবাদের খেদিয়েছে। চোখের জলে মানুষকে ভিটেছাড়া করেছে। আজ সেই ভিটেয় সে নিজেই ঢুকতে পারছে না। পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না। একে আপনি ডিভাইন জাস্টিস বলতে পারেন। কিন্তু এই জাস্টিস কেন গাঙ্গাদেরই সইতে হয়? গাঙ্গাদের গডফাদার যারা, যারা তাদের সারা জীবন ব্যবহার করে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠেছে, সেই ভদ্রমানুষদের বেলায় ডিভাইন জাস্টিস কোথায়? এই প্রশ্ন তাড়িত করে বেড়ায় আমাদের সিনেমার শুরু থেকে শেষতক।

অভিনয় বেশ চমৎকার হয়েছে। দুলকার সালমান যথারীতি খুবই চমৎকার অভিনয় করেছে। গাঙ্গার ভূমিকায় অভিনয় করা ভিনায়াকের সেরা অভিনয় এটা বলছেন সমালোচকেরা। আর বালামের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। পুরুষপ্রধান এই সিনেমার একমাত্র নারী চরিত্র আনিথা। আনিথার ভূমিকায় অভিনয় করা শাওন রমির প্রথম সিনেমা এটা। তার অভিনয়ও মনে রাখার মতো।

Image: Fantastic Fest

কাম্মাতিপাদাম এর সাথে কোথায় যেন থ্রি ইডিয়টস-এর মিল আছে। থ্রি ইডিয়টস-এ দুই বন্ধু মিলে কলেজে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজতে বের হয়। গল্প চলে যায় অতীতে। শত হাসি তামাশা আর আবেগের ঘনঘটার মধ্য দিয়ে সেই বন্ধুকে অবশেষে খুঁজে পায় তারা। কাম্মাতিপাদাম-এ সেই কঠিন দায়িত্বটা দুলকার একাই কাঁধে তুলে নেয়। মাঝখানে পুরনো বন্ধু মাজিদ তাকে কিছুটা সঙ্গ দেয়। দিন শেষে সে গাঙ্গাকে খুঁজেও পায়।

এ শুধু বন্ধুত্বের গল্প নয়। কিংবা গ্যাংস্টার ফিল্ম বললেও এর উপর অবিচার করা হয়। বন্ধুকে খুঁজতে গিয়ে জীবনের গভীর অলিগলিতে ভ্রমণের গল্প এটা। জীবনকে নতুন চোখে দেখার গল্প এটা। 

Related Articles