মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা মাহমুদুল হকের উপন্যাস ‘খেলাঘর’ অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম ২০০৬ সালে নির্মাণ করেছেন একই নামের চলচ্চিত্র। মোরশেদুল ইসলামের চলচ্চিত্র পরিচালনায় হাতেখড়ি হয়েছে ১৯৮৪ সালে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। তিনি সবমিলিয়ে ১৪টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যার মধ্যে ৫টি চলচ্চিত্রের (স্বল্পদৈর্ঘ্য ২, পূর্ণদৈর্ঘ্য ৩) কাহিনী জুড়ে রয়েছে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন। পরিচালক যে ৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, সেগুলোর সবই এসেছে সাহিত্যের পাতা থেকে, অর্থাৎ উপন্যাস অবলম্বনে।
খেলাঘর সিনেমাটিকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দুজন তরুণ-তরুণীর প্রেমের আখ্যান বলা যায়। রিয়াজ, সোহানা সাবা, আরমান পারভেজ মুরাদ, গাজী রাকায়েত অভিনীত এই ছবিটির শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ের কাহিনী দিয়ে, যেখানে দেখা যায়, আপাতত নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের আশায় অনেকেই ভিটেমাটি ছাড়ছে। সেই সময়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামের দুই বাল্যবন্ধু ইয়াকুব আর মুকুল চন্দ্র। দুজনই গ্রামে শিক্ষকতা করে। ইয়াকুব (রিয়াজ) ঢাকায় ভার্সিটি থেকে পাশ করে সেখানে কোনো চাকরি না পেয়ে শেষে গ্রামে ফিরে এসে এলাকার কলেজে পড়াচ্ছে, আর মুকুল (আরমান পারভেজ মুরাদ) গ্রামে থেকেই পড়াশোনা শেষ করে গ্রামের স্কুলেরই শিক্ষক হয়েছে।
মুকুল গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করে, সরাসরি যুদ্ধে যোগ না দিলেও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। কিন্তু ইয়াকুব এখনও দ্বিধাগ্রস্ত, তিনি ঠিক করে উঠতে পারেননি এ সময় তার কী করা উচিত! যেকোনো যুদ্ধের সময়েই অনেক মানুষ দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ফেঁসে যায়, এই সিনেমাতে সেসব মানুষের প্রতিনিধি ইয়াকুব। দেশের জন্য ভালোবাসা থাকলেও সাহসের অভাবে তিনি যুদ্ধে যোগ দিতে পারছেন না। স্কুল, কলেজ সব বন্ধ; চারিদিকে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে আপাতত শুয়ে-বসে তাদের দিন চলে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে ঢাকা থেকে একদল শরণার্থী তাদের গ্রামে পালিয়ে আসে। সেই দলের সাথে রেহানা (সোহানা সাবা) নামের একটি মেয়ে ছিলো, যাকে ইয়াকুবের বন্ধু টুনু (গাজী রাকায়েত) এই গ্রামে আশ্রয় নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। টুনু তার চাচাতো বোন রেহানার কাছে একটি চিঠি লিখে দিয়েছে বন্ধু ইয়াকুবকে দেবার জন্য। চিঠিতে সে লিখে জানায়, কিছু বিষয় আর নিরাপত্তার কারণে রেহানাকে ঢাকা থেকে আপাতত গ্রামে পাঠানো হচ্ছে। এখন ইয়াকুব যেন রেহানাকে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় দিয়ে নিজের হেফাজতে রাখে।
টুনু চিঠিতে রেহানাকে আশ্রয় দেওয়া সংক্রান্ত কথাবার্তা ছাড়া অন্য কিছু লেখেনি, জানিয়েছে বাকি সব কথা সাক্ষাতে বলবে। বন্ধুর অনুরোধে ইয়াকুব রেহানাকে আশ্রয় দেয়।
রেহানা বেশ হাসিখুশি প্রকৃতির চঞ্চল মেয়ে। তার কথাবার্তা, আচরণে সবসময় শিশুসুলভ সরলতা লক্ষ্য করা যায়। তার আরো বেশ কয়েকটি ডাকনাম আছে বলে সে ইয়াকুবকে জানায়। ঝুমি, গাব্বু, আন্না নামেও অনেকে তাকে ডাকে। রেহানা বা ঝুমি বা গাব্বু বা আন্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, গ্রামে পালিয়ে আসার আগে সে রোকেয়া হলে থাকতো।
প্রথমে রেহানাকে যে বাড়িতে রাখা হয়েছিলো সেখানে কিছু সমস্যা হওয়ায় শেষমেষ তাকে গ্রামের একপ্রান্তে অবস্থিত পরিত্যক্ত এক বাড়িতে রাখা হয়। ‘আদিনাথের ভিটা’ নামে পরিচিত এই বাড়িতে অনেকদিন ধরে মুকুল একাই থাকে। গ্রামের মাতব্বর পিয়ার মোহাম্মদ মুকুলকে কয়েকশ বছরের পুরনো এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। গাছপালা ঘেরা নির্জন পরিবেশের এই বাড়িতে আসার পর ইয়াকুব অন্যরকম এক রেহানাকে আবিষ্কার করে। মাঝেমধ্যে রেহানার মধ্যে অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করে সে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেঁদে ফেলা, আবার চোখের জল নিয়েই হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়া কিংবা মাঝেমধ্যে চেঁচিয়ে ওঠার মতো ঘটনার কারণ ইয়াকুব বুঝতে পারে না। সেইসময় কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে যায় রেহানা, মনে হয় ভেতরের গোপন কোনো ব্যথা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বাকি সময় চঞ্চল রেহানা তার শৈশবের কথা, অন্য সব স্মৃতির কথা বলতেই ব্যস্ত থাকে। একসাথে গল্প করে, রান্নাবান্না করে, আশেপাশে ঘোরাফেরা করেই তাদের দিন কাটছিলো। এভাবে ইয়াকুবের সাথে রেহানার ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
চারপাশে বর্ষার জল, গাছপালায় ঘেরা পুরাতন, নির্জন, জীর্ণশীর্ণ এই বাড়িতেই তৈরি হয় তাদের ভালোবাসার অস্থায়ী সংসার। উপন্যাসের লেখক ও সিনেমার পরিচালক দুই তরুণ-তরুণীর অস্থায়ী এই সংসার জীবনকেই বলতে চেয়েছেন ‘খেলাঘর’। এরপর একদিন টুনু সেখানে আসে, তার কাছ থেকে ইয়াকুব জানতে পারে ২৫শে মার্চ রাতে রেহানা রোকেয়া হলে ছিলো। পালানোর সময় পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে ১০ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করেছে। তারপর হাসপাতালে মুমূর্ষু, অজ্ঞান অবস্থায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথম প্রথম রেহানা কাউকে না চিনতে পারলেও কিছুদিন পর শারীরিকভাবে একটু স্বাভাবিক হবার পর থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর সেই কারণেই তাকে গ্রামে পাঠানো হয়েছিলো। এসব শোনার পর ইয়াকুব কান্নায় ভেঙে পড়ে। টুনু ইয়াকুবকে আরো জানায় যে, রেহানা যখন ছোট ছিলো তখন ওর মা অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে যার, আর বাবা এই লজ্জায় আত্মহত্যা করে। সবমিলিয়ে রেহানা এখন খুব অসহায়। রেহানা পেছনে দাঁড়িয়ে টুনুর এসব কথা শুনে ফেলে। একসময় এগিয়ে এসে টুনুর জামার কলার ধরে চিৎকার করে বলে,
কী সব বলছিলি তুই! আমি তোর কী ক্ষতি করেছিলাম? কেন তুই ওকে কাঁদালি? কে তোকে আসতে বলেছে? কে?
এই কথা বলতে বলতে টুনু কান্নাকাটি শুরু করে। এ থেকেই বোঝা যে, এই অল্প কয়েকদিনেই রেহানা আর ইয়াকুব দুজন নিজেদেরকে খুব আপন করে নিয়েছিলো। সবকিছু বলে দেয়ায় রেহানা আর ইয়াকুবের সাথে থাকতে রাজি হয় না। ইয়াকুব থাকতে অনুরোধ করলে রেহানা কাঁদতে কাঁদতে জানায়, সে নষ্ট হয়ে গেছে। সে টুনুর সাথে এখনই ফিরে যাবে। যে নৌকায় টুনু আর রেহানা ফিরে যাচ্ছিলো সেটায় ইয়াকুব উঠতে চাইলে রেহানা জানায়, ইয়াকুব নৌকায় উঠলে সে নেমে যাবে।
তাই শেষমেষ এভাবেই রেহানাকে বিদায় জানায় ইয়াকুব। পরিসমাপ্তি হয় কয়েকদিনের খেলাঘরের। সিনেমার একদম শেষে দেখা যায়, মুকুলের সাথে একদল মুক্তিযোদ্ধা এই পরিত্যক্ত বাড়িতে এসে ঘাঁটি গড়ছে। মুকুল ইয়াকুবকে আবুল কমান্ডারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং ইয়াকুব জানায় সে-ও যুদ্ধে যাবে। সিনেমার শেষে এসে পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম ইয়াকুবকে যুদ্ধে পাঠালেও উপন্যাসের ইয়াকুবের যুদ্ধে যাবার কথা লেখা নেই। হয়তো এই চরিত্রের এত নীরবতা পরিচালকের পছন্দ হয়নি।
উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে আলাদা আলাদা, তাই এরা আলাদা ভাষায় কথা বলবে। সুতারাং এই দুই শিল্পমাধ্যমের পার্থক্য নিয়ে কোনো কথা বলা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই দুজন শিল্পস্রষ্টার দেখনদারির কিংবা প্রকাশভঙ্গির পার্থক্য থাকবে। তাই গল্প-কাহিনীর মূল বিষয়বস্তু এক হলেও মাহমুদুল হকের ‘খেলাঘর’ আর মোরশেদুল ইসলামের ‘খেলাঘর’ আলাদা দুটি ক্যানভাস। তবে এই দুই খেলাঘরের মধ্যে দুজন স্রষ্টার চেতনার ঐক্য আছে, সেই চেতনার নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। সেই কারণেই হয়তো এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মনের ভাষার সাথে চলচ্চিত্রের পরিচালক সৃষ্ট চরিত্রদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া দেখা যায়।
সিনেমাটি দেখে অবশ্য মনে হয়, কিছু জায়গায় বেশ তাড়াহুড়ো ছিলো। অবশ্য গল্পটি পুরো রেহানাকেন্দ্রিক হওয়ায় তার কোনো ঘটনা যাতে বাদ না পড়ে সেজন্য হয়তো উপন্যাসের তুলনায় সিনেমাতে অন্য চরিত্রগুলোকে পরিমিত মাত্রায় পর্দায় হাজির করা হয়েছে। এই সিনেমার কেন্দ্রীয় তিন চরিত্রের মধ্যে সোহানা সাবার অভিনয় সবচেয়ে বাস্তবসম্মতভাবে ফুটে উঠেছে। আর পর্দায় আরমান পারভেজ মুরাদের চেয়ে রিয়াজের উপস্থিতি বেশি থাকলেও অভিনয়ে স্বতঃস্ফূর্ততার দিক থেকে রিয়াজ কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন।
গঠনগত দিক থেকে ‘খেলাঘর’ অন্যসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের গল্প থেকে খানিকটা আলাদা। পর্দায় যুদ্ধকে সরাসরি তেমন হাজির না করলেও পাকসেনাদের বর্বরতার পরিচয় এবং তা থেকে সৃষ্ট বিপর্যয়কে ভালোভাবেই তুলে ধরা হয়েছে খেলাঘরে। সবদিক দিয়ে দেখলে এই সিনেমাকে যুদ্ধদিনের প্রেমের দলিল বলা যায়।
চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসব -
- লন্ডন, যুক্তরাজ্য (২০১০)
- জেনেভা, সুইজারল্যান্ড (২০১০)
- কলকাতা, ভারত (২০১১)
- আগরতলা, ভারত (২০১২)
- নতুন দিল্লি, ভারত (২০১২)
সার্ক চলচ্চিত্র উৎসব - কলম্বো, শ্রীলঙ্কা (২০১২)
পুরষ্কার
সেরা পরিচালক (বিজয়ী), সার্ক চলচ্চিত্র উৎসব- কলম্বো, শ্রীলঙ্কা (২০১২)
আরো পড়ুন: আগামী, শরৎ ৭১: মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রনামা
This Bangla article is about the liberation war based film 'Khelaghor', directed by Morshedul Islam. All the required references are hyperlinked within the article.
Featured Image: youtube.com