কিয়নগজি: ১০০ দিনের রুদ্ধশ্বাস অভিযান

সভ্য জগতে নিয়ম ভাঙলে পার পাওয়া যায়। কখনও জেল-জরিমানাও গুণতে হয়। কিন্তু বনের নিয়ম ভাঙলে তার দায় চুকাতে হয় নিজের জীবন দিয়ে। 

শ্বাপদসংকুল, ঘন জঙ্গলে বেষ্টিত আফ্রিকার একটি দেশ। জাতিগত দাঙ্গা ছিল এই দেশের নিত্যদিনের ঘটনা। একদিকে ওজাহিরি গোষ্ঠী, যুদ্ধই যাদের একমাত্র পাথেয়। অন্যদিকে হাতুই সম্প্রদায়ের পারদর্শিতা চোখে পড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে। হাতুইরা কর্মঠ ঠিকই, কিন্তু শারীরিক সক্ষমতার দিক দিয়ে ওজাহিরিরা ছিল এদের থেকে অনেক এগিয়ে। বলা বাহুল্য, শক্তির এই পার্থক্য কখনও ভালো পরিণতি নিয়ে আসেনি দেশটিতে। কিন্তু ওমাগো হাতুই যখন দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, পরিস্থিতি তখন ভিন্ন আকার ধারণ করে। 

কিয়নগজির অর্থ নেতা ©️ Nabonita Pramanik
সোহাইলি ভাষায় কিয়নগজির অর্থ নেতা ©️ Nabonita Pramanik 

বিভেদের অগ্নিশিখা নিভে গিয়ে দেশটির বুকে শান্তি ফিরে আসে তখন। জনগণের নিকট সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের বার্তা পৌঁছে দিয়ে ওমাগো হাতুই পরিণত হন কিয়নগজিতে। কিয়নগজি? এর মানে কী? সোহাইলি ভাষায় কিয়নগজির অর্থ নেতা। আর ওমাগো হাতুই ছিলেন সকলের প্রিয় নেতা। 

কিন্তু কিয়নগজির এই জনপ্রিয়তা অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। ফলস্বরূপ- প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে শুরু হয়ে যায় একশ দিনের গোপন ষড়যন্ত্র। সম্পদের মোহ কিংবা ক্ষমতার লোভ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই যড়ষন্ত্রের জাল ক্রমেই ঘন হয়ে ওঠে। আফ্রিকা থেকে শুরু হয়ে আমেরিকায় এসে ঠেকে। সেখান থেকে পৌঁছে যায় সুদূর এশিয়ার একটি দেশে- বাংলাদেশ। এই ষড়যন্ত্রের বাংলাদেশ অংশের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে নিপাট ভদ্রলোক, জায়েদকে কেন্দ্র করে। বিদেশি এনজিওর চাকরি করে কোনোভাবে দিন কাটত তার। পিতা-পুত্রের অসুস্থতায় জেরবার, জায়েদের ভাগ্যের চাকা একদিন ঘুরে যায়। কাঙ্ক্ষিত ফেলোশিপ পেয়ে জায়েদ পাড়ি জমায় আমেরিকার স্যানহোসে শহরে। 

এই অভিযান লোভের, এই অভিযান স্বার্থসিদ্ধির ©️Nabonita Pramanik
এই অভিযান লোভের, এই অভিযান স্বার্থসিদ্ধির ©️ Nabonita Pramanik 

স্যানহোসে শহরে গজিয়ে ওঠে আরেক রহস্য। গবেষণার কাজে এসে জায়েদকে প্রচুর পরিমাণে শারীরিক কসরত করতে দেখা যায়। নিতে হয় আনআর্মড কমব্যাট কিংবা সোহাইলি ভাষা শেখার মতো বিচিত্র সব প্রশিক্ষণ। একসময় জায়েদের মনে খটকা জাগে- একজন রিসার্চারের এতসব প্রশিক্ষণের কী প্রয়োজন? আফ্রিকার যে দেশে তাকে রিসার্চের কাজে পাঠাচ্ছেন ড. অগাস্টিন, কী ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে সেই দেশে? 

ড. অগাস্টিন, পার্ল স্টেইনব্যাক কিংবা ব্র্যাড হোসেলের মতো চরিত্রগুলো এই আখ্যানে হাজির হয় সম্পূর্ণ ভিন্নধারার উদ্দেশ্য নিয়ে। স্বার্থসিদ্ধির এই অভিযানে অ্যাডভেঞ্চারের রেশ নিয়ে আসে কাকাবুয়া মুরুয়া আর বান্টু পোর্টারদের দল। একদিকে কাহিনিতে প্রবেশ করে নতুন নতুন চরিত্র। অন্যদিকে ওমাগো হাতুইকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা যড়ষন্ত্র আর প্রাসাদ রাজনীতিতে আবদ্ধ থাকে না- আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণ করে বিস্তৃত আকার। 

ষড়যন্ত্র, জোট বেধে কাউকে বিপদে ফেলার এক অভিনব উপায়। ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভুক্তভোগীর ক্ষতি করতে পিছপা হয় না। আলোচিত বইয়ের কাহিনি জুড়ে দানা বাধতে দেখা যায় এমনই এক ষড়যন্ত্রের জাল, যেখানে জড়িয়ে থাকে কিয়নগজির মতো একটি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। 

অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারের আবহে নির্মিত হয়েছে বইয়ের পুরো কাহিনি ©️ Nabonita Pramanik
অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারের আবহে নির্মিত হয়েছে বইয়ের পুরো কাহিনি ©️ Nabonita Pramanik 

বিশ্বাসঘাতকতা নিঃসন্দেহে এই বইয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। ষড়যন্ত্রের উল্টোপিঠেই এর অবস্থান। লেখকের বর্ণনায় কিয়নগজির এই আখ্যান একটি দুর্দান্ত কন্সপিরেসি থ্রিলারের দিকে মোড় নেয়। অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারের আবহে নির্মিত হয়েছে বইয়ের পুরো কাহিনি। 

কাহিনির শুরুটা একটু ধীর গতিতে। প্রতি অধ্যায়ে নতুন ঘটনার রেশ টেনে কিয়নগজির গল্পটা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মাঝের দিকে এসে স্থির হয় গল্পের মোড়, কাহিনির গতি তখন বাড়তে থাকে। এই পর্যায়ে আফ্রিকার বিপদসংকুল ঘন বনের বর্ণনা উঠে এসেছে বইয়ের পাতায়। কাকাবুয়া মুরুয়া ও জায়েদ নামক চরিত্র দুটি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে তখন। উভয়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান পাঠককে বইয়ের পাতায় আটকে রাখবে। 

এই বনে কখনও কেউ বিপদের বাইরে নয়। এখানে বিপদ আসে আকাশ থেকে, পাতাল থেকে, জল থেকে, গাছ থেকে, হাওয়া থেকে, মাটি ফুঁড়ে।

এসপিওনাজের কিছু টার্ন অ্যাণ্ড টুইস্ট কিয়নগজি পড়ার অভিজ্ঞতাকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলেছে ©️ Nabonita Pramanik
এসপিওনাজের কিছু টার্ন অ্যাণ্ড টুইস্ট কিয়নগজি পড়ার অভিজ্ঞতাকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলেছে ©️ Nabonita Pramanik 

বইয়ের পাতায় আফ্রিকার শ্বাপদসংকুল বন, ঝুঁকিপূর্ণ পথের ভয়ংকর অভিযান একতা ও স্থৈর্যের যে অভূতপূর্ব শিক্ষা আমাদের দেয়, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এসপিওনাজের কিছু টার্ন অ্যাণ্ড টুইস্ট কিয়নগজি পড়ার অভিজ্ঞতাকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলেছে। 

শেষাংশে কাহিনির গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কিছু দৃশ্যের সিকোয়েন্স তাড়াহুড়ো করে টানা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। সমাপ্তিতে এসে ষড়যন্ত্রের জট খুলেছিল কিনা, সেই সম্পর্কে কিছু বলছি না। কন্সপিরেসি থ্রিলার ধাঁচের মাঝারি আকারের এই বইটি পড়লেই পাঠক তা জানতে পারবে। আর পড়ে উপভোগ করার মতোই একটি বই ‘কিয়নগজি: ১০০ দিন’। বইয়ের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং কাহিনি নির্মাণের দিক দিয়ে লেখকের যত্নের ছাপ স্পষ্ট। কন্সপিরেসি থ্রিলার ধাঁচের বই যাদের পছন্দ, তারা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার যাদের প্রিয় জনরা, পড়তে পারেন তারাও। কিয়নগজির ১০০ দিনের এই রুদ্ধশ্বাস অভিযান কম-বেশি সবারই ভালো লাগবে। 

বই: কিয়নগজি : ১০০ দিন  
লেখক: গোলাম কিবরিয়া 
ধরন: কন্সপিরেসি থ্রিলার 
প্রকাশনী: বাতিঘর প্রকাশনী 

Language: Bangla

Topic: Book review on 'Kiyongoji by Golam Kibria'

Feature Image: Nabonita Pramanik

Related Articles