দ্য গ্রেট বুম্বাদা- টালিপাড়ায় গত তিন দশক ধরে যিনি সগৌরবে সসৌরভে নিজের নায়কসুলভ অবস্থানটি ধরে রেখেছেন। যাত্রার শুরুটি কিন্তু নায়ক বা খলনায়ক হিসেবে হয়নি। হয়েছিল একটি শিশু চরিত্রে কাজ করার মধ্য দিয়ে। ছোট্ট বুম্বার মাত্র ছয় বছরেই সিনেমায় হাতেখড়ি হয়। ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা' নামীয় সেই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৮-তে। প্রসেনজিতের বাবা আরেক সব্যসাচী ও জাদরেল অভিনেতা শ্রী বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন এবং ছোট্ট প্রসেনজিৎ তার ডাকনাম বুম্বাতেই ছবিতে বিশ্বজিতের ছয় বছরের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন।
ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আরেক বাঙালি পরিচালক। রাজ কাপুরের ‘আনাড়ি', রাজেশ খান্নার ‘আনান্দ', অমিতাভ বচ্চনের ‘চুপকে চুপকে' খ্যাত পরিচালক হৃষীকেশ মুখার্জী। ছোট্ট বুম্বার অভিনয় ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। বিশ্বজিতবাবুর বাড়িতে বুম্বা ও তাকে উদ্দেশ্য করে অভিনন্দনপত্র পাঠাতে শুরু করে ভক্তেরা। প্রথম অভিনয়েই ছোট্ট বুম্বা সে বছর বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাওয়ার্ড (বিএফজেএ) পেয়েছিল। পরের বছর ‘রাহগির' নামক ছবিতে আবার শিশু চরিত্রে অভিনয় করে বুম্বা। ১৯৭০ এ পীয়ুষ বোসের ‘দুই পৃথিবী' ছবিতে ছোট্ট প্রসেনজিত উত্তম কুমারের ছেলেবেলাকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বুম্বাদা খুব ছেলেবেলাতেই ড্রাম বাজানো শিখেছিলেন এবং মাত্র বারো বছর বয়সে ‘তুফান মেলডি' নামক একটি ব্র্যান্ডের অংশও হয়েছিলেন।
১৯৮৩ সালে পরিচালক বিমল রায় তার ‘দুটি পাতা' ছবিতে বুম্বাদাকে প্রধান চরিত্রে নির্বাচিত করেন। সেটাই ছিল তার প্রথম লিড রোলে অভিনয়। তার বছর চারেক বাদে বুম্বাদা কাজ করেন তার ক্যারিয়ারের সম্ভবত সবচেয়ে ব্লকবাস্টার ছবিতে। নাম ‘অমর সঙ্গী’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন সুজিত গুহ। বাপ্পী লাহিড়ী সঙ্গীত পরিচালনার দ্বায়িত্বে ছিলেন। ‘চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারই'– গানটি আজও মুক্তির দিনের মতোই সমান জনপ্রিয়। পুরুষের কণ্ঠে খোদ বাপ্পী লাহিড়ী গানটি গেয়েছিলেন আর নারী কণ্ঠে গেয়েছিলেন আশা ভোসলে। ‘অমর সঙ্গী' মুক্তি পাওয়ার পরে আর বুম্বাদাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বলা যায়, ছবিটি মুক্তির মাধ্যমে টালিগঞ্জে স্টার হিসেবে অভিষেক হয় তার। ‘অমর সঙ্গী' মুক্তির পর থেকে ৭৫ সপ্তাহ বক্স অফিস কাঁপিয়ে বেড়ায় এবং বাংলা সিনেমার ইতিহাসে রেকর্ড তৈরি করে।
সবরকম চরিত্রেই তিনি অভিনয় করেছেন সমানতালে। সামাজিক, মসলাদার, পারিবারিক, অ্যাকশনধর্মী, পৌরাণিক ইত্যাদি সিনেমার বহুপদীয় ধারায় চলেছে তার অভিনয়। রবী ঠাকুরের ‘চোখের বালি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘চোখের বালি' সিনেমায় মহেন্দ্র চরিত্রে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের কয়েকটি গল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবিগুলোতে কাকাবাবু চরিত্রে, সৃজিতের ‘গুমনামী’, ‘জাতিস্মর’-এর মতো ছবিগুলোয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস এবং কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
বুম্বাদার নব্বইয়ের দশকের ছবিগুলোর ভেতর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সেসময় মূলত মসলাদার ও সামাজিক কাহিনীনির্ভর ছবিতেই দর্শকেরা অভ্যস্ত ছিল। নব্বইয়ের দশকে এমনও বছর গিয়েছে যে এক বছরে পঁচিশটি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনিদা। আবার, তিনিই টালিপাড়ায় একমাত্র অভিনেতা একবছরে যার বাইশটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। এমনটি হয়েছিল ২০০৪ সালে।
প্রসেনজিতের সাথে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবির একটি অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। ‘চোখের বালি'-র পরে বুম্বাদা ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে ‘দোসর' নামক একটি প্রজেক্টে কাজ করেন। সেখানে বুম্বাদার বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন অমর্ত্য সেনের মেয়ে কঙ্কা সেন। ২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়ার পর সমালোচকদের দ্বারা ‘দোসর' প্রশংসিত হলে বুম্বাদা ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে আরো কয়েকটি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হন। ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে করা প্রসেনজিতের অন্যান্য ছবিগুলো হলো ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৪), ‘উৎসব’ (২০০১), ‘দ্য লাস্ট লীয়ার' (২০০৭), ‘খেলা' (২০০৮), ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৯), ‘নৌকাডুবি’ (২০১১)।
ঋতুপর্ণ ঘোষ বিখ্যাত বড়দের ছবি নির্মাণের জন্যে। প্রসেনজিতের ঋতুপর্ণের ছবিতে কাজ করার মধ্য দিয়ে দর্শকমহলে আলাদা একটি ইমেজ সৃষ্টি হয়। বুম্বাদার ভক্তেরাও তার অভিনয়শৈলীর ধ্রুপদী দিকটার ব্যাপারে পরিচিত হওয়া শুরু করে ঋতুপর্ণের ছবিগুলোর ভেতর দিয়ে। ‘দ্য লাস্ট লীয়ার' বুম্বাদার ক্যারিয়ারে একমাত্র ইংরেজি ছবি। এখানে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন। ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এ তিনি বিপাশা বসুর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন।
তার ক্যারিয়ারে আরেকটি ব্লকবাস্টার ছবি ‘মনের মানুষ'। ফকির লালন শাহ'র জীবনী আধারিত ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন ওপারের শক্তিমান ছবিনির্মাতা গৌতম ঘোষ। ২০১০ সালে মুক্তি পায় ছবিটি যেখানে বুম্বাদা লালন শাহ এর চরিত্রে অভিনয় করেন। এ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি লালনের ওপর পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিকভাবে নিজেকে মরমী বাউল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ঘরবন্দী জীবনযাপন শুরু করেন এবং নিরামিষাহারী হন।
ঋতুপর্ণ ঘোষের পরে আরেকজন নির্মাতা বুম্বাদার ক্যারিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি সৃজিত মুখার্জী। সৃজিতের প্রথম ছবি ছিল ‘অটোগ্রাফ’। ‘মনের মানুষ’-এর সাথে একই বছর মুক্তি পেয়েছিল এটি। ছবির কাহিনীটি সাজানো হয়েছিল বুম্বাদার মতোই একজন সুপারস্টারের জীবনকে কেন্দ্র করে। মুক্তির পরে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘অটোগ্রাফ’। অনুপম রায় মিউজিক কম্পোজ করেছিলেন। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও'-অটোগ্রাফের এ গানটি এখনো তুমুল জনপ্রিয়।
১৯৯২ সালে বুম্বাদা তার একজন প্রিয় অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তার বয়স ত্রিশ। বিয়ের তিন বছরের মাথায় তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের দুই বছর বাদে তিনি অপর্ণা গুহঠাকুরতাকে বিয়ে করেন যেটিও পাঁচ বছরের মাথায় বিচ্ছেদের মুখ দেখে। তিনি তৃতীয়বারের মতো বিয়ের পিড়িতে বসেন ২০০২ সালে। অভিনেত্রী অর্পিতা পালকে বিয়ে করেন এবার। এ দম্পতির ত্রিশেনজিত নামে একটি পুত্রসন্তান আছে। বুম্বাদার জীবনে দাম্পত্য বিষয় নিয়ে নানা টানাপোড়ন দেখা গেলেও তিনি সেগুলোকে তার ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলতে দেননি।
শুধু টালিপাড়াতেই নয় বলিপাড়াতেও অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৯০ সালে ডেভিড ধাওয়ানের ‘আন্ধিয়া' সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক হয় প্রসেনজিতের। ছবিটি বক্স অফিসে আলোর মুখ দেখতে পারেনি। পরের বছর মেহুল কুমার পরিচালিত ‘মিট মেরে মান কি' মুক্তি পায় যেটিও ব্যবসাসফল হতে পারেনি। এরপরেও কয়েকটি হিন্দি ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বলিউডের যাত্রাটি খুব সুখকর হয়নি তার।
বুম্বাদা শুধু ক্যামেরার সামনে কাজ করেই বসে থাকেননি, ক্যামেরার পেছনেও কাজ করেছেন নিপুণভাবে। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে ছবি পরিচালনায় হাত দেন। ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালিত প্রথম বাংলা ছবি ‘পুরুষোত্তম’। ছয় বছরের একটি লম্বা বিরতির পর ১৯৯৮ সালে আবার পরিচালনার কাজে নামেন তিনি। তার পরিচালিত দ্বিতীয় ছবিটি ছিল ‘আমি সেই মেয়ে'। সিনেমা প্রযোজনাও করেছেন তিনি। ‘পুরুষোত্তম’ই ছিল তার প্রযোজিত প্রথম ছবি। তার প্রযোজিত ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য ‘বাপী বাড়ি যা', ‘শঙ্খচিল', ‘তিন ইয়ারী কথা', ‘মহালয়া’, ‘জেষ্ঠ্যপুত্র'। ‘গানের ওপারে' নামক একটি টিভি সিরিয়ালও বুম্বাদা প্রযোজনা করেছিলেন ২০১০ সালে যেটি স্টার জলসায় প্রচারিত হয়েছিল এবং যেটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
বুম্বাদার বাবাও ছিলেন একজন জাদরেল অভিনেতা। মহানায়ক বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বাংলা ও হিন্দি সিনেমায় দাপটের সাথে অভিনয় করে গেছেন প্রায় পাঁচটি দশক। বিশ্বজিতবাবু ছিলেন একাধারে নায়ক, গায়ক, নির্মাতা ও প্রযোজক। বিশ্বজিত বাবুর প্রথম পত্নী ছিলেন শ্রীমতী রত্না চট্টোপাধ্যায়। এ দম্পতির একমাত্র পুত্র প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় এবং একটি কন্যা পল্লবী চট্টোপাধ্যায় যিনিও একজন অভিনেত্রী। মা রত্না চট্টোপাধ্যায়কে বুম্বাদা অসম্ভব ভক্তি করতেন এবং মাকেই জীবনের পথিকৃৎ হিসেবে মেনেছিলেন তিনি।
বিশ্বজিতবাবুর পরিবারের সাথে মহানায়ক উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠ। তারা দুজনেই ছোট্ট বুম্বাকে আদর করে ডাকতেন ‘গুবলু'। বুম্বার অন্নপ্রাশনের দিনে সৌমিত্রবাবু শত কাজ ফেলে বুম্বার মুখে অন্নপ্রাশনের ক্ষীর তুলে দিতে ছুটে এসেছিলেন। স্টার জলসা ২০১৬ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের জীবনীর আলোকে ‘মহানায়ক’ নামক টিভি সিরিয়াল নির্মাণে হাত দেয় এবং প্রসেনজিতকে মহানায়ক উত্তম কুমারের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করা হলে তিনি সাগ্রহে সে অনুরোধ রেখেছিলেন। বহুকষ্টে ত্যাগ করা ধূমপানের অভ্যাসটি তাকে আবার ধরতে হয়েছিল মহানায়কের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। ‘মহানায়ক’-এ অভিনয় বুম্বাদার ক্যারিয়ারে আরেকটি মুকুট সংযোজিত করে। ৯৭টি এপিসোড সম্প্রচারের পরে স্টার জলসা সিরিয়ালটির প্রচার বন্ধ করে দেয়।
বুম্বাদা আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের জুটি ছিল অনেকটা ‘উত্তম-সুচিত্রা' জুটির ন্যায়। ঋতুপর্ণা ছাড়াও শতাব্দী রায়, রচনা ব্যানার্জি, ইন্দ্রাণী হালদারের বিপরীতে বুম্বাদা কাজ করেছেন মোটামুটি অর্ধশতাধিক সিনেমায়। তিনিই একমাত্র বাঙালি অভিনেতা যিনি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বলিউড হিরোয়িনদের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। ২০০১ সালে প্রসেনজিত-ঋতুপর্ণা জুটি অভিনীত ‘জামাইবাবু জিন্দাবাদ' ছবিটি মুক্তি পায়। তার পনের বছর বাদে ২০১৬ তে পুনরায় তারা জুটি বাঁধে ‘প্রাক্তন’ নামক একটি ছবিতে।
বুম্বাদার পুরষ্কারের ঝুড়ি বড্ড ভারী। সেখানে আছে ছ'খানা বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড, ছয়টি কলাকার অ্যাওয়ার্ডস, তিনখানা ডব্লিউবিএফজেএ অ্যাওয়ার্ডস, দু-দুখানা ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস ইস্ট, দুবার ন্যাশনাল ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস, এবিপি আনন্দ পুরষ্কার, স্টারডাস্ট পুরষ্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহানায়ক সন্মাননা ও বঙ্গবিভূষণ খেতাবসহ আরো অনেক পুরষ্কার গিয়ে স্থান করে নিয়েছে বুম্বাদার ঝোলায়। বুম্বাদাই কলকাতার একমাত্র ব্যক্তি যিনি একা নিজ উদ্যোগে কলকাতায় প্রথম কোনো স্যাটালাইট টিভি চ্যানেলের আমদানি করেন। পরিচালক মিতাল ঘোষাল ও সম্রাট বুম্বাদার জীবনের আলোকে ‘ফর সিনেমা অনলি' নাম দিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করছে। বুম্বাদার ভক্তেরা অধীর আগ্রহে বসে রয়েছে সেটির জন্যে।
This article is written in Bangla about the life and filmography of the great actor Prosenjit Chatterji who is popularly known as Bumbada to his fellows and appreciators. All the links of the helping websites are hyperlinked into the text.
Feature Image Source: amp.scroll.in