জীবন মানে একটা ভ্রমণ, উত্তর খোঁজার। আলাদা প্রশ্ন, আলাদা উত্তর। ভ্রমণপথে কেউ মনের মতো উত্তর খুঁজে পায়, কেউ খুঁজতে থাকে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন ছোটে আপন তালে। আদান-প্রদানের দুনিয়ায় নিঃস্বার্থভাবে সুযোগ কেউই দেয় না। মূল্য দিতে হয়। মাঝে মাঝে জীবন মানে সিনেমা। সিনেমার পর্দায় যেন নিজের প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে। একটা সিনেমায় কী আছে? একটা গল্প। যার খানিক কল্পনা, খানিক সামান্য বাস্তব। আরেকটু পরিধি বাড়িয়ে বলা চলে, আমাদের প্রতিনিধি হয়ে কয়েকটি চরিত্রের এগিয়ে যাওয়া। যদি বলা হয়, সিনেমা মানে নিজের ভেতরটাকে টেনে বের করা কিংবা নিজেকে নাড়িয়ে-তাড়িয়ে বদলে দেওয়া?
২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তেমনই এক জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমার নাম 'লাইফ ইন অ্যা মেট্রো'। চারটি আলাদা গল্প। প্রেম-যৌনতার, পুরনোকে নতুন করে পাবার, অবিশ্বাসের, দ্রোহের। এসবের সম্মিলনে পরিচালক নতুন স্বাদ চাখার সুযোগ দেন বলিপাড়ার ভক্তদের, যার রেশ আজও সমানতালে রয়ে গেছে সিনেপ্রেমীদের মুখে।
আট বছরের বৈবাহিক জীবনে স্বামী-কন্যাকে নিয়ে আধুনিক ফ্ল্যা বাড়ির ভোগবিলাসেও দম বন্ধ হয়ে আসে শিখার (শিল্পা শেঠি)। কর্পোরেট স্বামী রঞ্জিতের (কে কে মেনন) ন্যূনতম সময় হয় না স্ত্রীকে দেবার মতো। নাচের চমৎকার ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে পরিবার নিয়ে বাঁচতে চাওয়া শিখার কাছে এখন সব অর্থহীন। বাস ধরতে গিয়ে একদিন পরিচয় আকাশের সঙ্গে। আকাশ (শাইনি আহুজা) অভিন্ন নৌকার মাঝি। স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর বেঁচে আছে থিয়েটার নিয়ে। শিল্প বোঝে দু'জনেই। তাই সময় লাগেনি একে অপরকে বুঝতে। বাসের চার চাকার ঘূর্ণনে ঘুরতে থাকে বন্ধুত্ব, একসময় রূপ নেয় অন্যকিছুতে।
রঞ্জিতের সব আছে। তার কাছে সুখের অপর নাম নিজস্বতা। সুখ মানে টাকা। টাকা থাকলে শরীরের ক্ষুধাও মেটে। অন্যদিকে কৈশোরে প্রেমিকের কাছে প্রতারিত নেহা (কঙ্গনা) এখন আর শরীর নিয়ে ভাবে না। উপরে উঠতে বরং অস্ত্র হিসেবে দেখে কোমল আবেদনময়তাকে। রাহুল (শর্মান যোশী) স্বপ্ন দেখে মুম্বাই শহরে ধনকুবের হবার। নিজের ফ্ল্যাটকে অভিজাত যৌনশালা বানাতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। বস, কলিগ হয়ে আরো অনেকে, যারা তার উপরে ওঠার সিঁড়ি- ফ্ল্যাটটা তাদের আদিম আনন্দলোকে পরিণত হয়। প্রতিবেশী, সমাজ- কে কী বলল, তাতে থোড়াই কেয়ার করে সে। তার স্বপ্নের গাড়ির স্টিয়ারিং বসের হাতে, তা এড়িয়ে যাবার সাধ্য রাহুলের নেই।
বিয়ে একটা সামাজিক বন্ধন। মন্টি (ইরফান) আঠাশজন মেয়ে দেখলেও গাঁটছড়া বাঁধা হয় না। শ্রুতির (কঙ্কনা সেন) আবার এসবে ঢের আপত্তি। দেখা হলে মন্টির তাকে ভালো লাগে, কিন্তু শ্রুতি এড়িয়ে চলে। প্রথম দেখাতে যিনি বুকের ভাঁজে চোখ ফেলে, তাকে জীবনসঙ্গী করা অসম্ভব মনে হয় তার। সব ভুলে রেডিও স্টেশনে কাজ করা কলিগের প্রেমে পড়ে শ্রুতি। কিছুদিন পর জানতে পারে প্রেমিকের সমকামিতার কথা। সেটি মানতে না পেরে ফের পুরনো বিষণ্নতায় ডুব দেয় সে। নতুন চাকরি খোঁজে। ভাগ্যের ফেরে মন্টিকে পায় কলিগ হিসেবে।
ভাগ্য বদলের আশাতে চল্লিশ বছর আগে প্রিয়তমাকে ফেলে আমেরিকায় পাড়ি জমান আমোল (ধর্মেন্দ্র)। পরের চার দশক কেটেছে দুঃসহ। সব পেয়েছেন, তবে শিবানীকে (নাফিসা আলি) ফেলে আসার কষ্টে প্রলেপ দিতে যথেষ্ট ছিল না ওসব। একদিন চিঠি আসে শিবানীর ঠিকানায়। শুধু একটিবার চোখে চোখ রাখতে চান আমোল। অভিমান গলে বরফ হয়। সম্পর্কের শুকনো পাতারা নিমেষে প্রাণ ফিরে পায়। জীবনসায়াহ্নে এসে দু'টি প্রাণ আবার এক হতে চায়, হারাতে চায় দুরন্ত কৈশোরে। বয়স যেখানে নিছক সংখ্যা মাত্র।
লাইফ ইন অ্যা মেট্রো, পরিচালক অনুরাগ বসুর দুর্দান্ত একটি কাজ। এটি করার আগে তার প্রথম তিনটি কাজ ছিল সায়া, মার্ডার, গ্যাংস্টারের মতো ট্র্যাজিক রোমান্টিক ধারার চলচ্চিত্র। চতুর্থ সিনেমায় এসে পছন্দের জনরা ঠিক রেখে যোগ করেন স্ট্রিট মিউজিক। এটিই ভারতের প্রথম স্ট্রিট মিউজিক জনরার চলচ্চিত্র। প্রিতমের সঙ্গীত পরিচালনায় সায়েদ কাদরী, অমিতাভ ভার্মা, সন্দীপ শ্রীবাস্তবদের বোনা গানের কথাগুলো হয়ে ওঠে মনের শান্তির খোরাক। গোটা সিনেমা যেন একটা জীবন্ত উপন্যাস। গান সেখানে ঘোর তৈরি করে। 'আলভিদা', 'ইন দিনো', 'বাতে কুছ আনকাহি সি', 'কার সালাম' গানগুলো মানুষের মুখে মুখে এখনো ফেরে। মেট্রো ব্যান্ডের আদলে পথে ঘুরে ঘুরে গান গাওয়ার ব্যাপারটা চমকপ্রদ।
২০০৭ সালের ২১ আগস্ট, ৩৯ মিনিটের পুরো অ্যালবাম মুক্তির পর শ্রোতারা তাতে বুঁদ হয়ে রয়। ‘ইন দিনো’ ছিল ২০০৭ এর সং অভ দ্য ইয়ার। বাংলাদেশি সঙ্গীতের মহীরূহ মাহফুজ আনাম জেমস 'আলভিদা', 'রিশতে' গানে কণ্ঠ মিলিয়েছেন স্বভাবজাত সাবলীলতায়। এ সিনেমার সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হলো এর সিনেমাটোগ্রাফি। ক্যামেরার পেছনে অনুরাগের নির্দেশে ববি সিংয়ের কারুকাজে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে দৃশ্যপট। প্রতিটি দৃশ্য যেন কথা বলছে। বিশেষত রাতের দৃশ্যে ইউরোপিয়ান ক্লাসিক ঘরানার আবহ তৈরি করেছেন ববি। ব্যালকনিতে বসে শহর দেখা। রাতের শহর, যে শহর আর শহরের মানুষজন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। গানের চিত্রায়নেও দারুণ ভিন্নতা। বাসস্টপ, রেলওয়ে স্টেশনের ভিড়ে, ছাদের নির্জনতায়, নিয়ন আলোয় ফাঁকা রাস্তায়, সমুদ্রের পাড়ে কয়েকজন গিটার হাতে সুর তুলে যাচ্ছে, দেখতেই চোখের শান্তি। সিনেমার একটা দৃশ্যে সুউচ্চ দালানের ছাদে উঠে সর্বস্ব উজাড় করে চিৎকার দেন ইরফান খান, ববি সিংয়ের ক্যামেরার কারিশমায় সেই টোনটাও অর্থবহ রূপ ধারণ করে।
একটা সিনেমা কখন সার্থক হয়? একটা ভালো গল্প, বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনা, ক্যামেরার মুন্সিয়ানা, গানের গায়কি আর অভিনয়ের অনন্যতায়। অন্যান্য সব বিভাগে যতখানি নিখুঁত কাজ উপহার দিয়েছেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা, অভিনয় বিভাগে কলাকুশলীরা সব ছাপিয়ে গেছেন অসামান্য দক্ষতায়। অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে কেউ কারো চেয়ে এক চুল কম নয়। যার যার জায়গায় সেরাটা দিয়েছেন প্রত্যেকে। কে কে মেনন, শাইনি আহুজারা বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তখনকার সময়ে। শিল্পা শেঠি, কঙ্গনা রানৌত, কঙ্কনা সেন শর্মা, শর্মান যোশী, নাফিসা আলিরা নিংড়ে দিয়েছেন নিজেকে। ইরফান খান যতক্ষণ অনস্ক্রিন ছিলেন, ততক্ষণ হাসিয়েছেন। বাকি রইলেন ধর্মেন্দ্র। তাকে নিয়ে বলার কিছু নেই। যেভাবে চরিত্রে আবেগ ফুটিয়ে তোলেন, তাতে তার বয়সের অনেককে তো বটেই, প্রেয়সীকে ছেড়ে আসা প্রত্যেককেই যেন ফিরিয়ে নিয়েছেন অতীতে।
"বলেছিলাম, দু'জন দু'জনকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকব না। অথচ গোটা জীবনটাই পার করে এসেছি!"
দুর্দান্ত এই সংলাপে ধর্মেন্দ্র যেন আঁকেন বাস্তবতারই চিত্র।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ২০টি নমিনেশন ও ১২টি পুরস্কার লাভ করে লাইফ ইন অ্যা মেট্রো টিম। ২০০৮ সালের ফিল্মফেয়ার ও ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম একাডেমির সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে অনুরাগ বসু এবং সেরা পার্শ্বচরিত্রের পুরস্কার লাভ করেন ইরফান খান ও কঙ্কনা সেন শর্মা। একই বছর স্টারডাস্ট অ্যাওয়ার্ডে জুরি চয়েস ক্যাটাগরিতে কঙ্গনা রানৌত এবং জি সিনে অ্যাওয়ার্ডে সেরা নারী পার্শ্বচরিত্রের পুরস্কার ওঠে শিল্পা শেঠির হাতে। এছাড়াও স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডে সেরা প্লেব্যাক সিঙ্গারের খেতাব পান সোহম চক্রবর্তী।
ইউটিভি মোশন পিকচার্সের প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্রটি মূলত দু'টি বিদেশি চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। ১৯৯৬ সালের ফরাসি চলচ্চিত্র ‘দ্য অ্যাপার্টমেন্ট’ এবং ১৯৪৫ সালের ব্রিটিশ মুভি ‘ব্রিফ এনকাউন্টার’-এর আদলে গড়া চলচ্চিত্রটিতে প্রযোজক রনি স্ক্রিওলা বিনিয়োগ করেন সাড়ে নয় কোটি রুপি। ২২৫টি থিয়েটারে মুক্তির পর প্রথমদিনে আয় হয় ৮৭ লক্ষ রুপি। প্রথম সপ্তাহের আয় ৩ কোটি ৫২ লক্ষ রুপি। ২০০৭ সালে আয়ের দিক দিয়ে ২৬তম হওয়া এই সিনেমার লাইফটাইম আয় ২৫ কোটি ৬৬ লক্ষ ভারতীয় রুপি।
আকাশ পেতে চায় শিখাকে। ভালোবাসা দিয়ে ঘোচাতে চায় অপূর্ণতা। নেহা ফের প্রতারিত হয়। প্রকৃতি সাহসীদের পক্ষে থাকে। নেহা এবং শ্রুতি রুমমেট। দু'জন চমৎকারভাবে বাধা ঠেলে এগিয়ে যেতে জানে। ভুল করতে করতে নিজেকে সামলায় শিখা। রাহুল পাবে নেহাকে? নেহা আরো একবার সুযোগ দেবে কাউকে? আকাশের মেসেজটা ফের একবার সিদ্ধান্তহীনতায় ফেলে শিখাকে- "আমি চলে যাচ্ছি। এসো। হয় বিদায় জানাতে, না হয় হাত ধরে একই ট্রেনে চড়তে।" আমোল শিবানীর সম্পর্ককেই বোধহয় ভালোবাসা বলে, যা পুরনো হয় না কখনো। কাজের সূত্রে ভালো বন্ধুত্ব গড়েছে মন্টি-শ্রুতি। তারপর?
'লাইফ ইন অ্যা মেট্রো' সিনেমার ট্যাগলাইন হচ্ছে- এক শহর, অগণিত আবেগ। সত্যিই তা-ই! চারটি আলাদা গল্প হলেও ওরা যেন একে অপরের পরিপূরক। অসংখ্য প্রশ্ন ছুঁড়ে কোথাও এসে মিলিত হয় প্রত্যেকে। একই শহরে, একই পথের পথিক সকলে। পরিচালক অনুরাগ বসু সুনিপুণ হাতে গল্পগুলোকে গেঁথেছেন এক সুতোয়। কিছু সিনেমা শেষ হলেও রেশ থেকে যায়৷ এটি তেমন সিনেমা। পর্দায় 'দ্য এন্ড' ভেসে ওঠার পর আপনার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি যেমন আসবে, চোখ বেয়ে গড়াবে কয়েক ফোঁটা জল। জীবনের গল্পগুলো বুঝি এমনই হয়!
This is a Bengali language article. This is a review of a Hindi language film- 'Life in a metro'.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Justdial