
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস পাঠ শুরুর এক অনবদ্য নাম 'ময়নামতি উপাখ্যান'। আঞ্চলিক ইতিহাসগুলোর মাধ্যমেই তৈরি হয় একটি দেশের সামগ্রিক ইতিহাস৷ ময়নামতি উপাখ্যান কোনো ইতিহাসগ্রন্থ নয়, উপন্যাস। কিন্তু ইতিহাসের উপাদানে ভরপুর এই উপন্যাস। প্রাচীন ত্রিপুরা রাজাদের কথা যেমন রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলোতে উঠে এসেছে, ঠিক তেমন করে ময়নামতী উপাখ্যানে উঠে আসেনি। সমতট রানী ময়নামতীর কাহিনি এবং তার জীবনের নাটকীয় ঘটনার সমাবেশে গড়ে উঠেছে উপাখ্যান।
৭১ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবার পাবলিকেশনস থেকে। উপন্যাসটির গল্প এগিয়েছে দুটি প্লটে। একটি প্লটে এক ইতিহাস সম্মোহিত যুবক আমাদের নিয়ে যায় এক বিলুপ্ত নগরীতে, একসময় যা ছিল, অথচ এখন নেই। সে নিয়ে চলে বাস্তবের ফেরুসা নগরে, রুপবান মুড়ায়, শালবন বিহারে। অপর প্লটটি রাজা মানিকচন্দ্র, রানী ময়নামতী ও তাদের সন্তান গোপীচন্দ্রকে নিয়ে।
কাহিনী সংক্ষেপ
একাদশ শতাব্দীর সমতটের রানী ময়নামতী ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী। তিনি ছিলেন নাথ ধর্মের অনুসারী একজন সাধক। সাধনব্রত পালন করে তিনি মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন। অগ্নি, জল আর বায়ু; এই তিন বস্তুকে জয় করে ময়নামতী লাভ করেন মহাজ্ঞান বা অমরত্ব। তার ছিল আড়াই অক্ষর জ্ঞানের শক্তি। রাজা আবার বিয়ে করবেন, রানী এ সংবাদ শুনে রাজার ওপর ক্ষুব্ধ হন। তৃতীয় বিয়ে করতে রাজাকে অটল দেখে রানী রাজাকে একটি শর্ত দিয়ে বলেন, ফেরুসা নগরে তার জন্য আলাদা করে একটি কুটির নির্মাণ করে দিতে হবে। তৃতীয় রানী ঘরে আসার আগেই তিনি চলে যাবেন ঐ কুটিরে। তৃতীয় ও চতুর্থ রানী ঘরে আসার আগেই রানী ময়নামতী ফেরুসা নগরে চলে যান। উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনায় এমন ছয় পংক্তির অন্ত্যমিলের একটা করে পদ্য আছে-
জগৎ সংসার জটিল, নিত্য দ্বন্দ্বময়
জন্ম-মৃত্যু এ সংসার অসারনিশ্চয়
দেহতরী পঞ্চশীল, জীবন অতি বিস্ময়
ময়নামতী বলে এ জগৎ বড় মায়াময়।
কেউ চায় না যেতে জগৎ-সংসার ছাড়ি
সংসারে অনিবার্য সঙ্গী চেতনগুরু নারী।
প্রাচীন পুঁথির আবহ তৈরিতে এ পদ্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
প্রথাগত উপন্যাসের কাহিনীবিন্যাস থেকে ‘ময়নামতী উপাখ্যান’-এর এই আঙ্গিক ব্যতিক্রম। লেখক তা করতে পেরেছেন কবিতা নিয়ে তার অনেকদিনের কাজের কারণে। বর্তমানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অদূরেই রানী ময়নামতীর প্রাসাদ পাওয়া গিয়েছে। সমতটের সমৃদ্ধ নগরী ছিল কমলাঙ্ক। স্বর্ণালঙ্কারের মতোই ছিল তার ঐশ্বর্য। রাজপ্রাসাদ, আনন্দ বিহার, শালবন বিহার, ভোজ বিহার, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, কোটিলা মুড়া, ফেরুসানগর, রাজগঞ্জ, রানীর দিঘি ইত্যাদি স্থান এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।
শ্রমণ, ভিক্ষু, ঋত্বিক, পুরোহিত, মালি, মুচি, চাষা, জেলে, গোপাল, সুতার, নাপিত, ধোপা, চাঁড়াল, পোদ্দার, বণিক, তস্কর, লস্কর সকল জাতি-পেশার মানুষ নিয়ে তার রাজ্য। 'কর্মই ধর্ম', এ মন্ত্রে চলেছে সমাজ। রাজা মানিকচন্দ্রের মৃত্যুর পর নতুন রাজা গোপীচন্দ্রের শাসনামলে করারোপ নিয়ে দেখা দেয় প্রজাদের মধ্যে গোলযোগ। তারপর গোপীচন্দ্রের ১২ বছরের সন্ন্যাসজীবন শেষে ফিরে আসা এবং গুরুভাই হাঁড়িসিদ্ধার সাথে রানী ময়নামতীর অন্য জগতে মিলিয়ে যাওয়া দিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাসটি শেষ হয়েছে।
উপন্যাসের স্বরূপ বিশ্লেষণ
ময়নামতী উপাখ্যানের চরিত্র নির্মাণে ঔপন্যাসিক আহমেদ মাওলা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মানিকচন্দ্র, গোপীচন্দ্র, ময়নামতী, হাঁড়িসিদ্ধা, অদুনা, পদুনা, ভুবন দাশ, সত্যানন্দ ভট্ট প্রমুখ চরিত্র স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
তাছাড়া সমতট তথা বৃহত্তর কুমিল্লার ইতিহাস জানার জন্য যথেষ্ট মালমশলা এখানে পাবেন। লেখক কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান এবং কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মননশীল প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তার পরিচিতির কথা সবাই জানলেও তার কথাসাহিত্যিক পরিচিতি অনেকটা দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে। তার লেখা উপন্যাস ‘আগুন ঝরা ফাগুন দিনে’ (২০১৫), 'কতিপয় মুখস্থ মানুষ' (২০১৭) এবং ‘ময়নামতী উপাখ্যান’ (২০১৮) ইতোমধ্যে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘ময়নামতী উপাখ্যান’ যেন কথাসাহিত্যে কুমিল্লার আয়না।
লেখক সমতট ও সমতটের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি নীহাররঞ্জন রায়ের 'বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব', দীনেশচন্দ্র সেনের 'বৃহৎবঙ্গ', ভবানী দাসের 'ময়নামতীর গান', কৈলাসচন্দ্র সিংহের 'রাজমালা', আবুল কাশেমের 'কুমিল্লার ইতিহাস', সায়মন জাকারিয়ার 'ময়নামতির জ্ঞান' বইয়ের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। তবে তিনি নিজেই বলেছেন, এসব গ্রন্থ নয়, তিনি নিজের বয়ানে কাহিনী নির্মাণ করেছেন।
আমরা অনেকে গ্রিক পুরাণ পড়েছি। হেরা, এরিস, হেডিসদের জেনেছি। কিন্তু আমাদের ঘরেই যে এত বড় উপাখ্যান রয়েছে, তা খুব কম লোকেই জানেন। এই পুরাকথা থেকে নেওয়া একটি ঘটনা বলা যাক।
সাতদিন ধরে রানী ময়নামতী অজ্ঞান হয়ে আছেন। কোনো নড়াচড়া নেই। নিঃশ্বাস নেই। পুত্রবধূগণ ভাবলেন, রানীর মৃত্যু হয়েছে। আদেশ এলো, লালমাই পাহাড়ে কূপ খনন করে রানীকে মাটিচাপা দেওয়া হবে। কিন্তু তখনই রানী জেগে উঠলেন।
তাছাড়া গোপীচন্দ্র কর্তৃক রানী ময়নামতীকে উত্তপ্ত কড়াইয়ের মধ্যে ফেলে দেয়ার মতো টানটান উত্তেজনার কাহিনীতো আছেই। পুরো বইটিই এরকম অনেক পুরাকথা বা মিথ দিয়ে সাজানো।
উপন্যাসটি সমতট রাজ্যকে কেন্দ্র করে বেড়ে উঠলেও এখানে পার্শ্ববর্তী রাজ্য বঙ্গ ও হরিকেলের কথা এসেছে। নাথ সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে একটি পরিচিত নাম হলেও অনেকেরই নাথ ধর্ম সম্পর্কে খুব একটা জানাশোনা নেই। কিন্তু ময়নামতী উপাখ্যানে সে ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু খোলাসা করা হয়েছে।
স্ত্রীজাতির কাছেও যে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আছে, তা প্রাচীন মিথের প্রেক্ষাপটে যেন গ্রহণযোগ্য ছিল না। প্রতাপশালী রাজারা স্ত্রীকে গুরু হিসেবে মানতে পারতেন না। গল্পে রাজা মানিকচন্দ্র যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন রানী ময়নামতী রাজাকে বলেছিলেন,
"তুমি আমার কাছ থেকে মহাজ্ঞান শিখে নাও। তাহলে তোমার মৃত্যুভয় থাকবে না।"
কিন্তু রাজা তা মানেননি।
পিতার মৃত্যুর পর সন্তানের তার মায়ের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ সাহিত্যে বোধহয় বেশ পুরনো একটি বিষয়। শেক্সপিয়রের হ্যামলেটে তা আমরা ভালোভাবেই দেখেছি। ময়নামতী উপাখ্যানে রানী ময়নামতি তা অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে উতরে যান।
উপন্যাসটি পড়ার সময় যত সামনের দিকে এগোনো হবে, ততই মহাজ্ঞান লাভের মাধ্যমে অমরত্বপ্রাপ্ত রানী ময়নামতী ও হাঁড়িসিদ্ধার শেষ পরিণতি নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকবে। পরে দেখা যায়, ইতিহাসের ছত্রছায়ায় লেখক খুব সুন্দরভাবে উপন্যাসটির ইতি টেনেছেন। এবং এক অদ্ভুত ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে ময়নামতি উপাখ্যানের,
"কায়া সাধ্ আড়াই অক্ষর জ্ঞান
ময়নামতী ও হাঁড়িসিদ্ধার ধ্যান"
এক বৈঠকেই পড়ে নেয়ার মতো উপন্যাস এই 'ময়নামতী উপাখ্যান'। সময়ের নির্বাক ইতিহাস যেন নতুন করে সবাক হয়ে আপনার সামনে উঠে আসবে। আর এখানেই ঔপন্যাসিক সার্থক।
This article is in Bangla. It is a review of the novel 'Mainamati Upakkhyan'.
Featured Image: Samakal