Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাসান: প্রবহমান জীবনের চিত্রগাথা

ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি ছোট্ট শহর– বারাণসী। ‘বেনারস’ বা ‘কাশী’ নামেও এটি অনেকের কাছে পরিচিত। এলাহাবাদ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা এক ছেলেকে ভালোবেসেছিল এই শহরের এক তরুণী। ভালোবাসা যেমনিভাবে মনের, তেমনি শরীরেরও। এই শরীরবৃত্তিক অংশটির আগ্রহ মেটাতে তারা মিলেছিল শহরের একটি হোটেলরুমে। এরপর অকস্মাৎ রুমের দরজায় পুলিশের ধাক্কা। দরজা ভেঙে রুমে ঢুকে ছবি তোলার পাশাপাশি নানা রকম আপত্তিকর কথা বলে পুলিশবাহিনী তাদেরকে ক্রমশ আতঙ্কিত করে তুলতে শুরু করলো। লজ্জায় এবং ভয়ে পথ খুঁজে না পেয়ে বাথরুমে গিয়ে মুহূর্তের মাঝে ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করে বসলো ছেলেটি। হারিয়ে গেল একটি জীবন, সাথে একটি প্রেমের গল্প।

কিন্তু এই পৃথিবীতে গল্প কোনদিন ফুরোয় না। এ প্রান্তে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে, তো অন্য প্রান্তে আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয়। মানুষের জীবনের প্রেম আসে, বিচ্ছেদ থেকে শোক আসে, সেই শোক কাটিয়ে মানুষ আবার বাঁচতে শেখে। পৃথিবীর বুকে জীবনের প্রবহমানতার এই চিরকালীন গল্পটি বলতে চেয়েছে ‘মাসান’। ২০১৫ সালে পরিচালক নীরাজ ঘায়ওয়ান এই চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে ছবির জগতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ৬৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথমবার প্রদর্শিত হওয়ার পর ‘মাসান’ একই আসরে অর্জন করেছিল FIPRESCI সহ মোট দু’টি সম্মানজনক পুরস্কার।

‘মাসান (২০১৫) চলচ্চিত্রের পোস্টার; Image Source: scrolldroll.com

শুরুতেই বেনারসের যে মেয়েটির কথা বলছিলাম– এলাহাবাদ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা ছেলের সাথে যার প্রেম হয়েছিল, তার নাম দেবী পাঠক। তার বাবা বিদ্যাধর পাঠক শহরের নন্দেশ্বর ঘাটে মৃতদেহের অন্তোষ্টিক্রিয়ায় মন্ত্রপাঠ করেন, পাশাপাশি সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করে জীবনধারণ করেন। দেখা গেল, পুলিশের অত্যাচারে বিপর্যস্ত ছেলেটির আত্মহত্যার দায় এসে পড়লো দেবী পাঠকের ঘাড়ে। হোটেলরুমে তার অসংবৃত অবস্থা ফোন ক্যামেরায় ভিডিও করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করে বসলেন তিন মাসের মধ্যে তিন লক্ষ টাকা। টাকা সময়মতো না দিতে পারলে ভিডিওটি আপলোড হয়ে যাবে ইউটিউবে। ছয় বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর যে দেবীকে বাবা বিদ্যাধর পাঠক অনেক যত্নে বড় করেছিলেন, সেই মেয়ের সাথে তার দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে লাগলো। প্রেমিকের মৃত্যু এবং সেখান থেকে জন্ম নেওয়া হাহাকারের সাথে যুক্ত হলো পুলিশকে যথাসময়ে অর্থ যোগানোর ভয়াবহ দুশ্চিন্তা। 

অন্যদিকে বেনারস শহরেরই আরেক প্রান্তে হরিশচন্দ্র ঘাটের ডোমপাড়ায় একটি ছেলে দীপক। নিচু জাতে জন্মানোর অভিশাপ এবং দিনরাত মৃতদেহ পোড়ানোর ভয়ানক পেশা থেকে সে মুক্তি চায়। পলিটেকনিকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল ইয়ারে পড়ে সে, কোনো একটি চাকরী মিললে এই ডোমপাড়া ছেড়ে সে চলে যেতে চায় অনেক অনেক দূর। ঘটনাক্রমে তার সাথে প্রেম হয় শালু গুপ্তা নামের উঁচু বর্ণের এক মেয়ের। কবিতাপ্রেমী মেয়েটির হৃদয়ে একটু একটু করে জায়গা করে নিতে থাকে দীপক। বর্ণভেদ থাকলেও সেই পার্থক্যকে তুচ্ছ করে তারা একসাথে থাকার স্বপ্ন বিভোর হতে থাকে।

দীপক এবং শালু © Drishyam Films

একদিকে প্রেমিক হারানোর বেদনা এবং সমাজের কুৎসিত দৃষ্টি এড়িয়ে দেবী পাঠকের টিকে থাকার প্রচেষ্টা, অন্যদিক দীপক এবং শালুর মধ্যে ক্রমশ বেড়ে উঠতে থাকা স্নিগ্ধ প্রেমের গল্পটি ধারণ করে এগিয়েছে ‘মাসান’ চলচ্চিত্রটি। ‘মাসান’ শব্দের অর্থ ‘শ্মশানঘাট’, অর্থাৎ যেখানে শবদেহ পোড়ানো হয়।

জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝে প্রেম, পারিবারিক বন্ধন, বেঁচে থাকার লড়াই, প্রিয়জন হারানোর শোক, আবার সেই শোক কাটিয়ে এগিয়ে চলার গল্পগুলোকে অত্যন্ত যত্নের সাথে গভীর জীবনবোধের আবহে মোড়ানোর প্রচেষ্টা রয়েছে এই ছবিতে। এটি একদিকে যেমন মানুষের গল্প, অন্যদিকে ছোট্ট শহর বেনারসের গল্প। শহরেরও একটি স্বতন্ত্র সত্তা থাকে, নিজস্ব প্রবাহ থাকে– সেই সত্তা এবং প্রবাহ ধারণ করে বেনারস নিজেই এই চলচ্চিত্রে এক চরিত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছে। দূর থেকে দেখা তীর্থযাত্রীদের পবিত্রভূমি বেনারস বা কাশী নয়, এ বরং কল্পনার রঙের ছোপবিহীন কর্কশ শহরের নিজস্ব গল্প।

বেনারসের ঘাটে সংস্কৃত পণ্ডিত বিদ্যাধর পাঠক © Drishyam Films

‘মাসান’ ছবির সূচনাতেই হোটেলরুমে দেবী এবং তার প্রেমিক ছেলেটির অন্তরঙ্গ মুহূর্তে পুলিশের অকস্মাৎ উপস্থিতি এবং ছবি তুলে আতঙ্কিত করে তোলার দৃশ্যটি আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। দুজন প্রাপ্তবয়সী বোঝদার মানুষের পরস্পর সম্মতিতে একসাথে থাকার মুহূর্তটিকে পুলিশ যেভাবে ব্যবহার করে, তাতে মানুষের জীবনের কোন অংশটি ‘ব্যক্তিগত’ তা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়।

ভয় দেখিয়ে তিন লক্ষ টাকা ঘুষ গ্রহণ করার পেছনে এ দায় কি শুধুই পুলিশের, না কি ইউটিউবে ছেড়ে দিলে যে লক্ষ লক্ষ হুমড়ি খেয়ে সেই ভিডিও দেখবে তাদের? ভারত-বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে পণ্যে পরিণত করার এই কুৎসিত প্রবণতাটি কতটুকু সংগত, তার একটি মানবিক চিত্রায়ন শুরুতেই আমাদেরকে বেশ পীড়িত করে।

এই চলচ্চিত্রের প্রধান দু’টি চরিত্র– দেবী পাঠক এবং দীপক দু’জনের মাঝেই সমাজের বেঁধে দেওয়া রীতিগুলো অতিক্রম করার একটি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। সাধারণভাবে সমাজ প্রত্যাশা করে যে, বিবাহপূর্ব যৌনমিলন এবং প্রেমিকের মৃত্যুর এই ঘটনায় দেবী সর্বদা অপরাধবোধে ভুগবে এবং দেবীর সেই দুর্বল- ভঙ্গুর মানসিকতাকে পুরুষতন্ত্র ক্রমাগতভাবে ব্যবহার করবে। কিন্তু ‘মাসানে’র দেবীর মধ্যে শোকের কোনো উচ্চকিত প্রকাশভঙ্গি লক্ষ করা যায় না, বরং সে অনুভব করে, প্রেম অথবা মিলনের সম্মতি যেহেতু দু’জনের, কাজেই সমাজের চোখে সেটি অন্যায় হলে সে দায়ও দু’জনের। এভাবেই দেবীর মধ্যে ক্রমাগতভাবে লৈঙ্গিক প্রথাতন্ত্রের শেকল ভাঙার প্রবণতা কাজ করে।

অন্যদিকে দীপক ভাঙতে চায় নিম্নবর্ণে জন্মানোর অভিশাপের শেকল। দিনে-রাতে ক্রমাগতভাবে হাজির হতে থাকা মৃতদেহগুলো কাঠের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা, পুড়তে থাকা চামড়ার গন্ধ সহ্য করে বেঁকে উঠতে থাকা মৃতদেহে বাঁশের বাড়ি দিয়ে আবার শুইয়ে দেওয়া, কিংবা মাথার খুলি ভেঙে কয়েক খণ্ড করে পোড়ানোর যে বংশানুক্রমিক যে পেশা, ‘শিক্ষা’ নামক আলোর সাহায্যে ডোমবৃত্তির সেই চক্র থেকে বের হতে চায় দীপক।

পাশাপাশি দেবীর বাবা বিদ্যাধর পাঠক পরিস্থিতির চাপে ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকেন। নন্দেশ্বর ঘাটে তার আশ্রিত ঝোন্টা নামের অনাথ ছেলেটিকে তিনি পানির নিচে ডুব দিয়ে পয়সা সংগ্রহের বাজির খেলায় নিয়োজিত করেন। বিদ্যাধর পাঠকের এই মানবিক বিপর্যয় এবং পারিবারিক বন্ধনের জন্য অনাথ ঝোন্টার উৎসুক মনের প্রতিফলন ‘মাসানে’র একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। পিতা এবং কন্যার পদে পদে হোঁচট খাওয়ার সমান্তরালে দীপকের সাথে শালুর প্রেমের গল্পটি অপূর্ব সুষমা মেখে গড়ে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে।

শালু কবিতা এবং গান পছন্দ করে। বশির ভদ্র, আকবর এলাহাবাদী, মির্জা গালিব, দুশান্ত কুমারের কবিতা পড়ে শোনায় সে দীপককে। কিছু না বুঝেও একরাশ মুগ্ধতা মেখে শালুর কণ্ঠ রেকর্ড করে বারবার শুনতে থাকে দীপক। প্রথম প্রেমে পড়ার মধ্যে অন্য রকমের এক স্নিগ্ধ সৌন্দর্য থাকে। দ্বিধাভরা কণ্ঠস্বর, সলজ্জ চাহনী, এলোমেলো কথাবার্তা, হৃদয়ের ধুকধুকানি, একজনের প্রতি অন্যজনের অধীরতা– এমন অনুভূতিগুলো টুকরো টুকরো দৃশ্যে এক আলাদা মাত্রা লাভ করেছে এই চলচ্চিত্রে।

নদীর বুকে দীপক এবং শালু © Drishyam Films

‘মাসান’ সিনেমাটির মধ্যে একধরনের সততা আছে। সেই সততা প্রবাহিত হয়েছে এর সংলাপে, সঙ্গীতে, কিংবা শালুর কণ্ঠের কবিতায়। ‘তু কিসি রেল সে গুজারতি হে’ কিংবা ‘মান কাস্তুরী রে, জাগ দাস্তুরী রে’– এই গানগুলো একই সাথে আধ্যাত্মিক এবং আবার গভীর অর্থ বহন করে।

বেনারসের রেল স্টেশনে দেবী পাঠকের পুরুষ সহকর্মী যখন জিজ্ঞেস করে, “দেবীজী, এখানে ২৮টা ট্রেন থামে। আর কতগুলো থামে না জানেন?” আবার নিজেই উত্তর দেয়, “৬৪! এর মানে হল, এখানে আসা সহজ কিন্তু যাওয়া কঠিন।” অর্থাৎ বেনারস এমন এক শহর, যাতে আটকা পড়াই নিয়ম, তবুও শোক এবং ছোট শহরের বাঁধন কেটে দেবী এবং দীপক– দু’জনেই মুক্তির পথ খোঁজে।

‘মাসানে’ লুকিয়ে থাকা সততা এবং সৌন্দর্যের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে লক্ষ করি, এই ছবির চিত্রনাট্যকার বরুণ গ্রোভার তার তরুণ বয়সের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কাটিয়েছেন বেনারসে। আবার দীপক এবং শালু চরিত্রে যে দু’জন অভিনয় করেছেন, ‘মাসানে’র মাধ্যমেই তাদের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটেছে বলে প্রেমের দৃশ্যগুলোয় এত স্নিগ্ধ, এমন প্রকট মাধুর্য। নিপুণ বুননে এই চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলো এমনভাবে গাঁথা হয়েছে যে গল্পের নিজস্ব ঘোরে আচ্ছন্ন না হয়ে দর্শকের উপায় থাকে না। সিনেমাটোগ্রাফি, আবহসঙ্গীত থেকে শুরু করে প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয়ে যত্নের ছাপ লক্ষ করা যায় এখানে।

‘মাসানে’র শেষ দৃশ্য; © Drishyam Films

পরিচালক নীরাজ ঘায়ওয়ান তার প্রথম ছবিতে প্রবহমান জীবনের যে টুকরো গল্পটি বলতে চেয়েছেন, তা মূলত এর সততার কারণেই সকলের কাছে সমাদৃত হয়েছে। গভীর জীবনবোধের যে সহজাত সৌন্দর্য ‘মাসানে’ লুকিয়ে আছে, তা সঙ্গতকারণেই স্পর্শ রেখে যায় সকল সংবেদনশীল দর্শকের হৃদয়ে।

This Bengali article is a review of the 2015 Indian drama film 'Masaan' (English title:  'Crematorium') directed by Neeraj Ghaywan. It was first screened in the Un Certain Regard section at the 2015 Cannes Film Festival winning two awards and then released in Indian and French theaters.

Featured Image Credit: Medium.

Related Articles