বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে যে কয়জন চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্রকে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম না ভেবে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাদের মাঝে তারেক মাসুদ অন্যতম। স্বল্পায়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসা এ চলচ্চিত্রকার তার নির্মিত প্রতিটি চলচ্চিত্রে তাই তুলে ধরেছেন, সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয় যা একদিকে সংবেদনশীলতার নামে ছিল উপেক্ষিত, অন্যদিকে সমাজ কাঠামোর নিরাপদ ছায়াতলে ছিল বেশ শক্তিশালী। তেমনি একটি বিষয় ধর্মীয় কুসংস্কারকে উপজীব্য করে ২০০২ সালে তারেক মাসুদের নির্মিত চলচ্চিত্র মাটির ময়না।
সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে তৈরি মাটির ময়না চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রদের একজন গ্রামের মধ্যবয়সী শিক্ষিত কিন্তু গোঁড়া ও রক্ষণশীল ব্যক্তি কাজী সাহেব। হিন্দুয়ানী সকল আচার পরিত্যাগে তিনি বদ্ধ পরিকর। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আছেন তার স্ত্রী, দুই সন্তান আনু ও আসমা এবং ভাই মিলন। নিজ ইচ্ছায় ছেলেকে ভর্তিও করিয়েছেন মাদ্রাসায়। কিন্তু পরিবারের অন্যরা কেউই কাজী সাহেবের মতো না। আহমদ ছফার ভাষায় ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ বলতে যা বোঝায় তার সবটাই আছে তাদের মাঝে। তারা একদিকে যেমন আল্লাহকে বিশ্বাস করে তেমনি ভালোবাসে গান শুনতে, পূজোর বাতাসা খেতে কিংবা নৌকা-বাইচ খেলার সময় ঢোলের সাথে সাথে হাতে তালি দিতে।
চলচ্চিত্রের পুরোটা সময় জুড়ে বিভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্নতার মাধ্যমে ধর্মকে হাতিয়ার করার প্রবণতা, এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্ম ও জীবনকে একসাথে করে চলার সরলতা। মাটির ময়নাকে চলচ্চিত্র হিসেবে সফল বলার সবচেয়ে বড় কারণ হলো, এটি তার উদ্দিষ্ট বার্তা সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সহজ ও বোধগম্য উপায়ে পৌঁছাতে যেমন সক্ষম হয়েছে, তেমনি নির্মাণশৈলীর দিক থেকেও এটি অত্যন্ত কার্যকর। পরস্পরবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে যৌক্তিকতাকে প্রাধান্য দেয়া এবং বিভিন্ন প্রতীকের সূক্ষ্ম ব্যবহার শৈল্পিক দিক থেকে একে নিয়ে গেছে সাফল্যের চূড়ায়। এছাড়া ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্নতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা চলচ্চিত্রের প্রধান লক্ষ্য হলেও মানসিক বৈপরীত্যের মাঝে দ্বন্দ্বকে যুক্তির ব্যাখ্যায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন চলচ্চিত্রকার। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য দুইটি ঘটনা হলো কাজী সাহেব ও তার ছোট ভাইয়ের পথে দেখা এবং মাদ্রাসার দুই হুজুরের মাঝে হওয়া কথোপকথন।
দেশে চলমান সকল বাস্তবতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখা কাজী সাহেবের সাথে দেখা হয় মিছিলের সাথে চলতে থাকা ছোটভাই মিলনের। এ সময় মিলনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় কাজী সাহেবের পেছনে থাকা বাণিজ্যিক ধারার বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টার। অন্যদিকে মিছিলের সাথে হেঁটে চলা মিলনের পেছনের দেয়ালে দেখা যায় স্বৈরাচার বিরোধী রাজনৈতিক স্লোগান। একদিকে কাজী সাহেব যেখানে সংকীর্ণতা ও বদ্ধ চিন্তার প্রতীক হয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতার বিচ্ছিন্ন এক চরিত্র হয়ে বারবার দৃশ্যপটে উদয় হয়, ঠিক সেখানেই মিলনকে দেখা যায় উন্মুক্ত ও উদার মনের একজন সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে।
আবার জুম্মার নামাজের দিন ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভুল বার্তা দেয়া বড় হুজুরের বক্তব্য নিয়ে যখন ইব্রাহীম ও হালিম নিজেদের মাঝে আলোচনা করেন, তখনও বক্তব্যের সাথে কাজের মাধ্যমেও যৌক্তিকতার অভাবকে তুলে ধরেন পরিচালক। একদিকে হালিম যেখানে বড় হুজুরকে অন্ধভাবে সমর্থন করছেন সেখানে ইব্রাহীম তার প্রজ্ঞা ও যুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রশ্ন করে চলেন সে বক্তব্যকে। একই সময় ক্লোজ শটে দেখা যায় নদীর দেশের মানুষ হয়েও হালিমের ঢিলা কুলুপ তৈরীর কর্দমাক্ত হাত, আর শাকসবজির পরিচর্যা করা পরিচ্ছন্ন ইব্রাহীমের হাত।
আবার মাদ্রাসায় পড়তে যাওয়া আনুর সাথে পরিচয় হয় রোকনের। বিশাল প্রাচীরে ঘেরা সে মাদ্রাসায় শিশুদের মানসিক বিকাশের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা ছিল চলচ্চিত্রটির একটি প্রধান দিক। যেখানে শীতের সকালে বড় হুজুর নিজে চাদর গায়ে দিয়ে জ্বীন তাড়ানোর জন্যে রোকনকে পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে নামিয়ে দেয়, সেখানে কঠোর শাসনের নিয়ন্ত্রিত জীবনকে উপেক্ষা করে শুধু কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা দুই শিশুর বাগানে খেলার দৃশ্য সকল শৃঙ্খল ভাঙার বার্তা দেয়।
মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি এতটা বাস্তবিকভাবে তুলে ধরতে পারার পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেছে স্বয়ং পরিচালকের নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা। ছোট বেলার কিছু সময় পরিচালক তারেক মাসুদকে মাদ্রাসায় পাঠানো হয়েছিল শিক্ষা অর্জনের জন্যে। আর তাই একদিকে তিনি যেমন প্রশ্নহীনভাবে একটি ব্যবস্থাকে মেনে যাওয়ার সার্থক সমালোচনা তুলে ধরতে পেরেছেন, তেমনি সেই সিস্টেমের মাঝে থাকা একজন ইব্রাহীম হুজুরকেও চিত্রায়িত করতে পেরেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে।
মাটির ময়না চলচ্চিত্রটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এতে ব্যবহার করা গানগুলো। আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রে গান এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তাই সে দিকটিকে অক্ষুণ্ণ রাখতেও সফল হয়েছেন পরিচালক। গ্রামীণ সংগীত শিল্পীদের গাওয়া গানগুলোকেই তিনি ব্যবহার করেছেন। তবে সেখানেও ছিল বক্তব্যের গভীরতা। ‘দুই পাতা সিপারা পইড়া বুঝবো কী মদন’ কিংবা ‘আত্মত্যাগই আসল কুরবান’ এমন বাক্যের ব্যবহার পুরো চলচ্চিত্রকেই যেন পুনরায় তুলে ধরছে। এছাড়া সম্পূর্ণ দেশজ ছাপে নির্মিত চলচ্চিত্রে জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয়কে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে তুলে ধরেছেন পরিচালক। দেশের চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরে খ্যাতি এনে দেয়া ‘মাটির ময়না’ ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে অর্জন করেছিল ফিপ্রেসকি পুরষ্কার।
তবে মুক্তির আগেই চলচ্চিত্রটি মুখোমুখি হয় সেন্সর বোর্ডের নিষেধাজ্ঞার। এতে অবশ্য তেমন অবাক হবারও কিছু নেই। রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান বিশ্বাসে কখনো আঘাত করতে আগ্রহী হয় না, কারণ সেই কাঠামোই তাদের টিকে থাকার মূল পাটাতন। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং আলমগীর কবিরের ‘সীমানা পেড়িয়ে’ চলচ্চিত্র দুটিও সম্মুখীন হয়েছিল রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার। দুটি চলচ্চিত্রের একটিতে গ্রহণ করা হয়েছিল প্রতীকী প্রতিবাদ আর অন্যটিতে পূর্বতন প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক না হয়েও মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়কে উপজীব্য করে চলচ্চিত্রের নির্মাণ। পরবর্তী সময়ে সেন্সর বোর্ডের নির্দেশে নির্দিষ্ট কিছু দৃশ্যে পরিবর্তন আনা হয়, পরে তা প্রচারের অনুমতি পেলেও দেশের সকল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি। আপন কর্তব্যবোধ থেকে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেই থেমে থাকেননি তারেক মাসুদ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে সে চলচ্চিত্র দেখিয়ে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন নিজের কাঙ্ক্ষিত বার্তাও।
একটা সময় বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখকে শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে বরণ করে নিতো সকলে মিলে। ঘরে ঘরে তৈরি হতো পিঠা পুলি, সবাই ঝাঁক বেঁধে যেত মেলা দেখতে। উৎসব মুখর হয়ে উঠত চারিপাশ। অথচ হিন্দুয়ানী কাজ বলে একদল ধর্মান্ধের প্রচারিত বার্তায় প্রভাবিত হয়ে আজ অনেকেই নিজেকে এর থেকে করে রেখেছে বিচ্ছিন্ন। আর সে ভাগে শুধু অশিক্ষিত আর অর্ধ-শিক্ষিতরাই না, সামিল রয়েছে উচ্চ শিক্ষিত অনেকেই। এর কারণ আর কিছুই না বরং যৌক্তিক প্রশ্ন করতে পারার মানসিকতার অভাব এবং অজ্ঞতা। তারেক মাসুদ এই অজ্ঞতা থেকে উদ্ধারের জন্যেই নির্মাণ করেছিলেন মাটির ময়না। সকল প্রতিকূলতার মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে পূরণ করতে চেয়েছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতা। আজ বাণিজ্যিক ধারার রগরগে দৃশ্য ও একই কথার পুনরাবৃত্তি করে চলা বাংলা চলচ্চিত্রের বিপরীতে প্রয়োজন আরেকজন তারেক মাসুদ, আরেকজন আলমগীর কবির, আরেকজন জহির রায়হানের। তবেই বিনোদন সর্বস্ব চটকদার চলচ্চিত্রের বিপরীতে আমরা পাবো সমাজ ও সমাজের মানুষকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও বদ্ধচিন্তা থেকে মুক্ত চিন্তা করতে শেখানো সমাজ ও রাজনীতি সচেতন চলচ্চিত্র।
This article is about Bengali political film Matir Moina, directed by Tareque Masud.
Featured Image Source: blog.bdnews24.com