Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হ্যারি পটার নামা || পর্ব ১১ || দুঃসাহসী মিনারভা ম্যাকগোনাগল

কোনো এক রাতে প্রিভেট ড্রাইভের চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজমান। ল্যাম্পপোস্টের কৃত্রিম আলো চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকার তাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোত্থেকে হাজির হলো এক বুড়ো। মুখে ধবধবে সফেদ দাঁড়ি, মাথায় জাদুকরদের চোখা-লম্বা টুপি, পরনে ঢিলেঢালা আলখাল্লা। লাইটারের মতো কিছু একটা বের করে জাদুর মহিমায় সকল কৃত্রিম আলো সেই লাইটারে পুড়ে নিলেন। স্ক্রিনে হঠাৎ ভেসে উঠলো এক বিড়ালের ছবি, বিড়ালটি এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে। ওদিকে বুড়ো জাদুকর হেঁটে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি আর কেউ নন, তুখোড় জাদুকর আলব্যাস ডাম্বলডোর। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই, বিড়ালটির প্রতিচ্ছায়া ক্রমশ বড় হতে হতে এক মানুষের আকার ধারণ করলো। একসময় বিড়ালটি পুরোপুরি এক বৃদ্ধার রূপ নিলো, যার বয়স ষাটোর্ধ হলেও লাবণ্য যেন চেহারা থেকে ঠিকরে পড়ছে। জাদুকরের সাথে বৃদ্ধা জাদুকরটিও বিড়বিড় করে কী যেন আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন’  সিনেমার মাধ্যমে প্রথম দেখা দেয় হ্যারি পটার ভক্তদের প্রিয় জাদুকর মিনারভা ম্যাকগোনাগল। পুরো হ্যারি পটার সিরিজ যে কয়টা চরিত্রকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, তার মধ্যে মিনারভা ম্যাকগোনাগল অন্যতম। তার জানা-অজানা নানাদিক নিয়েই আজকের এই আলোচনা।

মিনারভা ম্যাকগোনাগল; Image Source: Warner Bros.

নিবন্ধিত অ্যানিম্যাগাস

হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম ইনস্টলমেন্টে দেখা মিলেছিল বিড়ালরূপী মিনারভা ম্যাকগোনাগলের। কিন্তু উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের পাঁড় ভক্ত ছাড়া অনেকেই হয়তো অ্যানিম্যাগাস নিবন্ধন সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জাদু মন্ত্রণালয়ে শুধুমাত্র সাত জন জাদুকর নিবন্ধিত অ্যানিম্যাগাস ছিল। তাদের মধ্যে মিনেরভা ছিলেন অন্যতম।

কোনো জাদুকর অ্যানিম্যাগি হতে চাইলে তাকে প্রথমে ম্যানড্রেক পাতা টানা একমাস মুখের মধ্যে গুঁজে রাখতে হবে। এই পাতা পরবর্তীতে পোশন তৈরিতে বিশেষ কাজে লাগবে। অবশ্য ইচ্ছা করলেই কেউ সেই পোশন বানাতে পারবে না, এজন্য দরকার হবে পোশন সম্পর্কিত স্বচ্ছ জ্ঞান, এবং পোশন বানানোর পরিপূর্ণ দক্ষতা। একজন অ্যানিম্যাগাস চাইলেই তার ইচ্ছানুযায়ী প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারবে না। সে কোন প্রাণীতে রূপান্তরিত হবে সেটা নির্ভর করবে তার ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতার উপর।

হগওয়ার্টসের শ্রেণিকক্ষে বিড়ালরূপী মিনারভা; Image Source: Warner Bros.

কুইডিচ খেলোয়াড়

স্কুল জীবনে মিনারভা ছিলেন গ্রিফিন্ডর কুইডিচ দলের একজন সক্রিয় সদস্য। কুইডিচে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের ফলে তিনি অল্প সময়েই হগওয়ার্টসে হয়ে উঠেন জনপ্রিয়। শেষবর্ষে এসে স্লিদারিনের সাথে এক ম্যাচে সাংঘাতিক এক ফাউলের শিকার হয়ে ব্রুমস্টিক থেকে পড়ে যান ম্যাকগোনাগল। গুরুতর আহত হয়ে ওইসময় মাঠ ত্যাগ করেন তিনি। কয়েকটা হাড়ও ভেঙে গিয়েছিল তখন।

শিল্পীর তুলিতে কুইডিচ খেলোয়াড় মিনারভা; Image Source: Denver Balbaboco/ArtStation

ওই ম্যাচ ছিল মূলত কুইডিচ কাপ বিজয়ী নির্ধারণকারী ম্যাচ। তাই তখন থেকেই স্লিদারিন হাউজের প্রতি বড় ধরনের এক ক্ষোভ সৃষ্টি হয় মিনারভার মনে। মজার ব্যাপার হলো, হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন  মুভিতে কুইডিচ শিল্ডে জেমস পটারের নামের পাশে এম. জি. ম্যাকগোনাগল নাম দেখা যায়, যে ১৯৭১ সালে কুইডিচে পুরষ্কার জিতেছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি হয়তো মিনারভার কোনো নিকটাত্মীয় হতে পারেন। অনেকের মতে তিনি মিনারভার ভাই রবার্ট জুনিয়র ম্যাকগোনাগল কিংবা ম্যালকম ম্যাকগোনাগলের সন্তান।

জেমস পটারের সাথে কুইডিচ খেলেছেন এম জি ম্যাকগোনাগল; Image Source: Warner Bros.

সর্টিং হ্যাটের বিলম্ব

হ্যারি, হারমায়োনি, নেভিল প্রত্যেকেরই হাউজ নির্বাচনের সময় সর্টিং হ্যাটকে একপ্রকার বেকায়দার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ওইদিকে সর্টিং হ্যাট তো হ্যারিকে স্লিদারিনে আর হারমায়োনিকে র‍্যাভেনক্ল হাউজেই প্রায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তবে এদের কারোরই পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু হাউজ নির্বাচন তামাশায় মিনারভা ম্যাকগোনাগলের কাহিনী আজ পর্যন্ত জাদু জগতের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। হাউজ নির্বাচনে সর্টিং হ্যাট পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিলে সেই ঘটনাকে ‘হ্যাটস্টল’ বলে উল্লেখ করা হয়। কারণ, শিক্ষার্থীর চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, ও দক্ষতা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট হাউজের জন্য নির্বাচন করাটা সর্টিং হ্যাটের জন্য অনেকসময় কঠিন হয়ে পড়ে।

হগওয়ার্টসের জানা ইতিহাসে হ্যাটস্টলের ঘটনা ঘটেছে মোট দুইবার। এর মধ্যে প্রথমটি মিনেরভা ম্যাকগোনাগলের। হগওয়ার্টসে পদার্পণের পর তিনি যখন সর্টিং হ্যাট মাথায় পরেছিলেন, তখন হাউজ নির্বাচনে ওই হ্যাটের সময় লেগেছিল সাড়ে পাঁচ মিনিটের কাছাকাছি। মিনারভাকে হাউজ গ্রিফিন্ডর নাকি র‍্যাভেনক্লতে পাঠাবে, সেটা নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল হ্যাটটি। অবশেষে মিনারভা স্থান পেলো সাহসী জাদুকরদের আঁতুড়ঘর হাউজ গ্রিফিন্ডরে। হ্যাটস্টলের দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল পিটার প্যাট্টিগ্রুকে নিয়ে। তাকে গ্রিফিন্ডরে রাখলে ভালো হবে নাকি স্লিদারিনে পাঠানো উচিত হবে, এটা নিয়ে হ্যাটকে দোটানায় পড়তে হয়। এইসময়ও সর্টিং হ্যাট বিশ্বাসঘাতক পেট্টিগ্রুকে হাউজ গ্রিফিন্ডরের জন্য নির্বাচিত করেছিল।

সর্টিং হ্যাট মাথায় হ্যারি পটার; Image Source: Warner Bros.

নামের উৎপত্তি

হ্যারি পটার সিরিজের প্রত্যেকটা চরিত্রের নামের পেছনেই সংক্ষিপ্ত কাহিনী বিদ্যমান। মিনারভা ম্যাকগোনাগল নামের উৎপত্তির গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ ও অর্থবহুল। গ্রিক দেবী অ্যাথেনাকে রোমানরা মিনারভা বলে ডাকত। যিনি ছিলেন সাহস, ন্যায়বিচার ও সমরকৌশলের দেবী। মিনারভা প্রকৃতপক্ষেই দেবী অ্যাথেনার প্রতিটা গুণের স্ফুরণ ঘটিয়েছেন নিজের মাঝে, যার প্রমাণ আমরা কাহিনীর প্রত্যেক পরতে পরতে পেয়েছি।

ম্যাকগোনাগল শব্দটার উৎপত্তি কেল্টিক ভাষার শব্দ Conegal থেকে। অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় দুঃসাহসীর সন্তান। তবে মিনারভার নামের পরের অংশ এখান থেকে নেয়া হয়নি। এই ম্যাকগোনাগল নামটা জে. কে. রোলিং নিয়েছেন স্কটিশ কবি উইলিয়াম টোপাজ ম্যাকগোনাগল থেকে। কবি হিসেবে যুক্তরাজ্যে কখনোই তিনি প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত আলো ছড়াতে পারেননি। মিনারভা ম্যাকগোনাগল স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে, তার নামটাও রাখা হয়ে এক স্কটিশ কবির নামানুসারেই।

গ্রীক দেবী অ্যাথেনা; Image Source: Duy Anh Do/ArtStation

ছিলেন হাফ-ব্লাড

১৯৩৫ সালের ৪ অক্টোবর মাগল পিতা রবার্ট ম্যাকগোনাগল এবং নারী জাদুকর ইসোবেল রোসের কোল আলো করে স্কটল্যান্ডে জন্ম নেন মিনারভা ম্যাকগোনাগল। পিতা মাগল এবং মাতা জাদুকর হওয়ায় তিনি ছিলেন একজন হাফ-ব্লাড উইচ। ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। বাকি দুজন হলেন যথাক্রমে ম্যালকম ম্যাকগোনাগল এবং রবার্ট জুনিয়র ম্যাকগোনাগল। তার নামটা রাখা হয়েছে তার মায়ের নানীর নামানুসারে। তিনি ছিলেন তার সময়ের সেরা কয়েকজন জাদুকরের মধ্যে অন্যতম এবং খুবই শক্তিশালী একজন জাদুকর। মিনারভা ম্যাকগোনাগলের জন্মের পর তার পরিবার স্কটিশ হাইল্যান্ডের ক্যাইথনেসের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। সেখানে জাদুকরদের সংখ্যা ছিল একেবারে হাতে গোনা, মাগলের সংখ্যাই ছিল বেশি।

শিল্পীর তুলিতে মিনারভা ম্যাকগোনাগলের পরিবার; Image Source: Nenja5/DeviantArt

ট্রান্সফিগারেশনে পুরস্কার প্রাপ্তি

ছাত্রজীবনে মিনারভা ম্যাকগোনাগল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং দায়িত্বশীল একজন শিক্ষার্থী। নিজ ইউনিফর্মে তিনি ঝুলিয়েছিলেন প্রিফেক্ট এবং হেড গার্লের ব্যাজ। O.W.L and N.E.W.T এক্সামে তিনি টপ গ্রেড বাগিয়ে সকলের ঈর্ষায় পরিণত হয়েছিলেন। গ্রাজুয়েশনের পূর্বে তিনি তার সাফল্য মুকুটে যুক্ত করেছিলেন অর্জনের আরও এক উজ্জ্বল পালক। সেটা ছিল, বহুল প্রতীক্ষিত Transfiguration Today: Most Promising Newcomer Award।

প্রথম বর্ষ থেকেই ট্রান্সফিগারেশনে মুনশিয়ানা দেখাতে শুরু করেছিলেন তিনি। তার জাদুর ছড়ি ছিল দেবদারু কাঠের তৈরি। ছড়ির কেন্দ্র ছিল ড্রাগনের কলিজার রস দ্বারা নির্মিত। এমনকি ছড়ি বিক্রেতা অলিভেন্ডারও বলেছিলেন, তার এই ছড়ি ট্রান্সফিগারেশনের জন্য একেবারে খাপে খাপ! ট্রান্সফিগারেশনের শিক্ষা-দীক্ষা তিনি নিয়েছিলেন সময়ের অন্যতম সেরা জাদুকর অ্যালবাস ডাম্বলডোরের কাছ থেকে, একেবারে হাতে কলমে। ডাম্বলডোরও ছিলেন ট্রান্সফিগারেশনে তুখোড় মাপের একজন জাদুকর। হগওয়ার্টসে অধ্যয়নকালে তিনি একটি ম্যাগাজিনে এই ট্রান্সফিগারেশন নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। ডাম্বলডোর এবং ম্যাকগোনাগল উভয়েই সেই ম্যাগাজিনটি পড়ছেন, এর উল্লেখ আছে হ্যারি পটার সিরিজ এবং ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হোয়ার টু ফাইন্ড দেম-এ।

প্রফেসর স্প্রাউটের সাথে সখ্যতা

১৯৪৭ সালে হগওয়ার্টস স্কুল অভ উইচক্র‍্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রিতে ভর্তির পর মিনারভা ম্যাকগোনাগল হাউজ গ্রিফিন্ডরের জন্য নির্বাচিত হন। হগওয়ার্টসে অধ্যয়নকালে মিনারভার সাথে হাউজ হাফলপাফের শিক্ষার্থী পমোনা স্প্রাউটের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তবে তারা একই ব্যাচের ছিলেন না। পমোনা যখন সবে হগওয়ার্টসের দোরগোড়ায় পা রেখেছেন, মিনারভা তখন হগওয়ার্টসের প্রবীণ, ষষ্ঠ বছরের শিক্ষার্থী। মিনারভা গ্রাজুয়েশনের পাঠ চুকানোর আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের বন্ধন অত্যন্ত শক্ত ছিল। পরবর্তীতে গ্রাজুয়েশনের পর দুজনই অবশ্য শিক্ষক হিসেবে আবার হগওয়ার্টসে যোগ দেয়ার পাশাপাশি হাউজ প্রধান হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। হার্বোলজির শিক্ষক হিসেবে পমোনা নিজ পেশা বেছে নেয়ার পর তাকে হাউজ হাফলপাফের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বলা বাহুল্য, মিনারভা অবশ্যই শিক্ষকতার বিষয় হিসেবে ট্রান্সফিগারেশনকে বেছে নেয়ার পাশাপাশি হাউজ গ্রিফিন্ডরকে নিজ হাতে শাসন করেছেন।

মিনারভা ম্যাকগোনাগল এবং পমোনা স্প্রাউট; Image Source: Warner Bros.

বইয়ের সর্বপ্রথম জাদুকরী চরিত্র

হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বই হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার’স স্টোন  কাহিনীর শুরুটা হয়েছিল ডার্সলি পরিবারের পরিচিতি দিয়ে। কিন্তু জাদুকর হিসেবে সবার প্রথমে হ্যারি পটার সিরিজে ইন্ট্রোডাকশন করা হয়েছে সকলের প্রিয় জাদুকর মিনারভা ম্যাকগোনাগলকে। তার সাক্ষাৎ পাঠকেরা অগোচরেই পেয়েছে প্রিভেট ড্রাইভের প্রথম অঙ্কেই। গাড়িতে চড়ে অফিসে যাবার সময় ভারসন ডার্সলি জানালা দিয়ে দেখলেন রাস্তায় একটি বিড়াল মানচিত্র পড়ছে। একটু পর প্রিভেট ড্রাইভের কোনায় আরও একটি বিড়াল তার চোখে পড়েছিল, তবে সেটার কাছে কোনো মানচিত্র ছিল না। মি. ডার্সলি যে বিড়ালের দেখা পেয়েছিলেন, সেটা ছিল মূলত মিনারভার ছদ্মবেশ।

বিড়ালরূপী মিনারভা; Image Source: Warner Bros.

ডাম্বলডোরের আগমনের আগ পর্যন্ত কেউ জানত না, এই বিড়ালটাই যে মিনারভা ম্যাকগোনাগল। পাঠক যখন শুধু হ্যারি পটারের জাদুর জগতে নিজেকে মিশিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই জাদুর ছড়ি, পোশন, বা অদৃশ্য আলখাল্লা ছাড়াই মিনারভা পাঠকদের উপহার দিয়েছিলেন রূপান্তরের এক জাদুকরী আভাস। তবে সশরীরে উপস্থিত হওয়া প্রথম জাদুকর ছিলেন অ্যালবাস ডাম্বলডোর, এরপরেই দ্বিতীয় জাদুকর হিসেবে মিনারভা ম্যাকগোনাগলের অবস্থান।

অ্যালবাস ডাম্বলডোরের সাথে মিনারভা ম্যাকগোনাগল; Image Source: Warner Bros.

মাগলের সাথে মন বিনিময়

মিনারভার ছাত্রজীবন সাফল্যমণ্ডিত ও ঝকঝকে সুন্দর হলেও, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন বেশ অসুখী। গ্রাজুয়েশনের পর ব্রিটিশ জাদু মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অভ ম্যাজিক্যাল ল’ এনফোর্সমেন্ট বিভাগ থেকে চাকরির অফার আসলো তার কাছে। চাকরিতে যোগ দেবার আগে তিনি ভাবলেন পরিবারের সাথে একটু সময় কাটিয়ে আসবেন। সেজন্য গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি স্কটল্যান্ডে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। সেসময় আঠারো বছর বয়সী মিনারভার পরিচয় ঘটে সেখানকার এক স্থানীয় কৃষকের ছেলে ডৌগাল ম্যাকগ্রেগরের সাথে। দেখতে বেশ সুদর্শন ও সর্বদা হাসিখুশি থাকা ছেলেটি ছিল একজন মাগল। মিনারভা অল্প সময়েই সেই ছেলের প্রেমের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যান।

একদিন চষা এক জমিতে মিনারভাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে ডৌগাল। মিনারভাও সাদরে গ্রহণ করে নেয় এই প্রেম প্রস্তাব। কিন্তু সে রাতে এক গভীর দুশ্চিন্তা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমাতে থাকে মিনারভার কপালে। সে যে একজন জাদুকর তা ছেলেটি জানত না। তাই মাগল ছেলেটিকে বিয়ে করলে, তার এই জাদুকরী ক্ষমতার কথা সারাজীবন ছেলেটির কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। জাদু সম্পর্কিত সকল কিছু ইতি টানতে হবে এখানেই। সে যন্ত্রণা তার নিজ মাকেই ভোগ করতে হয়েছে চরমভাবে। আর জাদু মন্ত্রণালয় যদি জানতে পারে সে কোনো মাগলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, তবে সাথে সাথে তাকে চাকরীচ্যুত হতে হবে।

তাই পরদিন সকালে মিনারভা সেই ছেলেকে জানিয়ে দেয়, সে তাকে বিয়ে করতে পারবে না। এর তিনদিন পর ভগ্নহৃদয়ে নিয়ে লন্ডনে চলে আসে মিনারভা। ডৌগালকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসতো বলে, ভালোবাসার অনলে সে পুড়তে থাকে কয়েকটা মাস। মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বলা যায়, এই ক’টা মাস ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়।

যুবতী মিনারভা ম্যাকগোনাগল; Image Source: Harry Potter Fandom

মন্ত্রণালয়ে প্রথম চাকরি

লন্ডনে পৌঁছানোর পর, এলফিনস্টোন আরকার্ট ব্রিটিশ জাদু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মিনারভাকে একটি চাকরির অফার দেন। তখন তিনি যোগ দেন মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় বিভাগ ডিপার্টমেন্ট অভ ম্যাজিক্যাল ল এনফোর্সমেন্ট-এ। ধারণা করা হয়, তিনি ‘অরোর অফিস’ (যেখানে পরবর্তীতে হ্যারি আর রন যোগ দিয়েছিল) বা মিস-ইউজ অভ মাগল আর্টেফ্যাক্টস অফিসে (যেখানে আর্থার উইজলি কাজ করতেন) যোগদান করেছিলেন। আরমান্ডো ডিপেট হগওয়ার্টসের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অব্যাহতি নিলে, সে পদে আসীন হন অ্যালবাস ডাম্বলডোর। তিনি মিনারভাকে তখন হগওয়ার্টসে ট্রান্সফিগারেশনের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মন্ত্রণালয়ে দুই বছর কাজ করার পর তিনি হগওয়ার্টসে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।

ব্রিটিশ জাদু মন্ত্রণালয়ের লোগো; Image Source: Harry Potter Fandom

বিয়ে

একবার এলফিনস্টোন স্কটল্যান্ডে ছুটি কাটাতে আসার পর মিনারভার সাথে দেখা করেছিলেন। সেখানে তিনি ম্যাডাম পুডিফুটের চায়ের দোকানে মিনারভাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মিনারভা তখনো ম্যাকগ্রেগরের প্রেম উপাখ্যান পুরোপুরি ভুলতে পারেননি। সেজন্য তাকে একপ্রকার বাধ্য হয়ে সে প্রস্তাব নাকচ করে দিতে হয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি আরকার্ট, তিনি আরও বেশ কয়েকবার প্রস্তাব দেন মিনারভাকে। এরই কিছুদিন হঠাৎ একদিন মারা যায় ম্যাকগ্রেগর। দিন গড়িয়ে যাবার যাবার সাথে বিচ্ছেদের শোক ক্রমশ উবে যেতে থাকে মিনারভার মন থেকে। একসময় তিনি আরকার্টের প্রেম প্রস্তাবে রাজি হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান।

বিয়ের পর তিনটা বছর বেশ সুখে-শান্তিতেই কেটেছিল তার। আরকার্ট হগসমিডে একটা ঘর কিনে নেয়, যেখানে মিনারভার ভাইঝি এবং ভাইপো প্রায় সময়ই বেড়াতে আসত। কিন্তু তার কপালে সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ভেনোমাস টেন্টাকুলার আঘাতে প্রাণ হারায় তার স্বামী আরকার্ট। এরপর তিনি হগসমিডের ওই ঘর ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য চলে আসেন হগওয়ার্টসের আঙিনায়। যেখানে তিনি তার বাকি জীবনটা অতিবাহিত করেছেন।

শিল্পীর তুলিতে মিনারভা এবং আরকার্ট; Image Source: Quotev

দ্য অর্ডার অভ মারলিন: ফার্স্ট ক্লাস

যে সকল জাদুকর খ্যাতির চূড়ায় আহরণ করে, মেধা, সাহসিকতা ও সৃজনশীলতা দ্বারা অভাবনীয় সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারে, তাদেরকে ‘দ্য অর্ডার অভ মার্লিন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। মিনারভা ম্যাকগোনাগল এই ‘দ্য অর্ডার অভ মার্লিন: ফার্স্ট ক্লাস’ ক্যাটাগরিতে র‍্যাঙ্কভুক্ত ছিল। ডার্ক উইজার্ড গ্রিন্ডেলওয়াল্ডকে হারানোর ফলে এই ফার্স্ট ক্লাস অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল জাদুকর অ্যালবাস ডাম্বলডোরও। জানাশোনার মধ্যে বাকিরা হলো নিউট স্ক্যামান্ডার, যিনি জাদুকরী প্রাণী নিয়ে গবেষণায় সেকেন্ড ক্লাস অর্জন করেছিলেন। রেমাস লুপিনও ফার্স্ট ক্লাস উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন, তবে সেটা তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে। ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের প্রতি পাঁড় আনুগত্যের দরুন তিনি এই খেতাবে ভূষিত হন।

চাঁদের গায়ে যেমন কলঙ্ক থাকে, তেমনি এই অর্ডার অভ মার্লিন নিয়েও আছে নেতিবাচকতা। এটি নানা সময়ে জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের। যেমন, কর্নেলিয়াস ফাজ নিজেই নিজেকে ফার্স্ট ক্লাস অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে বসেন। এমনকি বিশ্বাসঘাতক পিটার পেট্টিগ্রু পর্যন্ত সিরিয়াস ব্ল্যাকের সাথে যৌথভাবে এই পুরষ্কার জিতেছিলেন। সিরিয়াস ব্ল্যাকের পূর্বপুরুষ তৃতীয় আর্কটারাস মন্ত্রণালয়কে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে এই পুরষ্কার নিজ ঝুলিতে পুরেছিলেন।

দ্য অর্ডার অব মার্লিন পুরষ্কার; Image Source: Harry Potter Fandom

মিনারভা ম্যাকগোনাগল চরিত্রের কুশীলব

ইংরেজ অভিনেত্রী ম্যাগি স্মিথ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজিতে অভিনয় করে গেছেন, প্রাণ দিয়েছেন মিনারভা ম্যাকগোনাগল চরিত্রটাকে। চরিত্রটার প্রতি তার আত্মোৎসর্গ ছিল অনন্য ধাঁচের।

মিনারভা ম্যাকগোনাগল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ম্যাগি স্মিথ; Image Source: Hip wallpaper

২০০৭ সালে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালেও তিনি ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ-ব্লাড প্রিন্স’  সিনেমায় প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন। কেমিওথেরাপির ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছেন শুটিং সেটে। তার এই ডেডিকেশন অবশ্যই শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে পটারহেডরা। এছাড়াও যুবতী শিক্ষক হিসেবে মিনারভা এক ঝলক দেখা দিয়েছেন হ্যারি পটার সিরিজের প্রিকুয়েল ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস: দ্য ক্রাইমস অভ গ্রিন্ডেলওয়াল্ড  সিনেমায়। ওই সিনেমায় মিনারভা ম্যাকগোনাগল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফিয়োনা গ্ল্যাসকট।

‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস: ক্রাইমস অব গ্রিন্ডেলওয়াল্ড’ সিনেমায় মিনারভা ম্যাকগোনাগল; Image Source: Warner Bros.

অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স

যাদু জগতের প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীন অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সে পুরোপুরি যোগ দেননি মিনারভা। সেসময় অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সকে বিশ্বাসঘাতক, দলত্যাগী, পক্ষ পরিবর্তনকারী ইত্যাদি হিসেবে ভাবা হতো। সেজন্য মিনারভা ডার্ক লর্ডের পরাজয় এবং অরোরদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে জাদু মন্ত্রণালয়ের দিকে নজর দিয়েছিলেন। বিড়ালের রূপ ধরে তিনি একজন গুপ্তচর হিসেবে ভলডেমর্টের গতিবিধির উপরে নজর রাখতেন। তারপর অরোরদের বিভিন্ন গোপন তথ্য পাচারের মাধ্যমে সাহায্য করতেন। তিনি অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সে যোগ দিয়েছিলেন মূলত জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসে তিনি কিংসলি শ্যাকলবোল্ট, হোরেস স্লাগহর্নকে সাথে নিয়ে হগওয়ার্টসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সামলেছেন।

হ্যারির পিতা-মাতার সাথে সম্পৃক্ততা

এই ব্যাপারটি মজার। মিনারভা যেমন হ্যারি পটারকে পড়িয়েছেন, তেমনি পড়িয়েছেন হ্যারি পিতা-মাতা জেমস পটার এবং লিলি ইভান্সকেও। এবং হ্যারির মতো তারা দুজনও মিনারভার প্রিয় শিক্ষার্থীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। ম্যাকগোনাগল হগওয়ার্টসে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন ১৯৫৬ সালের দিকে। জেমস পটার এবং লিলি ইভানসকে তিনি ছাত্র হিসেবে পড়াতে পেরেছেন। কারণ তারা হগওয়ার্টসে ভর্তি হয়েছিল ৭০ এর দশকে। হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোস পার্ট ২ মুভিতে এরকম একটা দৃশ্য ছিল যে, মিনারভা লিলি ইভানসের মাথায় সর্টিং হ্যাট ধরে আছেন।

লিলি ইভান্সের মাথায় সর্টিং হ্যাট ধরে আছেন মিনারভা ম্যাকগোনাগল; Image Source: Warner Bros.

জীবন্ত দাবার ঘুঁটি

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার স্টোন এ হ্যারি, রন এবং হারমায়োনি পরশপাথর উদ্ধারের সময় বিভিন্ন জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। প্রতিটা ধাঁধা ও বাধা পেরোতে তাদেরকে দারুণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। অ্যালবাস ডাম্বলডোর প্রফেসর স্নেইপ, মিনারভা, এবং কুইরেলের সহায়তায় এসব ফাঁদ তৈরি করেছিলেন।

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন মুভিতে দেখানো জীবন্ত দাবাঘর; Image Source: Warner Bros.

যারা হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন মুভিটা দেখেছে, তারা শেষদিকের জীবন্ত দাবার বোর্ডের অংশটার সাথে পরিচিত। এই দাবাগুলোকে জীবন্ত মূর্তিতে রূপান্তর করেছিলেন ট্রান্সফিগারেশন মাস্টার মিনারভা ম্যাকগোনাগল।

 

 

Related Articles