Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিতিন মাসি: বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নারী গোয়েন্দা

ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কাকাবাবু, শবর, কিরীটী, কর্নেল, বরদা, ঋজুদা, একেন বাবু, অর্জুন, পরাশর ভার্মা, বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মানিক, পাণ্ডব গোয়েন্দা, মোহন, অশোক ঠাকুর, গোগোল কিংবা কিকিরা — বাংলা সাহিত্যে এত এত গোয়েন্দা চরিত্র যে, গুনে শেষ করা বড্ড মুশকিল। তালিকা করতে বসে কত নামই যে বাদ পড়ে যায়, আর তাতে মুখ ভার হয় ওইসব চরিত্রের ভক্তদের।

তারপরও এখানে এক নিঃশ্বাসে যে কয়টি নাম করেছি, তাদের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন কী? আপনি যদি গোয়েন্দা কাহিনীর ভক্ত হন, তাহলে আপনার পর্যবেক্ষণশক্তি অবশ্যই আপনার প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রদের মতোই তীক্ষ্ণ। আর তাই আপনার এতক্ষণে এ কথা বুঝে যাওয়ার কথা যে, পাণ্ডব গোয়েন্দার বাচ্চু, বিচ্ছুকে বাদ দিলে কোনো মেয়ে বা নারী গোয়েন্দার নাম আমি আনিনি।

বাংলা সাহিত্যে রয়েছে অজস্র গোয়েন্দা চরিত্র; Image Source: neerbasona.wixsite.com

এ কথা খুবই সত্য যে, বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা চরিত্রের যেরকম আধিক্য, সে তুলনায় নারী গোয়েন্দার উপস্থিতি তেমন একটা নেই। তাই বলে বাংলা সাহিত্যে নারী গোয়েন্দা চরিত্র একদমই নেই, তা বললেও অবশ্য ভুল হবে। তপন বন্দোপাধ্যায়ের গার্গী, নলিনী দাশ রচিত গোয়েন্দা গণ্ডালুর কালু, মালু, টুলু আর বুলু, অজিতকৃষ্ণ বসুর নন্দিনী সোম, মনোজ মিত্রের দয়মন্তী সেন, অদ্রীশ বর্ধনের নারায়ণী, অঞ্জন মান্নার অরঝরা বসু কিংবা প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর কৃষ্ণা ও শিখা — এরা সকলেই বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নারী গোয়েন্দা চরিত্র।

তবে উল্লেখযোগ্য হলেও জনপ্রিয় যে নয়, সে কথাও স্বীকার করে নিতে আপত্তি নেই। আপনি নিজেই ভেবে দেখুন, এদের মধ্যে কজনের রহস্যভেদের কাহিনী আপনি পড়েছেন, কিংবা নিদেনপক্ষে নামটা শুনেছেন। তাই ঘুরেফিরে সেই আগের কথাতেই ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলা সাহিত্যে সত্যিই বিপুলসংখ্যক পাঠক সৃষ্টিতে সক্ষম নারী গোয়েন্দা চরিত্রের দেখা খুব একটা মেলেনি।

ব্যতিক্রম কেবল একটি নারী চরিত্রই। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সৃষ্টি, মিতিন মাসি। সাকুল্যে মাত্র ১৯টি উপন্যাস ও বড় গল্পে আমরা দেখা পেয়েছি মিতিন মাসির। সংখ্যাটা আরো বাড়তে পারত, যদি না ২০১৫ সালের ১২ মে হাজারো ভক্ত-পাঠককে চোখের জলে ভাসিয়ে ইহলোক ত্যাগ করতেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। কিন্তু তারপরও, বিদ্যমান ১৯টি কাহিনীও কিন্তু একেবারে কম নয়। কেননা এই ১৯টি কাহিনীর মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে নিজের স্বকীয় অবস্থান গড়ে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে মিতিন মাসি। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তমনস্ক পাঠক, সকলের কাছ থেকেই কমবেশি গ্রহণযোগ্যতা ও ভালোবাসা কুড়িয়েছে সে। তাই তো খুব শীঘ্রই বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে রূপালী পর্দায়ও দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যাবে তাকে।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নারী গোয়েন্দা চরিত্র মিতিন মাসি; Image Source: ABP

মিতিন নামটি শোনামাত্রই হয়তো আপনার দিব্যদৃষ্টি কোনো শাণিত চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত যুবতী গোয়েন্দাকে কল্পনা করবে না। বাঙালি পরিবারে এমন আদুরে ডাকনামের কত মেয়েই তো রয়েছে। কিন্তু হ্যাঁ, ফেলু মিত্তির নাম থেকে যেমন প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের মস্তিষ্কের ধূসর কোষ আর টেলিপ্যাথির জোর বোঝার জো নেই, মিতিন নামটি থেকেও হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না, এ নামের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বেশ রাশভারি একটি পোশাকি নাম: প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রজ্ঞাপারমিতা হলো জ্ঞানের দেবী। এবং আমাদের প্রজ্ঞাপারমিতা তথা মিতিন মাসির জ্ঞানেরও সত্যিই কোনো তুলনা হয় না। ফরেনসিক বিজ্ঞান, অপরাধীদের মনঃস্তত্ত্ব, আধুনিক কিংবা প্রাচীনকালের অস্ত্রশস্ত্রের খুঁটিনাটি, দেশ-বিদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-লোককথা, শারীরবিদ্যা, ধর্মশাস্ত্র; মোটামুটি নিজের কাজে প্রয়োজন এমন সকল বিষয়েই রয়েছে তার অগাধ জ্ঞান। আবার রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চা সামলানোর মতো তথাকথিত ‘মেয়েলি’ কাজগুলোতেও তার চমৎকার হাত। অর্থাৎ রান্না ও চুল বাঁধা দুটোতেই সে অলরাউন্ডার।

এদিকে গোয়েন্দাদের তো শুধু মস্তিষ্ককে সচল রাখলেই চলে না। সেই সাথে সমান প্রয়োজনীয় শারীরিক সুস্থতাও। আর সেজন্য শরীরচর্চার বিকল্প কী! মধ্য ত্রিশের মিতিন মাসি তাই নিয়মিত শরীরচর্চা করে নিজেকে ফিট রাখতে। ক্যারাটের প্যাঁচ পয়জারগুলো তার বেশ ভালোই নখদর্পণে। এমনিতে স্বভাবে সে শান্ত, কিন্তু শত্রুকে ঘায়েল করতে মারপিটেও তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। নিজের সাথে একটি রিভলবারও রাখে সে।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গোয়েন্দাদেরও তো আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সখ্য গড়ে তুলতে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে। এ কথাও মিতিন মাসির ভালোই জানা। তাই সে নিজেই গাড়ি চালায়, কম্পিউটার চালানোটাও খুব ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছে, আর স্মার্টফোনের যুগে সবসময় একটি ওই বস্তুও নিজের সাথেই রাখে।

মিতিন মাসির সাথে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের বেজায় মিল। নিছকই রহস্যের সমাধান তার উদ্দেশ্য নয়, বরং সে চায় যেকোনো ঘটনাকে তলিয়ে দেখে সেটির পেছনের প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে। দেবী দুর্গার কপালের ঠিক মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করে তৃতীয় নয়ন। এই তৃতীয় নয়নের মাঝেই নাকি লুকিয়ে থাকে দেবীর দিব্যদৃষ্টি। এই তৃতীয় নয়নই আলোর পথ দেখায়, সত্যের সন্ধান দেয়। তাই সত্য উদ্ঘাটনের জন্য মিতিন মাসিও যখন প্রথম তার ডিটেক্টিভ এজেন্সি খুলেছিল, সেটির নাম দিয়েছিল তৃতীয় নয়ন। পরে অবশ্য তৃতীয় নয়ন ভাষান্তরের মাধ্যমে হয়ে যায় থার্ড আই।

মিতিন মাসির রয়েছে থার্ড আই নামের গোয়েন্দা সংস্থা; Image Source: Anandamela

মিতিন মাসির প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বড়দের জন্য লেখা উপন্যাসে। ‘পালাবার পথ নেই’ নামক সেই উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে। এছাড়াও ‘বিষ’, ‘মারণ বাতাস’, ‘তৃষ্ণা মারা গেছে’ এবং ‘মেঘের পরে মেঘ’-ও প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য লেখা উপন্যাস ও বড়গল্প। সেগুলোতে মিতিন মাসির সহকারী হিসেবে ছিল তার স্বামী, পার্থ মেসো। তবে পার্থ মেসোর মূল কাজ কিন্তু মিতিন মাসির সহকারী হিসেবে নয়। তার নিজের একটি প্রেস রয়েছে, সেখানেই তার কর্মজগৎ। মিতিন মাসির পসার যতদিন জমেনি, ওই প্রেস থেকে উপার্জিত অর্থেই চলত তাদের সংসার।

পার্থমেসো দারুণ মজার চরিত্র। বাঙালিরা যে কতটা খাদ্যরসিক হতে পারে, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ সে। সারাক্ষণই তার মাথায় ঘুরতে থাকে খাবারের চিন্তা। তার খাবারের বিবরণ পড়লে যে কারো জিভে জল আসতে বাধ্য। আবার প্রয়োজনে নিজেও দিব্যি রান্না করতে পারে সে। পুরনো কলকাতার ইতিহাস বিষয়েও তার প্রচণ্ড কৌতূহল। খবরের কাগজ পেলেই বসে যায় শব্দজব্দ কিংবা সুডোকু মেলাতে। বিভিন্ন ছুটিতে নিজেই উপযাচক হয়ে দূর-দূরান্তে ট্যুরের আয়োজন করতেও তার জুড়ি নেই। আর জ্ঞান বিতরণের সুযোগ পেলেই হয়েছে। ভ্রান্ত-অভ্রান্ত মিলিয়ে মিশিয়ে ঠিক একটা তত্ত্ব খাড়া করে ফেলতে পারবে। নিজের কল্পনাবিলাসী মনকে কাজে লাগিয়ে মিতিন মাসির বিভিন্ন কেসেরও এক বাক্যে ইতি টেনে দিতে পারে সে, যদিও বাস্তবের সাথে সেগুলোর মিল খুব কম ক্ষেত্রেই থাকে।

যা-ই হোক, এবার আসা যাক টুপুরের প্রসঙ্গে। বড়দের জন্য রচিত গল্পগুলোয় সে ছিল না। তার আবির্ভাব পুজোসংখ্যা আনন্দমেলা ২০০২-এ প্রকাশিত ‘সারাণ্ডায় শয়তান’ উপন্যাসে। সেটি ছিল শিশু-কিশোরদের জন্য মিতিন মাসির প্রথম কাহিনী। এবং তারপর থেকেই মিতিন মাসি সিরিজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয় টুপুর। কাহিনীর বিবরণ তৃতীয় পুরুষের ভাষ্যে হলে কী হবে, সেগুলো বিবৃত হতে থাকে এই টুপুরের দৃষ্টিকোণ থেকেই। কেননা লেখিকার টার্গেট রিডাররাও যে টুপুরের বয়সীই!

টুপুরের ভালো নাম ঐন্দ্রিলা। মিতিন তারই মাসি, আর সে মিতিনের বোনঝি। ফেলুদায় যেমন তোপসে, কিংবা কাকাবাবুতে সন্তু, মিতিন মাসি সিরিজে টুপুরও ঠিক তেমনই। স্কুলপড়ুয়া এই কিশোরীর কাছে মিতিন মাসিই সবচেয়ে বড় আইডল। মিতিন মাসির সঙ্গী হয়ে রহস্যের পেছনে ছুটে বেড়াতে তার বেজায় ভালো লাগে। আরো বেশি ভালো লাগে, যখন বড়দের কাছেও মিতিন মাসি তাকে নিজের সহকারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।

জীবন বাজি রেখে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিতিন মাসি; Image Source: Anandamela

স্কুলে ছুটি শুরু হতেই মাসির বাড়িতে চলে আসে টুপুর। আর কীভাবে কীভাবে যেন, ঠিক তখনই জমজমাট সব রহস্য এসে হাজির হয় মিতিন মাসির দোরগোড়ায়। কিংবা দল বেঁধে কোথাও বেড়াতে গেলেও, ঠিকই নিজের অজান্তে বিভিন্ন কেসের সাথে জড়িয়ে পড়ে মিতিন মাসি। তখন গম্ভীর হয়ে যায় মিতিন মাসি, পুরো ‘স্পিকটি নট’! তারপরও মাঝেমধ্যে দেখা যায় কেস নিয়ে মাসি-বোনঝি আলোচনায় মেতেছে। কিংবা কেসের প্রয়োজনে কোথাও যাবার প্রয়োজন হলেও মিতিন মাসি আর কাউকে না, শুধু টুপুরকেই সাথে নেয়। পার্থমেসোর তখন একটু ঈর্ষাও বুঝি হয় যে তাকে সরিয়ে দিয়ে মিতিন মাসির সহকারীর পদটা দখল করে নিয়েছে টুপুর। নিজের সেই ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ সে ঘটায় মিতিন-টুপুরকে খোঁচা মেরে, কেস সম্পর্কিত নানা রঙ্গ-তামাশা করে।

মিতিন মাসি সিরিজে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথমেই আসবে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আই জি অনিশ্চয় মজুমদারের নাম। শুরুতে অবশ্য তার নাম ছিল অনিশ্চয় তালুকদার। তালুকদার কীভাবে মজুমদার হলো, সেটিও একটি রহস্যজনক ঘটনাই বটে। তবে যা-ই হোক, এই মানুষটিও পার্থমেসোর মতোই খাদ্যরসিক। আর খুব দিলদরিয়াও বটে। মিতিন মাসির যখনই কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়, অকৃপণভাবে সাহায্য করে সে। আবার কখনো কখনো সে নিজেও আসে মিতিন মাসির কাছে সাহায্য চাইতে।

মিতিন মাসির ছেলে বুমবুমের কথাও ভুললে চলবে না। চিপস খেতে আর ভিডিও গেম খেলতে ভালোবাসে সে। পাকা পাকা কথা বলে। মিতিন মাসি আর টুপুর যখন কেস নিয়ে কথা বলে, তখন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সে। কী শুনছিস জানতে চাইলে বলে, কেসটা নাকি স্টাডি করছে! বড়দের কথাগুলো ‘ক্যাচ’ করতে পারার এমনই সহজাত প্রবৃত্তি তার। কে জানে, বড় হলে সে-ও হয়তো মায়ের মতোই নামকরা গোয়েন্দা হবে।

এদিকে মিতিন মাসিদের বাড়িতে কাজ করা ও বুমবুমের দেখভালের জন্য রয়েছে আরতি। তার সাথে মিতিন মাসির কথোপথনের জায়গাগুলো থেকেই আঁচ করা যায়, মানুষ হিসেবে মিতিন মাসি কতটা ভালো। নিজে কোনো কেসের বিষম প্যাঁচে জড়িয়ে দিশেহারা হয়ে আছে, তবু আরতির সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করছে, তার শাশুড়ির শরীর কেমন, ডাক্তার কী বলল, ইত্যাদি। এরকম খুচরো সব ঘটনাই গোয়েন্দা মিতিন মাসিকে পাঠকের বড় আপনার করে তোলে।

ইতিহাসের সাথে সমসাময়িকের চমৎকার সংমিশ্রণ ঘটেছে মিতিন মাসি সিরিজে; Image Source: Amitabh Chandra/Anandamela

আর আছে টুপুরের বাবা অবনী ও মা সহেলি। অবনী কলেজের গম্ভীর অধ্যাপক। বেজায় আলসে। কোথাও বেড়াতে গেলে সাথে করে ঢাউস সাইজের বই আর দাবার বোর্ড নিয়ে যায় সঙ্গে করে। কোনো কাজে হাত লাগায় না, কোথাও ঘুরতে যেতেও চায় না। শুধু চায় হোটেল রুমে বসে বই পড়তে বা দাবা খেলতে। তবে ইতিহাসের প্রতি বিশেষ ঝোঁক রয়েছে তার। অন্যদিকে সহেলিও বোন মিতিনের থেকে একদমই বিপরীত স্বভাবের। বেড়াতে গিয়ে মিতিন রহস্যে জড়িয়ে পড়ছে, এ বিষয়টি তার একদমই সহ্য হয় না। মেয়ে টুপুর কেন সবসময় মিতিনের সাথে সাথে, এ নিয়েও তার আপত্তি। নিজে স্বামীর মতোই আরামপ্রিয়। ঐতিহাসিক নিদর্শনের চেয়ে ধর্মীয় স্থান ঘুরতে ভালোবাসে। আর ভালোবাসে সবখানে গিয়ে দরদাম করে এটা-ওটা কিনতে, আর কলকাতায় ফিরে এসে সেগুলো দিয়ে ঘর সাজাতে।

মিতিন মাসির বাসা আধুনিক ঢাকুরিয়ায়। আর টুপুরদের, অর্থাৎ অবনী-সহেলিদের বাসা উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে। কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে বারবারই উঠে আসে ঢাকুরিয়া ও হাতিবাগানের প্রসঙ্গ, এবং তার মাধ্যমে প্রকট হয়ে ওঠে কলকাতা শহরের দুই অংশের জীবনযাত্রার মধ্যকার ফারাকগুলো।

মিতিন মাসির কাহিনীতে পারিবারিক বন্ধন রয়েছে একটি বড় জায়গা জুড়ে। কলকাতার উচ্চ-মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের চিত্র খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। তার অন্যান্য উপন্যাসে মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা ক্লেদ-কলুষতা দেখানো হলেও, এই সিরিজে মিতিন মাসি ও টুপুরদের দুইটি পরিবারের মাধ্যমে ইতিবাচক দিকগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নেতিবাচক দিক যে একেবারেই নেই তা নয়। তবে সেগুলো কাহিনীর প্রয়োজনে আসা অন্যান্য চরিত্রদের পরিবারে।

দুই ধরনের পাঠকের কাছে মিতিন মাসি সিরিজটি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে। প্রথমত, ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ রয়েছে যাদের। দ্বিতীয়ত, ভ্রমণ করতে বা ভ্রমণকাহিনী পাঠ করতে ভালোবাসে যারা।

মিতিন মাসির প্রায় প্রতিটি কাহিনীতেই ঐতিহাসিক রেফারেন্সের ছড়াছড়ি। কলকাতা শহরটি যে ঐতিহাসিকভাবে ঠিক কতটা সমৃদ্ধ, আর তার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের কত চমকপ্রদ গলি-ঘুপচি, এই সিরিজটি না পড়লে তার অনেক কিছুই বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের অজানা থেকে যাবে। তাছাড়া কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাস করা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যেমন ইহুদী, আর্মেনিয়ান, পারসিক, চীনা, জৈনদের সম্পর্কে বহু মূল্যবান ও অজানা তথ্যও জানা যাবে এই সিরিজ থেকে। এক কালে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে নানা জাতের মানুষেরা এসে যে ভিড় জমাত কলকাতায়, এবং তাদের অস্তিত্বের ছাপ এই একবিংশ শতকে এসেও রয়ে গেছে কলকাতার বুক জুড়ে, তা ভেবে সত্যিই অবাক হতে হবে। আর সেই অতীতের সাথে সমসাময়িককে যেভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে, তা-ও এক কথায় অনবদ্য।

মিতিন মাসির সাথে হারিয়ে যাওয়া যাবে নিত্যনতুন সব গন্তব্যে; Image Source: Anandamela

আর ওই যে বললাম ভ্রমণের কথা। সত্যিই, মিতিন মাসি সিরিজটি পড়তে পড়তে কখনো হারিয়ে যাওয়া যাবে ঝাড়খণ্ডে, কখনো কেরালায়, কখনো হিমাচলে। এক ফাঁকে আবার উড়ে আসা যাবে সিঙ্গাপুর থেকেও। জমাটি রহস্যের সাথে প্রতিটি জায়গার এত সুন্দর ও প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা যে, আপনার মনে হতেই পারে এ বুঝি কোনো রহস্য-কাহিনী নয়, সাক্ষাৎ ট্যুর গাইড!

আপনি হয়তো কৈশোর ফেলে এসেছেন অনেক আগে। তাই ভাবছেন, এখন বুঝি আর মিতিন মাসিকে নিয়ে লেখা ছেলেমানুষি কাহিনীগুলো আপনার ভালো লাগবে না। কিন্তু সেটি একদমই ভুল ধারণা। মিতিন মাসিকে নিয়ে লেখা কয়েকটি কাহিনী তো পুরোদস্তুর প্রাপ্তমনস্কদের উপযোগী। আর কিশোর বয়সীদের জন্য লেখা কাহিনীগুলোও ঐতিহাসিক, সাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে এতটাই সমৃদ্ধ যে, পড়তে বসে বিরক্তবোধের সম্ভাবনা খুবই কম।

কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে মিতিন মাসির কিশোরপাঠ্য কাহিনীগুলো নিয়ে ‘মিতিন মাসি সমগ্র’। আর ২০১৯ সালের পুজায় আসতে চলেছে মিতিন মাসিকে নিয়ে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ‘মিতিন মাসি’। অরিন্দম শীলের পরিচালনায় সেই চলচ্চিত্রে মিতিন মাসির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কোয়েল মল্লিক। এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে মিতিন মাসি সিরিজের অন্যতম শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী ‘হাতে মাত্র তিনটে দিন’ অবলম্বনে। এর আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘শুভ মহরৎ’ ছবিতে মহিলা গোয়েন্দা হিসেবে ‘রাঙা পিসিমা’ চরিত্রটিকে দেখা গেছে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিচালক অরিন্দম শীল দাবি করছেন, মিতিন মাসিই হতে চলেছে বাংলা সিনেমায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ নারী গোয়েন্দা চরিত্র। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা, বইয়ের পাতার মিতিন মাসিকে পর্দায় কেমন লাগে!

আরও গোয়েন্দা গল্প পড়তে দেখে নিন এই বইগুলো

১) ফেলুদা সমগ্র

২) ব্যোমকেশ সমগ্র

বই-সিনেমা সংক্রান্ত চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about the fictional character, Mitin Mashi. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Arindam Sil

Related Articles