মোগল পরিবারের শেষ দিনগুলি: যে ইতিহাস কাঁদায়, যে ইতিহাস ভাবায়

মোগল সাম্রাজ্য; ভারতবর্ষের বুকে তিন শতাধিক বছর ধরে রাজত্ব করে যাওয়া এক সাম্রাজ্য, যে সাম্রাজ্যের সোনালী সময়ের অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সেসব দিনের কথা স্মরণ করে আজকের দিনে মানুষ কেবল বিস্মিতই হতে পারে, কখনও কখনও যা তার কাছে ঠেকে অবিশ্বাস্য কাহিনি হিসেবেও।

দুনিয়ার নিয়ম বড়ই কঠিন। আজ যার উত্থান হলো, সে যে চিরকালই সেই একই অবস্থায় থাকবে, তা কোনোকালই হয়নি। আরও স্পষ্ট করে বলে যায়- উত্থান হওয়া ব্যক্তি কিংবা তার পরবর্তী প্রজন্মের উদাসীনতা, খামখেয়ালী স্বভাব, কর্মবিমুখতা, নানাবিধ পাপাচার, ‘মুই কী হনু রে’ ঘরানার মানসিকতাসহ একই রকমের আরও কিছু বৈশিষ্টই তাকে সেই উচ্চাসন থেকে নিচে টেনে নামায়। শুধু নামিয়ে আনে না, কখনও কখনও একেবারে আস্তাকুঁড়েও যে ছুড়ে ফেলে তার নজিরও ইতিহাসে আছে অজস্র।

উত্থান-পতনের এই চক্র থেকে বাদ যায়নি মোগল সাম্রাজ্যও। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে এই মোগলরাও আস্তে আস্তে সেদিকেই পা বাড়ায়। এভাবে মাত্র দেড় শতকের মাঝেই ভারতবর্ষের বুকে এককালে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করা সাম্রাজ্যই হয়ে যায় ইতিহাসের অংশ।

১৭০০ সালে ভারতবর্ষের মানচিত্র; Image Courtesy: Justus Perthes, Gotha./Charles Joppen – Joppen, Charles [SJ.] (1907), A Historical Atlas of India for the use of High-Schools, Colleges, and Private Students, London, New York, Bombay, and Calcutta: Longman Green and Co. Pp. 16, 26 maps

ইতিহাস নাহয় হলো, কিন্তু এই ইতিহাসের অংশ হিসেবে যারা ছিলেন অর্থাৎ সুবিশাল মোগল পরিবারের রক্ত বইছিল যাদের শরীরে, তাদের কী হলো? শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের পতনের পর এই বংশের শাহজাদা-শাহজাদীসহ নাতি-নাতনি সম্বন্ধীয় আরও যে বংশধররা ছিলেন, তারা কোথায় গেলেন? সুরম্য প্রাসাদের বুক থেকে হঠাৎ করেই জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কীভাবে দিন পার করেছিলেন তারা? আদৌ কি দিন পার করতে পেরেছিলেন? আচ্ছা, তাদের কি সোনালী সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত? গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিংবা বৃষ্টিভেজা দিনে আনমনা হয়ে তারা কি ফেলে আসা সোনালী অতীতের কথা ভাবতেন?

মোগল সাম্রাজ্যের পতন নিয়ে ভাবলে এর সদস্যদের শেষ পরিণতি নিয়ে এমন অনেক প্রশ্নই আপনার মাথায় ভিড় করতে বাধ্য। সেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই হাজির প্রসিদ্ধ সুফি দার্শনিক, কবি, ঐতিহাসিক, সম্পাদক ও প্রবন্ধকার খাজা হাসান নিজামী (১৮৭৩-১৯৫৫ খ্রি.)। তিনি নিজে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্থান থেকে মোগল পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, শুনেছেন তাদের জীবনের করুণ অধ্যায়ের গল্প। এরপর সেই কথাগুলোই তুলে ধরেছেন তার বিখ্যাত ‘বেগমাত কে আঁসু’ বইয়ে।

খাজা হাসান নিজামী; Image Courtesy: Urdu Mirror by Muslim Saleem

মোগল পরিবারের ভাগ্যাহত সদস্যদের শেষ দিনগুলির উপর ভিত্তি করে সর্বমোট ছাব্বিশটি সত্য কাহিনি স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় যে এককালে যে পুরুষেরা মোগল পরিবারের শাহজাদা বা নিকটাত্মীয় ছিলেন, একসময় যাদের সুরম্য অট্টালিকায় চাকরবাকর, খানাপিনা আর ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি থাকত, সেই মোগল রক্তধারীরাই সাম্রাজ্যের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় তৃতীয় শ্রেণীর চাকরি নিয়ে কোনোমতে দিন গুজরান করতে বাধ্য হন। অনেক সময় চাকরি জোটাতে গিয়েও তারা হিমশিম খাচ্ছিলেন, কারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা বাস্তব দুনিয়ার কাজের অভিজ্ঞতা কোনোটাই তাদের ছিল না। ক্ষেত্রবিশেষে তাই তাদের যেমন ঠেলাগাড়ি ঠেলা কিংবা গবাদিপশুর জন্য ঘাস কেটে নিজের পেটের ভাত জোগাতে হয়েছে, তেমনই কোনো কোনো পুরুষ সদস্যকে দেখা গিয়েছে শতচ্ছিন্ন জামা গায়ে দিল্লির রাস্তায় ভিক্ষার থলি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। যারা কিছুই পারতেন না, তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাসিক পাঁচ রূপির ভাতা।

একই দশা হয়েছিল এই পরিবারের নারীদেরও। যারা এককালে রাজমাতা, শাহজাদী হয়ে অন্দরমহলে সময় কাটাতেন, যাদের সেবায় এককালে অজস্র ভৃত্য নিযুক্ত থাকত, মোগল পরিবারের পতনের পর সেই ভৃত্যরাই সবার আগে তাদের রেখে পালায়। যাবার আগে অবশ্য মনিবদের ঘরের মূল্যবান সম্পদ চুরি করে নিতেও ভোলেনি অনেকে। কেউ কেউ তো সাক্ষাৎ মনিবের সদ্যোজাত সন্তানকে চুরি করেই পালিয়েছে! সবাইকে অবশ্য এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না, কারণ এমন অনেক ভৃত্যও ছিল, যারা মনিবের পরিবারের সদস্যদের রক্ষার্থে, নারীদের ইজ্জত রক্ষার্থে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।

‘মোগল পরিবারের শেষ দিনগুলি’ বইটির প্রচ্ছদ; Image Courtesy: Muhaiminul Islam Antik

এমনই করুণ সব কাহিনি স্থান পেয়েছে বইটিতে। মূল বইটি রচিত হয়েছিল গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলা ভাষাতেও বইটির সুখপাঠ্য অনুবাদ নিয়ে এসেছে নাশাত পাবলিকেশন। বাংলায় ‘মোগল পরিবারের শেষ দিনগুলি’ নামের এই বইয়ের অনুবাদ করেছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ইমরান রাইহান, ইতিহাস বিষয়ে যার বিভিন্ন মৌলিক ও অনুবাদগ্রন্থ ইতোমধ্যেই পাঠকসমাজে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে।

বলে রাখা ভাল, বইয়ের শুরুতেই ‘অনুবাদকের কথা’ অংশে অনুবাদক নিজেই উল্লেখ করেছেন যে বাংলা ভাষায় ‘বেগমাত কে আঁসু’ বইয়ের প্রথম ভাষান্তরিত রূপ নয় এটি, বরং তৃতীয়। যে বইয়ের ইতোমধ্যেই দু’জায়গা থেকে অনুবাদ এসে গেছে সেটার তৃতীয় অনুবাদক হবার কারণও তিনি উল্লেখ করে দিয়েছেন। তার মতে, পূর্বোক্ত অনুবাদ দুটো বিভিন্ন দিক থেকেই ছিল অপূর্ণাঙ্গ। ওদিকে এমন একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ অবশ্যই সমৃদ্ধ অনুবাদের দাবিদার। সেই তাড়না থেকেই এই বইয়ের অনুবাদে হাত দেন তিনি। পাঠকদের বুঝবার সুবিধার্থে বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় যুক্ত করেছেন প্রয়োজনীয় টীকাও।

অনুবাদক হিসেবে বরাবরের মতোই ইমরান রাইহানের দক্ষতার ছোঁয়া আছে এই বইয়েও। পড়তে গিয়ে একবারের জন্যও পাঠকের মনে হবে না যে তিনি কোনো অনুবাদগ্রন্থ পড়ছেন, বরং মোগল পরিবারের শাহজাদা-শাহজাদী ও নিকটাত্মীয়দের দুর্দশাগ্রস্ত, নাটকীয় জীবনকাহিনি পড়তে পড়তে হুট করে দেড়শো পৃষ্ঠায় এসে যখন তা শেষ হয়ে যাবে, তখন বারবার মনে হবে, “ইশ, এরপর কী হলো তাদের! কী হলো…।”

এ যেন এক অদ্ভুত কষ্ট, কাউকে বলে বোঝাতে না পারা এক অব্যক্ত বেদনা।

বইটি সংগ্রহ করতে 

বই: মোগল পরিবারের শেষদিনগুলি
মূল: খাজা হাসান নিজামী
অনুবাদক: ইমরান রাইহান
প্রকাশক: নাশাত পাবলিকেশন
প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৯
মুদ্রিত মূল্য: ২০০/-

This Bengali article gives a review on the book 'Mogol Poribarer Sheshdinguli' by Khwaja Hasan Nizami, translated in Bengali by prominent author Imran Raihan, that discusses the last days of the family members of the Mughal Empire after the decline of its last emperor Bahadur Shah Zafar.

Related Articles

Exit mobile version