Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নোবেল চোর: পণ্যায়নে ও শ্রেণীদ্বন্দ্বের ভিড়ে মূল্যবোধের অন্বেষণ

পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন থেকে ২০০৪ সালের ২৪ মার্চ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরি হয়ে যায়। কলকাতা পুলিশ, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন নানা তত্ত্ব তালাশ করেও চুরি যাওয়া পদকের কোনো হদিস পায়নি। এদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির তো বটেই, পুরো ভারতের আবেগের জায়গা। সেই গুরুদেবের পদক চুরি হয়ে গেল! কলকাতার বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ থেকে সাধারণ মানুষ সবারই আলোচনার বিষয় এই নোবেল চুরি। একই সময়ে কলকাতা থেকে দূরে কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে পুঁথিগত বিদ্যাহীন এক হতদরিদ্র কৃষক বাস করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। কৃষকের ঘরের চাল নড়বড়ে, বর্ষায় পানি গড়িয়ে পড়ে, গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, তার উপর কেরোসিনের দামও চড়া, আর বাজার-সদাইয়ের দাম তো প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী।

সকালবেলা সেই দরিদ্র কৃষক ভানু নিজ বাড়ির কুয়োর পাশে স্বর্ণের মতো চকচকে একটি বস্তু কুড়িয়ে পায়। জিনিসটা কী, এটা ভানু ও তার স্ত্রীর বোধগম্যতার বাইরে। তাই এর পরিচয় জানতে ভানু ছুটে যায় গ্রামের মাস্টারমশাইয়ের কাছে। মাস্টারমশাই নিশ্চিত করেন, এটি কবিগুরুর হারিয়ে যাওয়া নোবেল পদক।

রবি ঠাকুরের নোবেল চুরি এ সিনেমার মূল প্লট, তবে কাহিনী কাল্পনিক; Image Source: Literacy Paradise

এদিকে পুলিশ, প্রশাসন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে রবি ঠাকুরের নোবেল। বিরোধী দল সরকারের সমালোচনার করার আরো একটি ছুতো খুঁজে পেল। কলকাতার সুশীল সমাজ সভা-সেমিনার করে নোবেল চোর ও সরকারকে তুলোধুনো করছে। অন্যাদিকে দরিদ্র কৃষক ভানু কুড়িয়ে পাওয়া নোবেল নিয়ে দিবাস্বপ্নে ব্যস্ত। তার ঘরের চাল ঠিক করবে, নতুন সাইকেল হবে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দূরদেশে পাড়ি দেবে। সবই হবে নোবেল বিক্রির টাকায়।

গ্রামের পঞ্চায়েত গোপনে ভানুকে নিয়ে সভা ডাকল, সভায় সাব্যস্ত হলো, ভানু নোবেল পদক ফেরত দেবে কলকাতায় গিয়ে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতে সে এই পদক তুলে দেবে, বিনিময়ে নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রী ভানুকে মোটা পুরস্কার দেবেন। সেই টাকায় ভানুর নিজের দিন ফিরবে, সঙ্গে গ্রামেরও চেহারা বদলে যাবে, এই তাদের আশা। কিন্তু সরকার মহাশয় কোথায় থাকেন, কীভাবে তার সাথে দেখা করতে হয়, তিনি আদৌ দরিদ্র ভানুর সাথে দেখা করবেন কি না, এসব প্রশ্নের উত্তর তাদের কারো কাছেই নেই। 

ছবির সংলাপে এই মনোভাবটি উঠে এসেছে অনেকটা এভাবে,

“মুখ্যমন্ত্রীর দেখা পাওয়ার চেয়ে ভগবানের দেখা পাওয়া সহজ।”

নোবেল পদক ফেরত দিতে ভানু একসময় অজানা-অচেনা শহর কলকাতায় হাজির হয়। তার মনে চরম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব খেলা করে। নোবেল সে ফেরত দেবে, নাকি বিক্রি করে দেবে? বিক্রি করে দিলে এই টাকার অল্প অংশ নিজের কাছে রেখে বাকিটা গ্রামের কাজে লাগাবে। তাদের গ্রামের এই যে করুণ অবস্থা, রাস্তাঘাট নেই, টিউবওয়েল নেই, বিদ্যুৎ নেই, ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষক আত্মহত্যা করে, আবার বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়া। কই, সরকার তো এসব সমাধান করে না, তবে কি হবে নোবেল ফেরত দিয়ে? বরং নোবেল বিক্রির টাকা গ্রামের জন্য ব্যয় করলে মানুষের আসল উপকার হবে।

রবি ঠাকুরের অজস্র শিল্পকর্ম সম্বন্ধে ভানুর কিছুই জানা নেই, এমনকি রবীন্দ্রনাথের নামও সে আগে কখনো শোনেনি। তবে কবিগুরুর প্রতি তার অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে। সেটা কবিগুরুর নামের শেষে ‘ঠাকুর’ পদবীর জন্য। ঠাকুরের জিনিস বিক্রি করে দিলে ঠাকুর পাপ দেবে, এই ভয় তার মধ্যে কাজ করে।

এই চলচ্চিত্রে পরিচালক সুমন ঘোষ খুব নিপুণভাবে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহর, বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েতের মধ্যকার শ্রেণী ব্যবধান তুলে ধরেছেন। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যত নিয়ম-কানুন, নীতি-নৈতিকতার মাপকাঠি আছে, সেগুলো দরিদ্র মানুষের জন্য যতটা কঠোর, ক্ষমতাবানদের জন্য ততটাই সহজ। সমাজপতিরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পু্ঁজিবাদী ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথও পুঁজির একটা বড়সড় উপকরণ মাত্র। ছবির সংলাপে রবীন্দ্রনাথেরও পণ্য হয়ে ওঠার বার্তা ফুটে উঠেছে,

“রবি ঠাকুরকে বেচে কত লোক বড়লোক হয়ে গেল, আমরা যদি নোবেলটা বেচে চারটে লোকের উপকার করতে পারি…”

আরেকটি সংলাপে এসেছে শ্রেণী ব্যবধানের নগ্নচিত্র,

“এরা হচ্ছে কলকাতার মানুষ, গ্রামের উপর এদের কোনো পিরিত নেই, গ্রামে বড় বড় বাংলো বানাবে আর পৌষমেলার সময় ন্যাকামো করতে গ্রামে যাবে।”

রবীন্দ্র জয়ন্তী, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস, পয়লা বৈশাখ, বসন্ত উৎসবসহ আরো নানাবিধ উৎসব রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অচল। এসব উৎসব কি সত্যিই রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে, নাকি রবীন্দ্রনাথের নাম ভেঙে পয়সা কামানোর রাস্তা তৈরি করে? উৎসবের আয়োজনে মহান শিল্পচর্চা করা হয়, অথচ একই সমাজে কত অন্যায়, অন্যায্যতা চলে, তখন এসব শিল্পবোদ্ধাদের অনেকে ন্যায়কথা না বলে মুখ লুকান। দরিদ্র, ক্ষমতাহীন, মজলুম মানুষের কথা বলতে না পারলে সেই শিল্প কি প্রকৃত শিল্প হয়ে ওঠে? সেসব বোদ্ধারা কি সত্যিকারের বোদ্ধা হতে পারেন? পরিচালক সূক্ষ্মভাবে এসব নিদারুণ বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন চলচ্চিত্রে।

নোবেল হাতে নিয়ে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের সংলাপটি বেশ মজার আবার বহু ভাবনার উদ্রেককারী,

“কী ওজন গো, ব্রিটিশ আমলের খাঁটি মাল। এখনকার হলে এর মধ্যে টিন গছিয়ে দিত।”

ডিভিডি পোস্টার; Image Source: IMDB

ছবিতে সঙ্গীতের বিষয়টি বেশ মনোরম ভাব ধরে রাখে। “এই প্রভাতে রবির সাথে, চলল ভানু” গানটি বেশ শ্রুতিমধুর, গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে হবে। 

কলকাতার বাণিজ্যিক সিনেমায় মারমার, কাটকাট অভিনয় করে মিঠুন চক্রবর্তী একসময় বেশ নামডাক করলেও তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যতিক্রমধর্মী সিনেমা আছে, নোবেল চোর এর মধ্যে একটি। ভানু চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন,  আরো একবার নিজের জাত চিনিয়েছেন দর্শকদের। ভানুর স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করা সোমা চক্রবর্তীকে দশে দশ দিতে সচেতন দর্শক কার্পণ্য করবেন বলে মনে হয় না। চলচ্চিত্রের সবচেয়ে নিখুঁত অভিনয় যেন তিনিই করেছেন। ওদিকে আদর্শবাদী মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বরাবরের মতোই ভালো অভিনয় করেছেন। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় সাবলীল অভিনয় করেছেন এক ছাপোষা মধ্যবিত্তের চরিত্রে, যে কি না যেকোনো মূল্যে বড়লোক হওয়ার আকাশ-কুসুম স্বপ্নে প্রায় সময়ই বিভোর থাকে।

পরিচালক সুমন ঘোষ; Image Source: bengali.oneindia.com

ছবির প্রথম অংশে হালকা কমেডি ধাঁচে গল্প বললেও পরবর্তী অংশে থ্রিলভাব চলে আসে। পরিণতি অংশে দর্শক ভাবতে বাধ্য হবেন, এমন না হলেও চলত। মূলত এটাই পরিচালকের মুন্সিয়ানা। ছবির গল্প লেখা ও পরিচালনার কাজ করেছেন সুমন ঘোষ। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন বিক্রম ঘোষ। আর হ্যাঁ, কবিগুরুর নোবেল পদক সত্যিই চুরি গেলেও ছবির গল্প কিন্তু পুরোটাই কাল্পনিক। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া হালকা কমেডি আর কিছুটা থ্রিল ঘেরা এই চলচ্চিত্র দেখে দর্শক শ্রেণিতত্ত্ব নিয়ে আরো একবার ভাবতে চাইবেন, খুঁজতে চাইবেন সত্যিকারের মূল্যবোধ। ছবিটি ২০১১ সালে ১৬ তম বুসান চলচ্চিত্র উৎসব এবং ৫৫ তম লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রর্দশিত হয়।

This article is in Bangla. It is a review of the Comic Thriller film 'Nobel Chor'.

Feature Image: Bongo

Related Articles