Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘হটলাইন’: আত্মহত্যার দ্বারপ্রান্তে এক বিষাদ ফোনকল

আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছি। লাফ দিব। এক্ষুনি লাফ দিব। ছয় তলা থেকে।

বইয়ের মলাটে এ লেখা থেকেই বুঝে যাওয়া যায় বইটি আত্মহত্যা নিয়ে হবে, যদিও বইয়ের শিরোনামখানা ইঙ্গিত দেয়নি যে হটলাইনটা আসলে কীসের হটলাইন। কলেবরের হিসেবে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের এ বইটিকে আসলে বিশদ উপন্যাস বলা চলে না। পাঠক হিসেবে এটাকে একটা ‘গল্প’-ই মনে হয়েছে, বড়জোর একটি ‘বড় গল্প’। তবে মূল যে বার্তাটি দেবার চেষ্টা লেখক করেছেন সেটা বেশ ভালো। সাহিত্যমানের বিচারে বইটিকে অনেক ওপরে রাখা যাবে না যদিও, তবে আত্মহত্যা প্রবণতা ঠেকাবার একটা প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে প্রশংসার দাবিদার বটে।

বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: rokomari.com

গল্পের মূল চরিত্র রত্না, অষ্টাদশী এক কিশোরী। সবে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে যে বেশ ছোট সেটা বইতে বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয়, একজন তো দেখে দশ-বারো বছরের মেয়ে ভেবে ভুল করে বসে। কিন্তু ছোট হলেও তার চাওয়াটা বেশ বড়, স্বপ্নটা বিশাল। আত্মহত্যা ঠেকাতে চায় সে মানুষের। তাই এত কম বয়সেই রত্না ভলান্টিয়ার হিসেবে যোগ দেয় একটি সুইসাইড হটলাইন সেন্টারে। ট্র্যাফিক জ্যামের তোয়াক্কা না করেই প্রথম দিনই নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগে পৌঁছে যায় সে অফিসে। সুমী নামের একজন দরজা খুলে দেবার পর খুবই আন্তরিকতার সাথে তাকে বরণ করে নেয়া হয়। তার জায়গা হয় কল সেন্টার রুমটিতে যেখানে দরজার বাইরে মার্কারের কালিতে কাগজে ‘নো এন্ট্রেন্স- প্রবেশ নিষেধ’ হাতে লিখে টানানো। ভেতরে কেবল তাদেরই বসার জায়গা যারা ফোন ধরবে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের। যাদের কাজ হবে, নানা রকম কথা শোনা আর বলা, যেন মানুষগুলো ফিরে আসে আত্মহত্যার মুখ থেকে।

বইয়ের একটি অংশ; © লেখক

প্রথমদিনেই রত্নার ভাগ্যে পড়ে রাতের শিফট। আর রাতের শিফট মানেই হলো কল বেশি আসবার সম্ভাবনা, কারণ রাত যত গভীর হয়, আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগানো বিষণ্ণতাগুলো বেশি করে চেপে বসে যাদের প্রবণতাটা আছে তাদের।

কল রুমে ঢুকবার পরপরই রত্নার সাথে পরিচয় হয় তার সহকর্মী ভলান্টিয়ারদের- ইউনিভার্সিটিতে পড়া রুনু, সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকুরিরত ইমরান, স্থপতি রাজু আর তিষা। রত্নাকে ঝটপট একটা সুন্দর জায়গায় বসিয়ে দেয়া হয় আর সাথে একটা মোবাইল ফোন, যেখানে ফোন আসবে। সবাই তাকে আশ্বস্ত করতে থাকে যে, বেশিরভাগ ফোন কলই আসলে সহজ কেস- হয় বাবা-মায়ের সাথে ঝগড়া হয়ে মন খারাপ, বা গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে চলে গিয়েছে, কিংবা পরীক্ষা খারাপ হয়েছে ইত্যাদি। আর সেগুলো সামাল দেবার জন্য ডেস্কের সামনেই এঁটে দেয়া আছে নির্দেশনাগুলো। কালেভদ্রে কঠিন কেস আসবে, যেখানে ফোন করা ব্যক্তিটি হয়তো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে আত্মহত্যার। রত্নার নিশ্চয়ই শুরুতেই এত কঠিন কেস আসবে না।

বাইরের দেশে আছে সুইসাইড কল সেন্টারের বেশ প্রচলন; Image Source: Suicide Prevention Service

সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাথে সাথেই ফোন বেজে উঠলো, আর সে ফোনটা এমন একজনের করা যিনি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন তখনই। তার মুখ থেকেই দীর্ঘ নীরবতার পর ভেসে আসে, “আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছি। লাফ দিব। এক্ষুনি লাফ দিব। ছয় তলা থেকে।

বেশ কাকতালীয়ভাবেই মানুষটি ফোন দিয়েছেন। ভদ্রলোকের নাম জুলহাজ। যে কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে এখনও লাফ না দেবার কারণ আসলে এটাই যে, নিচে কিছু মানুষ চলাচল করছে, তারা সরে গেলেই তিনি লাফ দিয়ে জীবন শেষ করে দেবেন। বৃষ্টি হবার বেশ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। 

রত্না বেশ চেষ্টা করে জানতে পারলো, জুলহাজ সাহেবের আত্মহত্যা করতে চাইবার কারণটা তার প্রাপ্ত ট্রেইনিং এর কোনো কারণের সাথেই মেলে না। জুলহাজ সাহেব নাকি তার স্ত্রী আর পুত্রকে খুন করেছেন! অবশ্য, ইচ্ছাকৃত খুন নয়, গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি, আর সে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়াতে জুলহাজ সাহেব নিজে আহত হলেও মারা যায় তার স্ত্রী আর পুত্র। সেই অপরাধবোধ আর বেদনা থেকেই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেত চান।

তখন থেকেই শুরু হয় রত্নার কাজ। একের পর এক নানারকম চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে সে ‘পরী’ ছদ্মনাম নিয়ে, কারণ আসল নাম বলতে মানা। কিন্তু এত ছোট একটা মেয়ে হয়ে বড় মানুষটিকে বোঝাতে হিমশিম খেয়ে যায় সে। সে কি পারবে জুলহাজ সাহেবকে থামাতে? কীভাবে?

লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল; Image Source: The Bangladesh Today

একটি ফোনকলই চলে পুরো বইজুড়ে। কথাবার্তাগুলো বেশ সাবলীল। লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন বইয়ের শুরুতেই যে, তিনি জানেন না সত্যিকার কলগুলো কেমন হয়, তাই তিনি আশ্রয় নিয়েছেন কল্পনার। বইয়ের প্রচ্ছদে ছাদের প্রান্তে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির ছবি যেন হাহাকার জাগিয়ে তোলে এক হতাশার। জুলহাজ সাহেবের কথাগুলোও হতাশার, বিষাদের। কখনও হাসি, কখনও কান্নার। স্ত্রী নীলার স্মৃতিচারণগুলো বেশ চমৎকার আর নস্টালজিক। যেমন এ অংশটুকু-

জুলহাজ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “হায় হায় এত ওয়েদার খারাপ, আমি অফিস যাব কেমন করে?”

নীলা কেমন যেন রেগে উঠল, বলল, “কী বললে তুমি? ওয়েদার খারাপ? খারাপ? এত সুন্দর বৃষ্টিকে তুমি খারাপ বলছ?”

জুলহাজ হাসি হাসি মুখে বলল, “বৃষ্টির মাঝে কোন জিনিসটা ভালো?”

নীলা বলল, “এক বোতল পানি তুমি কয় টাকা দিয়ে কিনো?”

আলোচনা কোন দিকে যাবে জুলহাজ অনুমান করতে পারে না, সে সরল মুখে জিজ্ঞেস করল, “পাইকারি না খুচরা?”

“ঢং করবে না- বল কত দিয়ে কেনো?”

“এই দশ টাকার মতো।”

“তাহলে বল এখন কয় বোতল পানি পড়ছে আকাশ থেকে? বল।”

জুলহাজকে স্বীকার করতে হলো অনেক বোতল পানি পড়ছে আকাশ থেকে। নীলা বলল, “আকাশ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার পানি পড়ছে। কোটি কোটি টাকার পানি পড়ছে। বুঝেছ?”

স্বামী-স্ত্রীর মধুর খুনসুটির স্মৃতিটুকু যেন বিষাদ হয়ে আসে বৃষ্টিস্নাত সে রাতে। চলতে থাকে তাদের কথোপকথন।

লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল; Image Source: CBN24

হয়তো বইটি আরও বড় কলেবর হলে আরও ভালো লাগত। কিছু অসংগতির প্রশ্ন মাথায় এমনিতে চলে আসে। যেমন, জুলহাজ সাহেব মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তেই এত কাকতালীয়ভাবে পেলেন সেই ফোন নাম্বারখানা? কিংবা, এত দীর্ঘ কল কী করে চলতে লাগলো জুলহাজ সাহেবের ফোন থেকে? এর উত্তরে ধরে নিতেই হয়, তার হয় পোস্টপেইড নম্বর, কিংবা অনেক টাকা ব্যালেন্স ছিল।

ফোনে চার্জ অবশ্য তার বেশি ছিল না। মুহম্মদ জাফর ইকবালের চিরাচরিত লেখার ছাপ স্পষ্ট থাকলেও, তার আগের বইগুলোর কাহিনীর ছায়া এখানে নেই। তবে খুব তাড়াতাড়ি বইটা শেষ করে দেবার তাড়া পরিলক্ষিত হয়। বইয়ের লাইনগুলোর মাঝের ফাঁকাগুলো খুব সহজেই কমিয়ে এনে ৭১ পৃষ্ঠা থেকে বইয়ের আকার ৩০/৪০ পৃষ্ঠায় আনা যেত, অতিরিক্ত ফাঁকাটুকু চোখের জন্য বেশ বিরক্তিকর ছিল। জাগৃতি প্রকাশনী থেকে ২০১৯ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইটির মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা। ঘরে বসে বইটি পেতে এখানে ক্লিক করে অর্ডার করা যাবে।

তবে সবশেষে এটুকু বলতেই হয়, আত্মহত্যা বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি বই ইদানিংকালে লেখা হয় না। তাই এরকম কাহিনীর বই আরও বের হবে সেই আশা করাই যায়।

This article is in Bangla language and reviews the book 'Hotline' (2019) by Dr. Mohammed Zafar Iqbal. For further reference, please visit the hyperlinked website.

Featured Image: WallpaperUP (modified)

Related Articles