Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমার স্বামী ওয়ালী: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অন্তরঙ্গ দিনলিপি

বইটির ফ্ল্যাপে লেখা আছে— বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। চাকরির সুবাদে তার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বাংলাদেশের বাইরে, নানা দেশে। বাঙালি পাঠক তার কথাশিল্প সম্পর্কে জানে, উচ্চ ধারণা পোষণ করে। কিন্তু ব্যক্তি ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আমরা কমই জানি। স্ত্রী আন মারি ওয়ালীউল্লাহ তার সম্পর্কে খুবই অন্তরঙ্গ একটা ছবি এঁকেছেন এ বইয়ে। ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিজীবন, তার রুচি, পাঠপরিধি, তার চিত্রকর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সর্বোপরি তার সংবেদনশীল মন সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দেয় এই বই। ওয়ালীউল্লাহ বিশ্বের সব সাহিত্যকে মানুষের উত্তরাধিকার বলে গণ্য করতেন। বইটি পড়তে পড়তে শেষপর্যন্ত ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্কে তার নিজের এ কথাই সত্য বলে মনে হবে, “আমি একজন মুক্ত মানুষ। জগৎ আমাকে গ্রহণ করুক আর না-ই করুক, পুরো জগৎটাই আমার।

এই বই সম্বন্ধে ভূমিকা লিখতে গিয়ে আনিসুজ্জামান লিখেছেন,

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আন মারির স্মৃতিকথা এক অসাধারণ রচনা। … আমাদের সাহিত্যের, আমাদের কালের, একজন বড়ো স্রষ্টাকে জানতে আন মারির এই বই সহায়ক হবে, এমনকি, আমি বলব, অপরিহার্য বলে গণ্য হবে, ওয়ালীউল্লাহর প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে-দুটি উপন্যাস ও একটি ছোটগল্পের বিষয়ে-নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আন মারি যা বলেছেন, তা-ও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

বইটি কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত— আমাদের সাক্ষাৎ, ইউরোপে, বাঙালি মুসলমান, সর্বগ্রাসী পাঠক, শিল্পী, লেখক এবং মানুষ ওয়ালী। আন মারি এবং ওয়ালীউল্লাহর পরিচয় প্রশান্ত পারের দেশ অস্ট্রেলিয়াতে। দুজনেই কর্মসূত্রে ১৯৫২ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ায় হাজির হন। তখন আন মারির বয়স ছিল ২৩, আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বয়স ছিল ৩১। দিল্লির পর এটা ছিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দ্বিতীয় কর্মস্থল। অস্ট্রেলিয়া দেশটি দুজনেরই ভালো লেগে গিয়েছিল, বিশেষ করে মানুষদের, কারণ, অস্ট্রেলিয়ার মানুষেরা মুক্তমনা। ওয়ালীউল্লাহর সাথে আন মারির দেখা অস্ট্রেলিয়ান এক স্থপতির দেয়া পার্টিতে। কেমন ছিল ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আন মারির প্রথম অভিব্যক্তি?

সপরিবারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (সূত্রঃ https://www.syedwaliullah.com/)
সপরিবারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ; Image Source: syedwaliullah.com

আন মারির ভাষায়,

“মনে পড়ে প্রথম দেখেছিলাম ঘরের সবচেয়ে দূরবর্তী একটি কোণে ডিভানে বসে থাকতে, দেখে মনে হয়, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, চারিদিকে মানুষজন চোখে পড়ছে না তার। … এখানে কেন এসেছি ধরনের একটা ভঙ্গিমা, যেমনটা আমি নিজেও অনুভব করছিলাম?”

আন মারির মতে, ওয়ালীউল্লাহর চোখের কোমলতা ছিল তার হাসি। আন মারি ফরাসি- এ কথা জানার পর ওয়ালিউল্লাহ ফরাসি লেখকদের নিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন। যেকোনো বিষয়ে ওয়ালীউল্লাহর জ্ঞানের বিস্তার তাকে মুগ্ধ করেছিল।

পরিচয়ের পর একসময় সম্পর্ক গভীর হয়। এরপর দুজন দুজনকে বুঝতে শুরু করেন। আন মারির ভাষায়, ওয়ালীউল্লাহ সবসময় মনের কোণে জন্মভূমির জন্য ভালোবাসা লালন করতেন। এমনকি দমকা বাতাসে দরজা জানালার আর্তনাদও ওয়ালীউল্লাহকে তার দেশের কথা মনে করিয়ে দিত। দুজনেই মনে করতেন, মানুষের মধ্যে স্বভাবসুলভ মঙ্গল চিন্তা কাজ করে। ওয়ালীউল্লাহর গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন আন মারি। কোনো বই, চলচ্চিত্র, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বা কোনো রাজনৈতিক ঘটনা বিষয়ে আন মারি ওয়ালীউল্লাহর মতামত জানতে চাইতেন।

আন মারিকে ওয়ালীউল্লাহ দেশভাগ এবং হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন। কলকাতার সেন্ট পল কলেজ থেকে একবার পিকনিকে গিয়ে দুজন মুসলমান ছাত্রকে আলাদা খেতে হয়েছিল। রেলস্টেশনে দুটো পানির কল থাকত। একটা হিন্দুদের জন্য, একটা মুসলমানদের। ট্রেনে একবার দুজন হিন্দু ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয়ের পর তাদের বাসায় খেতে গিয়ে তাকে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিতে হয়েছিল। তখন তারা আর ওয়ালীর সাথে বসে না খেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে খাবার বেড়ে দিয়েছিল, কারণ মহিলা দুজন ছিলেন ক্ষত্রিয়।

ইউরোপে আন মারির বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে গেলে তারা ওয়ালীর নম্রতা, সহনশীলতা আর সকলের প্রতি টানের কারণে তাকে দ্রুত পছন্দ করে ফেলেন। ওয়ালী বিশেষভাবে লন্ডন সফর করতে চাইতেন। কারণ, কী করে একটা ক্ষুদ্র দেশ একটা সাম্রাজ্য শাসন করতে সমর্থ হয়েছিল- সেটা নিয়ে তার মধ্যে একটা বিস্ময় ছিল সবসময়। ইউরোপে সবার আগে যে জিনিসটা সবার আগে ওয়ালীর চোখে পড়েছিল সেটা হলো সভ্যতার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ।

আন মারির মতে, পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর প্রথম কয়েকটি বছর ওয়ালীর মধ্যে যে বিরাট প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হলে ওয়ালী প্রচণ্ড মুষড়ে পড়েন। দেশকে কীভাবে সাহায্য করবেন সেটা না বুঝে উঠতে পেরে ভীষণ হতাশও হয়ে পড়েন। আন মারির মতে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তিনি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে খুশি হতেন, অথচ বাংলাদেশের জন্মের দুই মাস আগে ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়। দেশটিকে ওয়ালী বাংলা, পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তান নাম ডাকতেন।

আন মারির মতে, ওয়ালীউল্লাহ ধর্মীয়ভাবে না হলেও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি মুসলমান ছিলেন এবং সেভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন। ওয়ালী দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। আন মারির কথায়,

“পূর্ব বাংলার সৌন্দর্য, অজস্র আঁকাবাঁকা নদী, সবুজ খেত, তরুবীথির পেছনে ঢাকা পড়া ছোট ছোট গ্রাম, বাঁশঝাড়, কাঁঠালগাছ, দামাল মেঘ, দমকা বাতাসের সঙ্গে মৌসুমি বৃষ্টিতে বেরিয়ে পড়া শিশু-কিশোরের দল-আমাকে এসব দেখানোর জন্য সে উদগ্রীব ছিল। আমাকে সে বৃষ্টির দিন নিজ হাতে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ার গল্প শুনিয়েছিল। আমাকে শুনিয়েছে কত্থক নাচ, মোগল রাজদরবার, মোগল সম্রাটদের বানানো অপূর্ব সুন্দর সব প্রাসাদ, তাদের উচ্চমানের সংস্কৃতির কথা এবং একই সঙ্গে তুলনা টেনেছে ইউরোপের সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রার।”

এককথায়, ওয়ালীউল্লাহ বাংলাদেশকে সর্বান্তকরণে ভালোবাসতেন এবং অন্তরে ধারণ করতেন তার সৌন্দর্য।

লেখার টেবিলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ; Image Source: syedwaliullah.com

আন মারি আরো লিখেছেন,

“নিজের দেশের দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা, দেশটিতে ব্রিটিশ, হিন্দু জমিদার এবং পাকিস্তানিদের শোষণকে ঘৃণা করত সে। সে আমাকে বাংলার লোককাহিনী শোনাত, বাংলার সাহিত্য ও ইতিহাস বর্ণনা করত, সে শোনাতো সেই সব মুসলমান তাঁতিদের কথা, যাদের নাম সূক্ষ্ণ মসলিন কাপড়ের নামকরণ হয়েছে; সে বলত মসলিনশিল্প ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ইংরেজরা কীভাবে তাঁতিদের হাতের আঙুল কেটে দিত, বলত নীল বিদ্রোহের কথা।”

এখানে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে ওয়ালীউল্লাহর সম্যক ধারণার বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়েও ওয়ালীউল্লাহর ছিলো পরিষ্কার ধারণা। আন মারি লিখেছেন,

সে বলত, মুসলমানরা ব্রিটিশদের এত ঘৃণা করেছে যে, তারা তাদের সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করতে পাঠায়নি, ব্রিটিশ শাসকদের কোনোরকম সহযোগিতা করেনি, তারা আশ্রয় নিয়েছে ধর্মকর্মের কাছে, আর এ কারণে তাদের মুসলমান-সমাজ পশ্চাৎপদতায় নিমজ্জিত হয়েছে, এদিকে মুসলমানরা সরে দাঁড়ানোর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়। দেশভাগের সময় যখন দাঙ্গা হয়, তখন ও কলকাতায় ছিল। সেখানে ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ দেখেছে, সে গল্প ও আমাকে শুনিয়েছে।

বিদেশে থাকাকালে ওয়ালী তার দেশ এবং ঢাকার বন্ধুদের খুব অভাববোধ করতেন। ওয়ালী একেবারে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার ২৮ বছর বয়স পর্যন্ত বাংলায় কাটিয়েছিলেন। এমনকি পড়াশোনা করতে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিদেশ পর্যন্ত আননি। যার ফলে বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতির সাথে তার গভীর পরিচয় ঘটে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তার বাবা বাংলার বিভিন্ন শহরে বদলি হয়েছেন, ফলে তাকে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, চুঁচুড়া, হুগলী ও সাতক্ষীরায় বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছে। ফলে তেমন ঘনিষ্ঠ স্কুলবন্ধু আসেনি জীবনে। 

ওয়ালী মনে-প্রাণে বাংলাদেশের লোকাচারগুলোকে ধারণ করতেন। উপমহাদেশের লোকদের সাথে খেতে বসলে তিনি বাঙালি কায়দায় আঙুল দিয়ে খেতেন। মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসতে পছন্দ করতেন। জাকার্তায় থাকার সময় বাড়িতে লুঙ্গি পরতেন। প্যারিসেও গ্রীষ্মকালে লুঙ্গিই পড়তেন। গ্রামবাংলার মানুষদের মতো বুড়ো আঙুল দিয়ে আঙুলের গিঁট গুনতেন। বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে সিগারেট খেতেন না। মামা-মাসির পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতেন। চট্টগ্রামের পুরি, চাপাটি, সুজি পছন্দ করতেন। রুই মাছ, ঢাকাই পনির, উচ্ছে আম, পশ্চিম পাকিস্তানের মিষ্টি কমলালেবু, বিশেষ করে সব ধরনের বাঙালি খাবার পছন্দ করতেন। সুপারি চিবাতেন। ভাটিয়ালি পছন্দ করতেন।

সপরিবারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ; Image Source: syedwaliullah.com

১৯৬৯-৭০ সালের শীতকালে আন মারিকে ও ছেলেমেয়েদের পূর্ব বাংলায় নিয়ে যেতে পেরে এবং ছেলেমেয়েদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বিশাল প্রশস্ত নদী দেখাতে পেরে খুবই খুশি হয়েছিলেন। এতকিছুর পরও ওয়ালী নিজেকে নিঃসঙ্গ আর উন্মূল ভাবতেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় বদলির পর মারির কাছে লেখা একটা চিঠিতে লিখেছিলেন,

নিজেকে আমার উন্মূল মনে হয়, যেন আমার নিজের বলে কোনো জায়গা নেই। আমি নিঃসঙ্গ, ভীষণ নিঃসঙ্গ। … ফলে হয়তো যেকোনো প্রথা ভাঙা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়, মনের দিক দিয়ে আমি যেকোনো জায়গাকে আমার নিজের জায়গা বলে মনে করতে পারি। কিন্তু মানসিকভাবে আমার এই একাকিত্ব এবং কারো ভালোবাসা না পাওয়াটা খারাপ।

আন মারির মতে, ওয়ালী ছিলেন এক সর্বভূক পাঠক। তার পড়াশোনার পরিধি খুবই বিস্তৃত ছিল। তলস্তয়, গোর্কি, পুশকিন, দস্তয়েভস্কি- এসব রুশ লেখকের বই তার পড়া ছিল। মার্ক্স, এঙ্গেলস, টয়েনবি, কাসিরের, কাফকা, লোরকা প্রমুখ লেখকের লেখাও তার ভালোমতো পড়া ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানেই হোক আর জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান বা প্রত্নতত্ত্বই হোক— সব রকম নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খোঁজখবর রাখতেন। সংবাদপত্র, সাহিত্য ও বিজ্ঞানবিষয়ক পত্রিকা পড়তেন। এই সব বিষয়ে নতুন নতুন বইপত্র কিনতে তিনি নিয়মিত বইয়ের দোকানে যেতেন। তবে আধুনিক সাহিত্যের প্রতিই ওয়ালীর আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।     

ওয়ালী তার লেখার মাধ্যমে দেশের মানুষের দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতা দূর করার জন্য যতটা সম্ভব ভূমিকা রাখতে চাইতেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “আমি একজন মুক্ত মানুষ। জগৎ আমাকে গ্রহণ করুক আর না-ই করুক, পুরো জগতটিই আমার।” ওয়ালী বেশ কিছুদিন বলেছিলেন, তিনি লেখক না, শিল্পী হতে চান। এমনকি জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ওপর করা বিখ্যাত স্কেচগুলোর প্রদর্শনীর উপর প্রবন্ধ লিখেছিলেন। জাকার্তায় থাকতে ওয়ালী প্রতিকৃতি আঁকতেন। রশিদ চৌধুরী, সাদেকাইন, নভেরা আহমেদ তাকে বিভিন্ন পরামর্শের জন্য প্রায়ই ফোন দিতেন। প্রতিটি ব্যাপারেই ওয়ালী ছিলেন গভীরভাবে নান্দনিক। দূতাবাসের জন্য লেখা পুস্তিকা নিজে সম্পাদনা করতেন, নিজের বইপত্রের প্রচ্ছদ আঁকতেন। আলোকচিত্র তোলার ব্যাপারেও তার আগ্রহ ছিল, বেশ কিছু ভালো ছবিও তুলেছিলেন।

আন মারির মতে, ওয়ালী সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন লিখতে। তার মতে, ওয়ালী লিখেই জীবিকানির্বাহ করতে পারলে ওর খুব ভালো লাগত। ওয়ালী স্বাধীন থাকতে চাইতেন, কারো জন্য কাজ করাকে ঘৃণা করতেন। ওয়ালী লেখালেখি অব্যাহত রাখতে চাইতেন, কারণ তার মতে, লেখাই ছিল তার মূল শক্তি। তবে আন মারির মতে, ওয়ালীর মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার গ্রামের মানুষদের নিয়ে লেখা। ১৯৫৪ সালের নভেম্বরে সিডনিতে আন মারিকে পাঠানো এক চিঠিতে লিখেছিলেন,

গ্রামের লোকদের নিয়ে নিয়ে লিখতে গেলে আমাকে কেন গ্রামের মানুষ হতেই হবে? এটা অত্যাবশকীয় নয়। অন্যদিকে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো কী শুধু সেটাই আমি জানি না, সেই সঙ্গে তাদের গঠন, তাদের ইতিহাস, তাদের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল।

মানুষ হিসেবে ওয়ালী কেমন ছিলেন। আন মারির মতে, ওয়ালী ছিল অবিশ্বাসী, কিংবা বলা যায় অজ্ঞেয়বাদী। তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়ালী মুসলমান হিসেবে গর্ব করতেন। ওয়ালী অক্লান্তভাবে মুসলিম বিশ্বের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে যেতেন। পশ্চিমা দেশগুলো যখন বর্বর ছিল, তখনকার মুসলিম সভ্যতার উৎকর্ষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেন। ওয়ালী মার্ক্সবাদী ছিলেন। তিনি তার সন্তানদের ভীষণ ভালোবাসতেন। মেয়ে সিমিনের অসংখ্য ছবি তুলে গল্পের মতো করে সাজিয়েছিলেন। ওয়ালীর বাংলা লেখালেখির একটা বড় অংশ শ্লেষাত্মক হলেও মানুষটা মোটেও নৈরাশ্যবাদী ছিলেন না। বরং ছিলেন উল্টোটা। ছিলেন একজন সুরসিক মানুষ। সব ব্যাপারে ওয়ালীর আন্তরিকতা সহজেই সবার মন জয় করে নিত। 

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ফরাসি স্ত্রী আন মারি ওয়ালীউল্লাহর লেখা মূল বইয়ের নাম ছিলো ‘ওয়ালী, মাই হাজবেন্ড, এজ আই স হিম’। বাংলায় অনুবাদ করেছেন শিবব্রত বর্মন। এই বইয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ব্যক্তিত্ব, মনন, সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ও জীবনের বহু অজানা অংশের ওপর আন মারি আলো ফেলেছেন। ওয়ালীউল্লাহকে ভালোভাবে জানতে আগামীতে পাঠকদের এই বইয়ের কাছে ফিরে ফিরে আসতে হবে।

Language: Bangla

Topic: This article is on the biography of Syed Waliullah.

Related Articles