ওভার দ্য লিমিট: মার্গারিটা মামুন উপেক্ষার জবাব দিয়েছিলেন রিও অলিম্পিকে

রুশ ভাষায় নির্মিত ওভার দ্য লিমিট পোল্যান্ডের নারী নির্মাতা মার্তা প্রুসের একটি স্পোর্টস ডকুমেন্টারি। বাকু ওয়ার্ল্ড কাপের বিশ্বরেকর্ডধারী রাশিয়ান রিদমিক জিমন্যাস্ট মার্গারিটা মামুনের ২০১৬ রিও অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয়ের দিন পর্যন্ত এই প্রামাণ্যচিত্রটি ধারন করেছে। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে হতাশায় ক্রমশ নিমজ্জিত এক তরুণীর নিজেকে ফিরে পাবার আখ্যান এটি। একইসাথে বিবিসির এই প্রামাণ্যচিত্র মানবীয় মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে ভার্বাল অ্যাবিউজের সচিত্রও তুলে ধরে। মুভির প্রায় সব দৃশ্যে রিটার মনুষ্য পরিচয়কে হেয় প্রতিপন্ন করে তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়,

“You’re not a human being, you’re an athlete.”

প্রামাণ্যচিত্রের প্রায় প্রতিটি দৃশ্যেই নানা বাজে মন্তব্যের শিকার হতে দেখা যায় বেঙ্গল টাইগ্রিস খ্যাত মার্গারিটাকে; Image Source: Over The Limit film

 

ওভার দ্য লিমিট প্রামাণ্যচিত্র হলেও এটি বানানো হয়েছে ফিকশনের আদলে। অতএব, পূর্বে দেয়া তথ্যটি জানা না থাকলে নির্মাণশৈলী এবং কাহিনীর ধারাবাহিকতায় মুভিটিকে কাহিনীচিত্র বলেও ভ্রম হতে পারে। তাছাড়া প্রামাণ্যচিত্রে তথ্য প্রদানের যে প্রবণতা, তা-ও অনুপস্থিত এখানে। এক্ষেত্রে নির্মাণরীতি চরিত্রগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছে গল্পের আকারে।

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রিটার জিমন্যাস্টিকসে ব্যক্তিগত কোচ আমিনা জারিপোভা। আর রাশিয়া ফেডারেশন জিমন্যাস্টিকসের হেড কোচ ইরিনা ভিনের। বয়ঃজ্যেষ্ঠ ইরিনা ভীষণ খুঁতখুঁতে, একদম পারফেকশনিস্ট। তবে তার মেজাজ সবসময় সপ্তম আসমানে চড়ে থাকে। চলচ্চিত্রের মোট ব্যাপ্তির পুরোটাই তিনি ব্যবহার করেছেন দুর্ব্যবহার আর গালিগালাজের স্ফুলিঙ্গ ছুটিয়ে। বিদঘুটে এই মহিলা কেবল ভালো ব্যবহার করতে পারেন অ্যাথলেট ইয়ানা কুদ্রুয়াভসেভার সাথে। আগেই জানিয়ে রাখি, এই ইয়ানাই জিমন্যাস্টিকসে রিটার সবচেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও ব্যক্তিজীবনে এরা একে অন্যের ভালো বন্ধুও বটে। তবে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে বন্ধুত্বে। বড় বড় সব ইভেন্টে রিটা বরাবরই পরাজিত হয় ইয়ানার পারফরম্যান্সের কাছে। ফলে পরাজয়ের চাপা ক্ষোভ থাকে তার মধ্যে। সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে রিটা ইয়ানার কথা কেড়ে নিয়ে একজন অ্যাথলেটের লক্ষ্য সম্পর্কে বলে,

“We should push past our limits.”

ইয়ানা কুদ্রুয়াভসেভা ও মার্গারিটা মামুন বন্ধু হলেও একে অন্যের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী! Image Source: Over The Limit film

 

প্রামাণ্যচিত্রের বাকি সময়টা মূলত এই বক্তব্যের চ্যালেঞ্জকে ধারণ করে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। হতাশাকে সঙ্গী করে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় আর নানামুখী সম্পর্কের প্রেষণার সাক্ষী এ ফিল্ম। একদিকে যেমন রিটার সাথে কোচ আমিনার আত্মিক সম্পর্কের গল্প খুব সুচারুতায় ধারন করা হয়েছে, অন্যদিকে ক্যামেরা ফোকাস করেছে সাঁতারু অ্যালেক্সান্ডার সুখারুকভের সাথে রিটার প্রণয়ের সম্পর্কে। এসবের বাইরে অধিকাংশ সময় বাবার অসুস্থতা বিমর্ষ করে রাখে রিটাকে। মেটাফরিক একটি সিনে আমরা রিটার জন্মদিনের মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বাবাকে সরে যেতে দেখতে পাই। বাবার অসুস্থতার প্রভাব পড়ে তার প্র্যাকটিসে। বয়ফ্রেন্ড ছাড়া ইন্ট্রোভার্ট রিতা কারো সাথে শেয়ার করে না বাবাকে নিয়ে পরিবারের মানসিক দুঃশ্চিন্তার কথা। কাজেই, প্র্যাকটিস সেশনে রিটাকে ভুগতে হয় অনেক। এমনিতেও অবশ্য জিমন্যাস্টদের প্রতিনিয়ত অনুশীলন করতে হয়।

ক্যান্সার আক্রান্ত বাবাকে বাসায় রেখে প্র্যাকটিসে আসলে মন বিষণ্ণ থাকাই তো স্বাভাবিক! Image Source: Over The Limit film

 

এই প্রামাণ্যচিত্রের পুরো সময়ে রিটাকে প্রধান কোচ ইরিনা দ্বারা নিগৃহের শিকার হতে দেখা যায়। সর্বক্ষণই বুলি করে যান তিনি। রিটার পারফর্মেন্সে অতিষ্ঠ হয়ে ইরিনা ধমকের সুরে বলা শুরু করে, “You shook like a leaf”! রিটাকে কোনো ক্রেডিট না দিয়ে বলেন, “You got points for pretty eyes!”

রিটার সকল কিছুই যেন তাকে বিরক্ত করে, এমনকি কালো স্নিকার্সও বাদ যায় না আক্রোশ থেকে। বাজে এই সময়টাতে আমিনা পাশে এসে দাঁড়ায়, ওকে এই অসুস্থ বুলিং-এর হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। তবে তিনিও ছাড় পান না ইরিনার লাগামহীন মুখের থেকে। রিটার খারাপ পারফরম্যান্সে আমিনার নিশ্চুপ নির্লিপ্ততাকে প্রধান কোচ সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে,

“The type of calm is called rage.”

তবে আমিনা তা বারবার উপেক্ষা করে যায়। আমিনা যে কখনো রিতার উপর বিরক্ত হন না, তা নয়। তবে পরক্ষণেই আবার উৎসাহ দেন,

“This is not the last tournament but that’s life.”

প্রধান কোচ একদমই সহ্য করতে পারেন না রিতাকে! Image Source: Over The Limit film

 

বাবা-মেয়ের সম্পর্ক এই প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে তাদের একান্ত ফোনালাপে,

“You are lying down for me, and I’m training for you.”

বদ্ধ ঘরে তাদের কথোপকথনের দৃশ্য আমরা চোখে না দেখতে পেলেও দরজার অপর পাশ থেকে শুনতে পাই। বিজয়ী বন্ধু ইয়ানাকে কখনো দেখা যায় রিতার নাজুক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু ব্যতিক্রম থেকে যান শুধু ইরিনা। রিটার জীবন তার কাছে তুচ্ছ হিসেবে গণ্য হয়,

“Don’t save your energy, you’re not gonna die.”

আমিনাকে লক্ষ্য করে বলে,

“She is not warmed-up. We need to train her like a dog.”

দৃঢ় মনোবল আর স্কিলে রিটা ছাড়িয়েছেন তার সহযাত্রীদের। Image Source: Over The Limit film

 

অথচ ইরিনা যে নিজেই রিটার পারফরম্যান্সের নানা ভুলের কারণ, তা তিনি নিজেও ঠিকঠাক বুঝতে পান না। শেষ মুহূর্তে তিনি যখন ধমকের সুরে উৎসাহ দিতে চেষ্টা করেন, তখন বিষয়টি দর্শকমনে আরও পরিষ্কার হয়।

আমিনা অবশ্য ইরিনার এসব তাবেদারিকে নেহায়েত পাত্তা দেয় না; আবার জবাবে কিছু বলতেও পারে না প্রধান কোচকে। তবে রিটাকে উৎসাহ যুগিয়ে যায় অন্তরের অন্তঃস্থলের ভালোবাসা দিয়ে।

“We are all in the same boat, we are all in the same team.”

বিরামহীন প্র্যাকটিসে রিটার পারফরম্যান্স খারাপ হয়। আমিনা তাকে তাই নিজের মতো অনুশীলনের স্বাধীনতাটুকু দেন। পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমি রিটাকে ক্লান্ত করে দেয়; তাই মূল পারফরম্যান্সের আগে রিটার যে অনুশীলনের প্রয়োজন নেই, সেটা অনুধাবন করে তিনি বলেন,

“When you repeat things, they can become boring.”

এ চলচ্চিত্রে রিটার বিমর্ষতা মনের গভীরে আঘাত হানে। Image Source: Over The Limit film

 

পুরো চলচ্চিত্রে এমন আরও অসংখ্য দুর্দান্ত সংলাপ আছে, ইরিনা কর্তৃক উচ্চারিত স্ল্যাং আছে, নাস্তিয়া নামে আরেক জিমন্যাস্টকে কটাক্ষ করে তির্যক শারীরিক অঙ্গভঙ্গি আছে। অর্থাৎ অনেক ‘র’ অবিকৃত সংলাপ এবং সেগুলোর চিত্রায়ণ দেখতে পাওয়া যায় মার্তা প্রুসের এ নির্মাণে। চিত্রগ্রাহক অ্যাডাম সুজিনের কারিগরি দক্ষতা এই সিনেমার সবচেয়ে ভালো দিক। ক্যামেরাতে তিনি যেভাবে সাবলীলতায় অভিব্যক্তি ধারণ করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

অপরদিকে সাউন্ড ডিজাইনে কিছু অংশে কমিক উপাদান যুক্ত করে কখনো সামান্য স্বস্তি আনয়নের চেষ্টা হয়েছে। পোলিন্সকির সম্পাদনায় সাধারণ কিছু দৃশ্যও অসাধারণ নাটকীয় হয়ে দৃশ্যচিত্রে এসেছে। যেমন ফিল্মের টেইলে জুম-ইন থেকে জুম-আউট হয়ে রিটার পাশে ইয়ানাকে দেখানোতে দৃষ্টিনন্দন নাটকীয়তা অনুভূত হয়েছে। অবশেষে দর্শককে অবারিত স্বস্তিও এনে দেয় শটটি। আবার সমুদ্র সৈকতের দৃশ্যে ইয়ানাকে চেজ করাকে শক্তিশালী মেটাফোর হিসেবে উপস্থাপন করা গেছে। এ প্রামাণ্যচিত্রের শেষটা প্রকৃত অর্থেই একদম হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তৃপ্তি-অতৃপ্তির মিশ্রণে তখন আবেগ জড়ানো গভীর মায়াও জন্মায় রাশিয়ায় ‘বেঙ্গল টাইগ্রেস’ হিসেবে পরিচিত প্রোটাগনিস্টের প্রতি। আর হ্যাঁ, ইউটিউবেই দেখতে পাওয়া যাবে এ চলচ্চিত্র!

Related Articles