একদিকে হাসছেন। হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার উপক্রম। অন্যদিকে ভয়ে থরহরি কম্প। আবার সাসপেন্সের চোটে পর্দা থেকে চোখ সরানৈ যাচ্ছে না! সিনেমা দেখতে গিয়ে এমন মিশ্র পরিস্থিতিতে পড়েছেন? হরর সিনেমায় সাসপেন্স থাকে আগাগোড়া ভয়ের সঙ্গে। কমেডি মানে ইদানিং ভাঁড়ামির প্রতিযোগিতা। তবে আজকের লেখায় এমন এক সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা হবে, যা দেখে উপরের অভিজ্ঞতা হবে, একরাশ তৃপ্তিতে উৎফুল্লও হবেন।
থাইল্যান্ড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমায় পরিণত হওয়া 'পি মাক'-এর গল্পটা দুর্দান্ত। প্রেম এমন এক জিনিস, যা কোনো বাধা মানে না। মানে না জাত, ধর্মের গণ্ডি। প্রেমের নেই বয়স, নেই কোনো সীমারেখা। তবে কিছু মানতে না চাইলেও বাধা আছে ঢের। সমাজ, সংস্কৃতি, প্রকৃতি, বাস্তবতার যাঁতাকলে রোজ পিষ্ট হয় সহস্র প্রেম। যেখানে যত বাধা, সেখানে তত ভালোবাসার বিস্তার। পি মাক উপলব্ধি করাবে এ বিষয়টি; উপলব্ধি করাবে ভয়, আনন্দ, প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আকুতি, অনন্তকাল তার সঙ্গে কাটানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
পাঁচ বন্ধু। দেশের হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ হারাতে বসে ওরা। মাক, টার, শিন, ইয়ে ও পুয়াক। মাক ছাড়া বাকিরা অবিবাহিত। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া গর্বের। মাক বাঁচতে চায়। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ফেলে এসেছে, একনজর তাকে দেখতে হলেও বাঁচতে হবে। বাঁচবে যখন, বন্ধুদের নিয়েই বাঁচবে। বন্ধুদের সঙ্গে করে মাক ফিরে আসে নিজ গ্রামে, প্রেয়সীর কাছে। প্রতি রাতে নবজাতক শিশুকে নিয়ে পুকুরঘাটে এসে স্বামী মাকের নাম ধরে ডাকে স্ত্রী নাক। নিদারুণ ব্যাকুলতা মিশ্রিত সে ডাকে মিশে থাকে ভালবাসার চূড়ান্ত আবেগ। অপেক্ষার পালা ফুরিয়ে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছাকাছি আসে। গভীর ভালোবাসায় ছেঁয়ে যায় চারিদিক। হাওয়ারা অন্ধকারে শব্দ বোনে। কিন্তু তাতে গ্রামবাসীর মনে সঞ্চার হয় ভয়ের, দরজায় খিল এঁটে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকেন তারা। যেন কোনো অশরীরীর অস্বাভাবিক ডাকে ভারি হচ্ছে বাতাস!
স্ত্রী সন্তানকে ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বসিত মাক বন্ধুদের নিয়ে পরদিন হাটে গেলে সকলে তার সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। গ্রামের মানুষ এড়িয়ে যায় তাকে। সেসব অগ্রাহ্য করে ওরা বাড়ি ফিরে আসে। কয়েকদিন পর বন্ধুদের নজরে আসে, কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। মাকের স্ত্রী নাক অসম্ভব সুন্দরী, তবু তার হাসিতে কোনো মায়া নেই। উল্টো কেমন খাপছাড়া! পুকুরের এক পাড়ে পরিবারসহ মাক থাকে, অপর পাড়ের ঘরটায় থাকে ওরা চারজন। খেয়াল করে, গভীর রাতে তাদের বাড়ির দিকে কে যেন জ্বলজ্বল চোখে পিটপিটিয়ে তাকায়। বন্ধুর স্ত্রীর খাবারের ডিশে শুকনো পাতা, কাঁচা পোকা আর নানা অসঙ্গতির ইঙ্গিতে ওরা বুঝতে পারে গ্রামবাসীর শঙ্কার কারণ। নাক যে আস্ত একটা ভূত! ভূতের সঙ্গেই আহ্লাদে সংসার করছে প্রিয় বন্ধু! মাককে রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তোলে ওরা। যেভাবেই হোক, রক্ষা করতে হবে তাকে।
মাককে জানালে সে বিশ্বাস করে না এসব। সুন্দরী বউকে দেখে হিংসায় জ্বলছে বাকিরা, তেমনটি ভেবে পাত্তা দেয় না। শুরু হয় টার, শিন, ইয়ে ও পুয়াকের মিশন। সেই মিশন আপনাকে নিয়ে যাবে ভিন্ন জগতে। ওরা যতবার চেষ্টা করে মাককে বোঝাতে, এখান থেকে পালাতে, ততবারই টের পায় নাক। ভেস্তে দেয় পরিকল্পনা। ভূত হলেও নাক সুন্দরী, প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে বন্ধুদের একজন। তান্ত্রিক বাবার কাছ থেকে মন্ত্রপড়া চাল এনে নাকের শরীরে ছিটানোর ফন্দি আঁটে। চাল ছিটাবার বেলায় টের পায়, মাকও খানিক অন্যরকম আচরণ করছে। মাকের গায়েও ছিটিয়ে দেয় চাল। তাতেই চিৎকারে ঘন অন্ধকার জঙ্গলে বাকিদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া, তবে কি নাক নয়, আসল ভূত মাক? কোনোমতে নৌকা নিয়ে পালাতে গিয়ে ফের টের পায়, ভূত তো সর্ষের মধ্যে! মাক-নাকের বাইরেও ভূত আছে আরেকজন। আর তা বন্ধুমহলেই!
ভয়ে প্রায় নখ চিবোতে গিয়েও আপনি দম ফাটিয়ে হাসবেন। চার বন্ধুর কীর্তিকলাপে থ্রিলারের হালকা আবহে মজবেন। পাবেন দম ফাটানো হাসির চমৎকার সংলাপ, ভয় আর ভালোবাসার উপঢৌকন। টক, ঝাল, তেঁতোর সংমিশ্রণে বানানো মেন্যুতে ডেজার্ট হিসেবে আছে চমৎকার এক প্রেমের গল্প। রোমান্টিকতা ছুঁয়ে যাবে, হৃদয় প্রফুল্ল হবে মায়ায়। হরর, কমেডি, রোমান্টিকের মিশ্রণে গড়ে ওঠা জঁনরার সিনেমাতে যারা অভিনয় করেছেন, প্রত্যেকে একাকার হয়েছেন গল্পের সাথে মিলেমিশে। পি মাক চরিত্রে মারিও ম্যোরের, নাক চরিত্রে দেভিকা হর্ন। দুজনই থাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চেনা মুখ। অভিনয় করেছেন অসাধারণ।
পর্দায় দুজনের রসায়নে মিষ্টি এক প্রেমের গল্পে মজে যাবে দর্শক। ভালোবাসার কাছে যে আসলে দুনিয়ার বাদবাকি সব তুচ্ছ, ওরা তা উপলব্ধি করাবে। ঠোঁটের কোণে হাসি আনাবে, চোখ ভেজাবে জলে। বাকি রইল চার বন্ধু, যাদের ছাড়া এ সিনেমা ভাবা অসম্ভব। প্রত্যেকের অভিনয়, অভিব্যক্তি এক ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের সিনেমায় চোখ আটকে থাকতে বাধ্য। আর এদের দিয়ে দর্শককে অন্যরকম অভিজ্ঞতার স্বাদ দেয়ায় ধন্যবাদ প্রাপ্য জনপ্রিয় পরিচালক ব্যাঞ্জং পিচানথানাকুনের।
থাইল্যান্ডের ফিল্ম ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসাসফল মুভিটির গল্প স্থানীয় উপকথা থেকে নেওয়া। মাক ও তার ভূত স্ত্রী নাক-এর গল্পটাকে থাইল্যান্ডের অনেক মানুষ স্রেফ রূপকথা হিসেবে দেখে না। তারা বিশ্বাস করে, এটি সত্যি। ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন হিসেবে দেখা হয় এ জুটিকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য টেলিভিশন সিরিজ, নাটক, থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে অগণিত শো। পরিচালক ব্যাঞ্জং পিচানথানাকুন সেটিকে তুলে আনেন বড় পর্দায়; ছান্তাভিট ধানাচোভ আর নন্ত্রা কুমোংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ঘষামাজা করেন চিত্রনাট্য।
সত্যিকারের আমেজ ধরে রাখতে পরিচালক সিনেমার গল্প বলার ধরন, কস্টিউম, লোকেশনে রেখেছেন আঠারো শতকের ছাপ। কাঠের দোতলা কুটির, কাঠবাঁধানো পুকুরঘাট, ঘন জঙ্গল, মধ্যযুগীয় হাটবাজার, পিনপতন নীরবতা! এসবে পূর্ণতা আনে চাৎসাই-রিদ্দিমের যৌথ প্রয়াসের আবহ সঙ্গীত। অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর একদম গল্পের সাথে মিশিয়ে দেবে দর্শককে। ভয়, উৎকণ্ঠা, ভালোবাসা, আক্ষেপের সুর ঝড় তুলবে মনের গহীনে।
২০১৩ সালের ২৮ মার্চ মুক্তি পায় পি মাক। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, লাওস, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার অনেক দেশে মুক্তি দেওয়া হয় সিনেমাটি। প্রদর্শিত হয় আমেরিকাতেও। চলচ্চিত্রটির বাজেট ছিল ১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আয় ৩৩ মিলিয়ন। মুক্তির মাত্র চারদিনের মাথায় থাই মুদ্রায় ১০০ মিলিয়ন (১ থাই বাথ = ২.৭২ টাকা) আয়ের ক্লাবে প্রবেশ করে এটি। ২৮ মার্চ মুক্তির পর ৭ এপ্রিল, মাত্র নয়দিনের মাথায় পেছনে ফেলে থাইল্যান্ডের তৎকালীন সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ডধারী সিনেমা 'দ্য লিজেন্ড অব সুরিয়োথাই'কে।
২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পিরিয়ডিক ড্রামা ধারার সিনেমাটিকে পেছনে ফেলে ক্ষান্ত হয়নি পি মাক। শেষঅবধি থামে ১.০২ বিলিয়ন থাই বাথ-এ, আমেরিকান মুদ্রায় যা ৩৩ মিলিয়ন ডলার। এমন সিনেমার ঝুলিতে পুরস্কার না থাকলে ষোলআনা বৃথা। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পরের বছর এশিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ডসহ ঝুলিতে আছে আরও অসংখ্য সম্মাননা। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১৫টি মনোনয়ন প্রমাণ করে পি মাকের সাফল্য।
ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর। ভালোবাসা অমর। কোনো উপমাতে তাকে বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। প্রিয়তমকে কাছে পেতে, একটুখানি আলিঙ্গন করতে কতটা পথ পাড়ি দিতে পারে প্রেমিক সত্ত্বা, পি মাক সেটিই তুলে ধরেছে পর্দায়। জানিয়েছে, প্রেম পুরনো হয় না। এক জনমে ভালোবেসে তৃপ্তিও মেটে না।
This article is in Bengali language. It is a review about the most commercially successful film of Thailand- 'Pee Mak' (2013).
Necessary refernces have been hyperlinked inside the article.