Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রকৃতিমঙ্গল ও একজন দ্বিজেন শর্মা

পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;

পৃথিবীর সব রুপ লেগে আছে ঘাসে;

পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে;

আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির রুপ বর্ণনাকারী এ উক্তিগুলো কিছুটা অন্যরকম হয়ে উঠে এসেছে দ্বিজেন শর্মার প্রকৃতিমঙ্গল বইতে। প্রকৃতির রুপ ও তাকে বাচানোর আকুতি যথার্থভাবে উঠে এসেছে এ বইটিতে। লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে প্রকৃতির ভেতরের কথাগুলো তুলে এনেছেন এ বইতে। রুপ দিয়েছেন গল্পকথায়।

দ্বিজেন শর্মা (১৯২৯-২০১৭ )তৎকালীন সিলেট বিভাগের মৌলভিবাজার জেলায় বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পাথারিয়া পাহাড়ের বৈচিত্রময় উদ্ভিদসমূহের মাঝে বেড়ে উঠেছেন তিনি। সেসময় থেকেই দ্বিজেন শর্মার মনে প্রকৃতিপ্রেম বেড়ে উঠতে থাকে।

দ্বিজেন শর্মা; Source: zazafee.com

পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় তার গ্রামের পাঠশালায়। প্রকৃতির প্রতি তার অপার আগ্রহের কারণে তিনি উদ্ভিদবিদ হবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

পেশাজীবনের শুরুতে তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরবর্তীতে প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের চাকরি নিয়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে কাটিয়েছেন। দেখেছেন সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ।

তিনি পঞ্চাশের কাছাকাছি বই অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও তিনি শ্যামলি নিসর্গ, সতীর্থ বলয়ে ডারউইন, বাংলার বৃক্ষ, প্রকৃতিমঙ্গল সহ আরো অনেক উল্লেখযোগ্য বই রচনার মাধ্যমে আধুনিক বাংলা ভাষায় প্রকৃতিঘনিষ্ঠ সাহিত্যধারার অন্যতম একজন প্রবর্তক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সংবেদনশীলতা তাকে পৃথিবীর গভীর থেকে গভীরতর অসুখটি সম্পর্কে সচেতন করেছিলো। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন দ্বারা তিনি এ সমস্যাসমূহ সমাধানের পথ খুঁজেছিলেন।

পাথারিয়া পাহাড়; Source: lrbtravelteam.com

দ্বিজেন শর্মার অন্যতম রচনা প্রকৃতিমঙ্গল প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করার প্রতিযোগীতায় মত্ত হওয়া এ যুগে প্রকৃতিকে বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই যেন দ্বিজেন শর্মা তার এ বইটি রচনা করেছেন। বইটি খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় রচনা করার মাধ্যমে বইয়ের মূল উপজীব্য দ্বিজেন শর্মা পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। মোট আটটি নিজস্ব ও তিনটি অনুদিত গল্পের মায়াময় রচনাবলীর মাধ্যমে তিনি প্রকৃতির অপার রহস্যময়তা বর্ণনা করেছেন। তার এ বইটিতে কথাগুলোর গভীরে গিয়ে পাঠককে তার গল্পসমূহের অর্থ খুঁজে যেন বের না করতে হয়, পাঠক যেন সাধারণভাবে পড়ে গল্পগুলোর অর্থ ধরতে পারে- তিনি সেই চেষ্টা করেছেন।

শ্রেণিবিন্যাসের দিক দিয়ে ‘প্রকৃতিমঙ্গল’-কে মনস্তাত্ত্বিক রচনার অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সাধারণত মনস্তাত্ত্বিক রচনাগুলোতে দেখা যায় পাঠককে রচনার মাধ্যমে তাদের সচেতন বা অবচেতন মানসিক অবস্থার পরিবর্তন বা বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। লেখকও তার গল্পের চরিত্রসমূহের মাধ্যমে মানুষের মনে প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। পাঠশালার সেই ছেলেটির অনেক বছর পর বাড়ি ফিরে পুরনো স্মৃতির রোমন্থন কিংবা এতিম ছেলে ও বিধবা জেলে বৌটির গাছের কাছে আশ্রয় চাওয়া এবং গাছ ও তাদের মাঝে করা কথোপকথন এ সবের মাঝেই লেখক চেয়েছেন যেন তার পাঠকদের প্রকৃতির লীলা, তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উপলব্ধি ঘটে।

আমরা পৃথিবীতে বাস করি বলে পৃথিবীর আলাদা কোনো অস্তিত্ব আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। প্রকৃতির সাথে যে আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে আছে সে ব্যাপারটাও আমরা একই কারণে ভুলে যাই। প্রাণ ও প্রকৃতির মাঝের ভুলে যাওয়া এ নিবিড় সম্পর্ক লেখক তার গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পে গল্পে বর্ণনা করেছেন প্রকৃতির প্রতি আমাদের অবহেলা, প্রকৃতিকে ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তার কথা। ‘বৃক্ষের জন্য ভালোবাসা’ গল্পের একাংশে লেখক বলেছেন,

“আমি তার দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। তিনি বলেন, গাছ নাকি বলছে, “হে মানবকুল, আমি তোমাদের শীতের আগুন ও গ্রীস্মের ছাতা। আমার ফল খেয়ে তোমরা চলার পথের ক্লান্তি দূর করো। আমি তোমাদের মাথার উপর ছায়ার আচ্ছাদন ধরে রাখি। তোমাদের টেবিল, শয্যা, নৌকা, লাঙ্গল, শিশুর দোলনা, এমনকি মৃতের কফিনও যোগাই। দিই খাদ্য ও মনোরম পুস্প। আমার শুধু একটিই মিনতি, আমার কাছে আসো কিন্ত আমার কোনো অনিষ্ট কোরো না।”

মনে হলোও চরাচর নিঃশন্দ হয়ে গেছে। বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল ফুলের সুগন্ধ আর গাছের করুণ মিনতি। কাকাবাবু আমাকে গাছের কাছে দাঁড় করালেন এবং বললেন, “ওকে জড়িয়ে ধরে কান পাতো, চোখ বুজো, শুনতে পাবে তার ওই কথাগুলি।” আমি তা-ই করি। একটা গুম গুম আওয়াজ ওঠে যেন সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পরবে। ধীরে ধীরে সম্মোহিত হতে থাকি। অনেকক্ষণ কাটে। একসময় টের পাই কেউ আমাকে টানছে, লেপটে যাচ্ছি গাছের গায়ে। ভয় হলো, মনে হলো আমার ওপর ওর রাগ থাকতে পারে, তাই ওকে ঠেলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। কিন্তু কাকাবাবু কই? তাকে ডাকলাম, কোনো সাড়া এল না। গোটা বন ঘুরে বেড়ালাম। না, কোথায়ও নেই। বাড়ি গেলাম। যাননি ওখানেও। অনেক খোঁজাখুঁজি হলো। গোটা তল্লাটেও কেউ তাকে দেখেনি।“

গল্পের লেখনিতে দুটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, যার প্রথমটি হলো প্রকৃতির জন্য কিছু মানুষের নিবেদিত প্রাণ, অন্যটি প্রকৃতির অনিষ্ট করার পর অনুশোচনায় দগ্ধ হৃদয়। তার এ বইটিকে এ জন্যই মনস্তাত্ত্বিক শ্রেণিভুক্ত করা যায়। লেখক যেন পাঠকের মনে ছাপ ফেলতে চেষ্টা করেছেন যে নির্বাক উদ্ভিদ বাইরের উত্তেজনায় সাড়া দেয়। তাকে কষ্ট দিলে সেও কষ্ট পায়। রোদে, তাপে আঘাতে উদ্ভিদের এ সাড়া দেয়াটাই প্রাণের বড় লক্ষণ।

রোয়াল্ড ডালের আশ্চর্য আঙুল; Source: roalddahl.wikia.com

বিদেশি গল্পগুলোর অনুবাদে দ্বিজেন শর্মা আশ্চর্যরকম পারদর্শীতা দেখিয়েছেন। ‘আশ্চর্য আঙুল’ গল্পে তিনি দেখিয়েছেন পাখির প্রতি নির্মম এক পরিবার কেমন করে নিজেরাই পাখিতে রুপান্তরিত হবার পর পাখিদের প্রতি নিজেদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। সাথে গোদের্দজি চোখেলির ‘বৃক্ষমানব’ গল্পে নায়ক বেরি কিভাবে নিজের জীবন বিপন্ন করে সন্তানের মত একটি পাইন চারাকে নিজের অঙ্গে ধারণ করে।। সে স্বপ্ন দেখে তার গায়ের চারাটি একদিন মহীরুহ হবে। একসময় সে গাছের চারাটির সাথে কিভাবে একত্রিত হয়ে যায়। আবার পশ্চিম আফ্রিকার রুপকথা ‘সে কেবল দৃষ্টি এড়ায়’- তে কিভাবে বৃক্ষ এক নারীকে রক্ষা করে।

দ্বিজেন শর্মার শেষকৃত্যে; Source: dailyasianage.com

গল্পে যে জিনিসটি সবচেয়ে প্রকট, লেখক দ্বিজেন শর্মা তার প্রত্যেকটা গল্পতেই কিভাবে বৃক্ষ ও প্রকৃতি আমাদের রক্ষা করে এবং আমরা বেশিরভাগই তাকে কিভাবে ধ্বংস করি তা আবছায়া ভাবে তুলে ধরেছেন। গল্পের ভেতর করা স্মৃতিরোমন্থন, যন্ত্রণা ও প্রায়শ্চিত্তের মাঝে ধাক্কা দিতে চেয়েছেন পাঠকমনে। গল্পে লেখক প্রকৃতির প্রতি গভীর মূল্যবোধ ও প্রকৃতিকে অনুভব করার কথা এনে তাকে বারবারই লেখনির মাধ্যমে পাঠকমনে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন প্রকৃতির প্রতি পাঠককে সচেতন করে তুলবার। যুক্তি ও কল্পনার মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন প্রকৃতির সাথে পাঠকের অস্তিত্বকে অনুভব করানোর এবং তার জায়গা থেকে তিনি সফল হয়েছেন বলেও বোধ করি।

প্রকৃতিমঙ্গল এর গল্পগুলো পাঠকদের প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি দেবে। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে নতুন অনুভুতির সন্ধান দেবে, গভীরভানে ভাবতে শেখাবে।

দ্বিজেন শর্মা তার জীবন প্রকৃতির মঙ্গলার্থে ব্যয় করেছেন। তার কিছু কথা দিয়েই শেষ করছি তার ও তার লেখনির আখ্যায়িকা,

“দুটি বই অন্নজলের মতো তার সঙ্গে সবসময় থাকে। একটি রবীন্দ্রনাথের ‘বনবাণী’, অন্যটি ফরাসি লেখক অতোয়ান দ্য স্যাৎ একজ্যুপেরির ‘দ্য লিটল প্রিন্স’। দুটিই প্রকৃতি বিষয়ক। প্রথমটিতে আছে আনন্দময় সুন্দর, দ্বিতীয়টিতে বিষাদভরা সুন্দর। অবশ্যই দুটি দুরকম, তবে মিলও আছে। দুজন লেখকই যার যার গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আরেকটি মিলও লক্ষনীয়। সেটা ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া কিছুই জানা যায় না – হোক তা গাছপালা, কোন প্রাণী বা আরেকজন মানুষ।”

তথ্যসূত্র: প্রকৃতিমঙ্গল

ফিচার ইমেজ: প্রকৃতি পরিচয়

Related Articles