Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পূর্ব-পশ্চিম: পূর্ব থেকে পশ্চিমের উপাখ্যান

সাতচল্লিশের দেশভাগ আর এর ফলে দুই বাংলার হাজার হাজার পরিবারের বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি দেয়ার ঘটনা উপমহাদেশের ইতিহাসের এক নির্মম সত্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার বিখ্যাত ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসের দুই খন্ডে তুলে ধরেছেন দেশবিভাগের সেই বিচ্ছেদ বেদনার কথা। সেইসাথে তার কালজয়ী এ উপন্যাসে উঠে এসেছে তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পালা বদলের গল্প। ঐতিহাসিক উপন্যাস না হয়েও ইতিহাসকে আঁকড়ে দুই বাংলার কয়েকটি পরিবারের গল্পকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলেছে উপন্যাসের কাহিনী। বাংলাদেশের বিক্রমপুর থেকে আমেরিকার নিউইয়র্ক জুড়ে রয়েছে এই উপন্যাসের ক্যানভাস। প্রায় তিন দশক আগে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকা উপন্যাসটি শুরু থেকেই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। পূর্ব-পশ্চিমকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ম্যাগনাম ওপাস’ বললেও ভুল হবে না।

পূর্ব-পশ্চিমের প্রচ্ছদ; Source: Boighar

উপন্যাসের শুরু পঞ্চাশের দশকে। দেশভাগের মাত্র কয়েক বছর হয়েছে, অনেকে তখনো ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেনি জীবনে আসা হঠাৎ সেই ঝড়ে। কলকাতার সাব-জজ প্রতাপ মজুমদার ঠিক তেমনই এক চরিত্র। তার পরিবারে রয়েছে তার স্ত্রী মমতা আর দুই ছেলে- পিকলু আর বাবলু। পুরো উপন্যাসে আরো বেশ কয়েকটি পরিবার থাকলেও মূলত এই পরিবারকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনী। প্রতাপ মজুমদারের তরুণ বয়স থেকে উপন্যাসের শুরু। দেশ বিভাগের আকস্মিক ঝড়ে দেশ পাল্টে গেলেও প্রতাপের মন থেকে মুছে যায়নি পূর্ব বাংলার স্মৃতি। দেশ বিভাগের সাথে সাথে বদলে গেছে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা। চিরচেনা ভিটেমাটি চিরতরে ছেড়ে আসা প্রতাপের নতুন জীবন সংগ্রামের কথা রয়েছে উপন্যাসে। সময়ের সাথে সাথে বয়স বেড়েছে প্রতাপের, বড় হয়েছে তার ছেলেরা।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন কিংবা পয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধ- সবই এসেছে উপন্যাসে। রয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর উত্থান, পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের কথা। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা সমাজকে পাল্টে দেবার স্বপ্ন নিয়ে কীভাবে নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়, সেসব গল্প লেখক বলেছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোকে দিয়েই। ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকেই গল্পের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন লেখক। তরুণ মেধাবীদের মনের মধ্যে চলা সমাজতন্ত্র বনাম ধনতন্ত্রের লড়াইকে দেখিয়েছেন একেবারে কাছ থেকে। মেধাবীদের দেশে থেকে যাওয়া কিংবা পশ্চিমা দেশে উচ্চ শিক্ষা আর ভালো সুযোগের দ্বন্দ্বটাও রয়েছে উপন্যাসে। উপন্যাসের শুরুর ছোট্ট বাবলু হয়ে ওঠে অতীন মজুমদার, নকশাল আন্দোলন বদলে দেয় যার জীবন।

নক্সাল বাড়ী, যেখানে শুরু হয়েছিল নকশাল বিপ্লব; Source: Wikimedia commons

প্রথম খন্ডের চেয়ে দ্বিতীয় খন্ডে গল্প এগিয়েছে কিছুটা দ্রুত, কিন্তু সেই দ্রুততা গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট করেনি একটুও। শুরুটা অতীনের জীবনের কষ্টকর এক অধ্যায় দিয়ে শুরু হলেও সময়ের সাথে সাথে অতীনের সাফল্যেরও দেখা পাবেন পাঠক। আর সবার মতোই অতীনের জীবনেও এসেছিল প্রেম, সেই কলকাতা থাকতেই। সেই প্রেমের পরিণতির সাথে সাথে সম্পর্কের টানাপোড়নের এক সুন্দর গল্প শুনিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের বর্তমান সময়ের মতো সেই ষাট বা সত্তরের দশকেও ভারতবর্ষ থেকে অনেকেই আমেরিকা বা ইউরোপে পড়াশোনা করতে যেত আর সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করত। বিদেশে থাকাকালীন অনেকেই ভিন্ন জাতীয়তা বা ধর্মের কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আলম আর তুতুলের সম্পর্কের টানাপোড়েন যেন সেটারই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে উপন্যাসে।

উপন্যাসটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের গল্প লেখক তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে। পাকিস্তান আর্মির ক্যান্টনমেন্ট থেকে শুরু করে বনে-জঙ্গলে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের সবার কথাই এসেছে উপন্যাসে। বাদ যায়নি কলকাতা থেকে জাতিসংঘের কূটনৈতিক লড়াইয়ের কথাও। উপন্যাসে রয়েছে জাহানারা ইমাম আর তার পরিবারের কথা। শহীদ রুমিকে নিয়ে বেশ অনেকটাই লেখা রয়েছে। ঢাকায় পাকিস্তান আর্মিকে কাঁপিয়ে দেয়া রুমি আর তার ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ অপারেশনের গল্প রয়েছে উপন্যাসে।

শহীদ রুমি; Source: The Daily Star

পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী আর তাদের মানসিক অবস্থার একটি ছবি তুলে ধরেছেন লেখক। অপারেশন জ্যাকপটে নৌ কমান্ডোদের বীরত্বের গল্প লেখক তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। উপন্যাসে এসেছে ১৪ ডিসেম্বরের দেশের বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করার পরিকল্পনার পেছনের গল্প। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিদেশে থাকা বাঙালিদের মানসিক অবস্থা, দেশের জন্য অস্থিরতা সবকিছুই এসেছে সাবলীলভাবে। উপন্যাসে বাদ যায়নি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকান্ডের কথা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ও এর পরবর্তী ঘটনা যেন লেখক নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন, এমনভাবেই তুলে ধরেছেন।

১৯৭১ এ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের শরণার্থীরা; Source: The India Quarterly

পুরো উপন্যাসে বাংলাদেশের কিছু পরিবার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতির কথা থাকলেও অতীন মজুমদারকে কেন্দ্র করেই গল্প এগিয়ে গিয়েছে। বিদেশের ভিন্ন পরিবেশ আর সংস্কৃতিতে সন্তানকে বড় করা, দেশ থেকে ঘুরতে যাওয়া বাবা-মায়ের পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে দ্বন্দ্ব উপন্যাসে তুলে ধরেছে এক অস্ফুট সত্যকে। পরিবার নিয়ে আমেরিকা থেকে ভারতে ফিরে গেলেও দুর্নীতি আর নোংরা রাজনীতির কারণে অতীনের টিকতে না পেরে আবারো আমেরিকা ফিরে যাওয়া আমাদের বর্তমান সময়েরই যেন এক প্রতিচ্ছবি।

পুরো উপন্যাস জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু অসম্পূর্ণ ভালোবাসা আর ভালোলাগার গল্প। মধ্যবিত্তের আত্মসম্মানের লড়াইয়ের এক প্রতিচ্ছবি প্রতাপ আর তার পরিবার। রয়েছে সত্তরের দশকে আমেরিকা আর ইউরোপের সামাজিক পরিবর্তনের গল্প। নতুন প্রজন্মের ভারতীয়দের নতুন চিন্তাভাবনার কথা উঠে এসেছে উপন্যাসে। প্রতাপ, পিকলু, অতীন, মমতা, তুতুল, অলি, আলম, মামুন, বাবুল চরিত্রগুলো বাস্তবে না থাকলেও সুনীল যেন জাদুবলে চরিত্রগুলোকে বাস্তব করে তুলেছিলেন। বাস্তব চরিত্র না হয়েও বাস্তবতা থেকে বিন্দুমাত্র দূরে নয় এই চরিত্রগুলো। বরং আমরা প্রতিদিনই প্রতাপ, অতীন কিংবা মামুনকে দেখি, শুধু ভিন্ন চেহারায় আর ভিন্ন নামে।

দেশভাগের সময় বাস্তুহারা মানুষ; Source: আনন্দবাজার

উপন্যাসের একেবারে শেষের দিকে লেখক নিজেই উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা বলে দিয়েছেন। সেই আদিকাল থেকেই পৃথিবীতে পূর্ব আর পশ্চিমের লড়াই চলে আসছে। দীর্ঘদিন লড়াইটা পূবের দিকেই হেলে ছিল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, ভাস্কো ডা গামা পূবের সম্পদের খোঁজেই পাড়ি দিয়েছেন বিশাল পথ। কলম্বাসের যাত্রা পশ্চিম দিকে হলেও তার লক্ষ্য ছিল পূর্বের চীন আর ভারতের সম্পদ। কিন্তু ইতিহাসের যাত্রা যেন হঠাৎ করেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে শুরু হল। সবাই এখন পশ্চিমা বিশ্বেই সাফল্য খোঁজে, পশ্চিমের রীতিনীতিকেই সফল মনে করে। পূর্ব পশ্চিম শুধু দুই বাংলাকে নয় বরং পুরো পৃথিবীকেই মোটা দাগে পৃথিবীকে দুই ভাগ করে দিয়েছে। আর পূর্ব-পশ্চিম নেই বা কোথায়! মহাবিশ্বের যে কোনো গ্রহেই মানুষ বসতি করুক না কেন, সেখানেও পূর্ব-পশ্চিম থাকবে। পূর্ব-পশ্চিমের লড়াই মানুষের মাঝে চলতেই থাকবে।

পূর্বের সম্পদের লোভে এসেছিলেন আলেক্সান্ডারও; Source: Wikimedia Commons

দেশভাগ রাজনীতি দুই বাংলাকে আলাদা করলেও দুই বাংলার মানুষের মন থেকে আলাদা করতে পারেনি। আর তারই প্রমাণ পাওয়া যায় উপন্যাসের একেবারে শেষে। উপন্যাসের লাইনগুলো দিয়ে সুনীল দেশভাগের শিকার মানুষগুলোর মনের সুপ্ত ইচ্ছার কথাগুলোই যেন জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন।

“সেই বাড়ি, আটিচালা, উঠোনের তিনদিকে পিসি-মাসিদের ঘর একই রকম আছে। সেই আম গাছ, অন্যদিকে বাতাবি লেবুর গাছ, দক্ষিণের পুকুরে মাছে ঘাই, তার অন্যপারে রহস্যময় জঙ্গল, সব ঠিকই আছে। এক্ষুনি যেন বাবা খড়ম ফটফটিয়ে আসবেন। কলকাতার থেকে এখানকার বাতাসে কত আরাম!”

ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons

Related Articles