মানুষের জীবনটা একটা রঙ্গমঞ্চ। সেই মঞ্চে পুতুলনাচের পাত্র হয় মানুষ। কিন্তু কে নাচায়? মানুষ কি জানে, তাকে পুতুলের মতো করে নাচাচ্ছে অন্য কেউ? জানলেও কি সে বাঁধন ছিঁড়তে চায়? নাকি জীবনপথের রঙ্গমঞ্চে পুতুলনাচের পুতুল হয়েই কাটিয়ে দিতে হয় তাকে? মানবজীবনরূপী এই রঙ্গমঞ্চের পুতুলনাচ খেলার গল্প বলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার পুতুলনাচের ইতিকথায়।
উপন্যাসের পটভূমি গাওদিয়া গ্রাম। তবে গল্পের তাগিদে চরিত্রদের কখনো কখনো গ্রাম ছেড়ে দূর শহর কলকাতায় নিয়ে গেছেন লেখক। গাওদিয়া গ্রামের ছেলে শশী, উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট। গাঁয়ের ছেলে হলেও শহরে লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছে সে। নিজ গাঁয়েই প্র্যাকটিস শুরু করেছে। তার গাঁয়ের জীবন, সেখানকার মানুষের সাথে সম্পর্ক, জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি- এসব ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে পুতুলনাচের ইতিকথা।
শশীর মনন দ্বিমুখী। সে কী চায়, সে নিজেও জানে না। সে কখনো চায় নিজের গাঁয়ের ভালোবাসায় আমৃত্যু বেঁচে থাকতে। আবার কখনো ভাবে, কী হবে এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে থেকে? তখন তার কল্পনার দৃষ্টি তাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে, অন্য কোনো উন্নত দুনিয়ায়। শহরের চাকচিক্যময় জীবনের স্বপ্নও দেখে সে। ফ্রয়েডে অনুরক্ত মানিক শশীকে দেখিয়েছেন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ভোগা এক তরুণ, যে কিনা প্রতিনিয়ত তার মনের সাথে যুঝে যাচ্ছে। ইগো, সুপার-ইগোর এই দ্বন্দ্বে পড়ে দিশাহারা অবস্থা হলেও শশীর মূল কিন্তু এই গাঁয়েই বাঁধা! সে মূল উৎপাটন করবে কে? বরঞ্চ কুসুম, মতির মতো চরিত্ররা সেই মূল আরও গভীরে প্রোথিত করে। এদের কাউকে আশ্রয় করে সে বাঁচতে চায়। কাকে? হয়তো মতিকে।
কিন্তু হঠাৎ করেই শশীর কলেজজীবনের বন্ধু কুমুদ যখন মতিকে 'দখল' করে নেয়, বিয়ে করে দূরে কোথাও চলে যায়, তখন শশীর একটি আশ্রয় ছিন্ন হয়ে যায়। মতিকে পাওয়ার জন্য সে এতটাই উতলা হয়েছিল যে সে ভাবে, নিজেই মতিকে বিয়ে করবে। এ কথা যখন সে কুসুমকে জানায়, কুসুম তা হেসে উড়িয়ে দেয়। কুসুম এক রহস্যময় মানবী। তার কাছে শশী পরোক্ষভাবে পরাজিত হয় সবসময়। মতিকে হারানোর ভয় কি কিছুটা প্রশমিত হয় কুসুমের মাঝে? কুসুম কী চায়, শশী তা বুঝতে পারে না। আর শশী নিজেও জানে না, কুসুমকে সে ভালোবাসে কিনা। তাদের এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব খোলাসা হয়, যখন কুসুম গাঁ ছেড়ে চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে। তখনই শশীর চোখের সামনে থেকে সব অন্ধকার ঘুচে যায়। সে টের পায়, কুসুমই তার শেষ আশ্রয়স্থল।
‘মনটা কেমন করিয়া ওঠে শশীর। হয়তো পরশু, তার পরদিন কুসুম গাঁ ছাড়িয়া যাইবে, আর আসিবে না।’
মরিয়া হয়ে সে কুসুমকে বলে ফেলে তার মনের কথা। নির্লজ্জের মতো পালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু কুসুম জানায়, সাত বছরে এটুকু আহ্বানই সে চেয়েছিল, কিন্তু তা সে পায়নি। কোনো একসময় শশীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে‘এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু’ বলা কুসুম এবার তাকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করে, কারণ দীর্ঘ সাত বছরে কুসুমের ভালোবাসার ফুল শশীর অনাদরে, অবহেলায় তাদের দুজনের অজান্তেই ঝরে গেছে- এখন আর সেই অব্যক্ত ভালোবাসাকে পুনর্বার উজ্জীবিত করার কোনো উপায় নেই। শশীর জন্য কুসুমের মনে আর ছিটেফোঁটা ভালোবাসাও নেই। এ জায়গায় এসে পাঠকের মনে হবেই, ভালোবাসার কী নিদারুণ অপচয়। শুধু মনোগত যোগাযোগের অভাব বলে আজ এই অকৃত্রিম, অ-স্বীকৃত ভালোবাসাটুকু প্রস্ফুটিত হতে পারল না।
তারপর কী হয় শশীর? কুসুমও নেই, মতিও নেই– তারাই তো এতদিন তার আত্মাকে এ গ্রামে বেঁধে রেখেছিল। নিজের বাপ গোপালকে কখনো মন থেকে ভালোবাসতে পারেনি শশী। মতি আর কুসুমের প্রস্থানে এই গাওদিয়ায় তার জন্য আর কেউ রইলো না। তবে কি শশী নিজের স্বপ্নের দুনিয়ায় চলে যাবে? যেখানে কোনো পিছুটান নেই, নেই মায়ার ভ্রান্তি। কিন্তু মৃত্যুর আগে যাদব যে তাকে নতুন দায়িত্ব দিয়ে যায়। গাঁয়ে হাসপাতাল বানানোর কাজ, সেই হাসপাতালের ভার গ্রহণের কাজ। চিরকাল গ্রামের বদ্ধ জীবন থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে চাওয়া শশীকে অবশেষে সেই আরেক নতুন বন্ধনের ফাঁদে পড়ে যেতে হয়। যে ফাঁদ থেকে বের হওয়ার আর কোনো উপায় থাকে না তার হাতে। গ্রামের হাসপাতালের স্থায়ী ডাক্তার হিসেবে শশীর নতুন জীবন শুরু হয়।
এও যেন এক পরিহাস! শেষ পর্যন্ত যাদবই যেন শশীর জীবনে পুতুলনাচের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হয়। জীবনরূপী এই পুতুলনাচকে বরণ করে নিতে হয় শশীকে। পুতুলের সুতো ছেঁড়া আর তার হয় না। উপন্যাসটির শেষে শশীর আপাত এই পরিণতি দেখে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে নিজের জীবন নিয়েও- জগৎসংসারে আমরা সবাই যে এক পুতুলনাচের চক্করে বাঁধা পড়েছি। এ থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় নেই?
বইয়ের নাম: পুতুলনাচের ইতিকথা || লেখক: মানিক বন্দোপাধ্যায়
প্রকাশক: প্রকাশ ভবন || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম
This article is in Bangla language. This is a review on a Bengali novel named 'Putul Naacher Itikotha' by profound novelist Manik Bandopadhyay.
Featured Image: dailyasianage.com