Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আলালের ঘরের দুলাল: গভীর এক সামাজিক বিশ্লেষণের আখ্যান

বাংলা সাহিত্যের যতগুলো ক্ষেত্র আছে, তার মধ্যে হালে সবচেয়ে প্রচলিত ও লোকপ্রিয় ক্ষেত্র হচ্ছে নভেল বা উপন্যাস। নভেল পড়েনি বা দেখেনি শিক্ষিত মহলে এমন লোক খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। কিন্তু দেড়শো বছর আগের কথা একটু ভাবুন তো। সে যুগে মানুষ পয়ারে (চরণান্তে স্বরের মিলযুক্ত ছন্দ) অভ্যস্ত ছিল। নভেল কী বা সেটার ধাঁচই বা কেমন- ইংরেজি জানা দুয়েকজন ছাড়া কেউ সবিশেষ ধরতে পারতো না। প্রথম যে ব্যক্তিটি বাংলার মানুষকে নভেল বা উপন্যাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, তিনি আর কেউ নন– প্যারিচাঁদ মিত্র। যার সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী প্যারিচাঁদ মিত্রই প্রথম বাংলা ভাষায় নভেল লিখে দেখান। উপন্যাসটির নামও চমৎকার, ‘আলালের ঘরের দুলাল’।

তিনি চল্লিশ বছর বয়সে ‘মাসিক’ পত্রিকায় কয়েক সংখ্যায় উপন্যাসটি লেখেন। ১৮৫৪-তে ‘মাসিক’-এ ছাপা হয়। বলে রাখা ভালো, এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সে সময়কার প্রসিদ্ধ গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার। রাধানাথ শিকদার ও প্যারিচাঁদ মিত্র ছিলেন বাল্যবন্ধু। পত্রিকায় প্রকাশের বছর চারেক বাদে এটি বই আকারে ছাপা হয়। পুরো কলকাতা জুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। প্যারিচাঁদ মিত্র এই নতুন সাহিত্যটিকে পরিচিত করান ‘উপন্যাস’ নামে। তখনো এ ধরনের বড় গল্পের যুতসই বঙ্গানুবাদ না থাকায় একে ‘নভেল’ বলার চল ছিল। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ সে সময় সাহিত্যিক মহলে আরেকটি কারণে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কারণটি ছিল, গুরুগম্ভীর সাধুর বদলে সমাজের সাধারণ জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত চলিত ভাষার প্রয়োগ। হালকা চালে এর ভাষার বিন্যাস করা হয়েছে। শব্দযোজনা দেখলেই বোঝা যায়, এটি করা হয়েছে স্বপ্রণোদিতভাবে, সমাজের সর্বস্তরের পাঠকের সুখপাঠ্য করে। প্যারিচাঁদের এই ভাষা প্রসিদ্ধ হয়েছিল ‘আলালী ভাষা’ নামে।

প্যারিচাঁদ মিত্র; Image Source : Anandabazar
প্যারিচাঁদ মিত্র; Image Source : Anandabazar

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দিকে লক্ষ্য করলে চোখে পড়বে শুধু ধর্মীয় বা রোমান্টিক আখ্যান-উপাখ্যান। তৎকালে কবিগণ ধর্মের আশ্রয়ে তাদের রচিত সাহিত্য প্রসিদ্ধ করেছেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের এ সাহিত্যটিতে প্যারিচাঁদ নিয়ে এলেন সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা, প্রথা, সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতির জিগির। সদ্য পরাধীন একটি দেশ। সে দেশের সংস্কৃতি, রীতি-নীতিতে অবাধে হচ্ছে দখলদারদের সংস্কৃতির মিশেল। কোর্ট-কাছারি, আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বাঙালি এগুলোকে আশ্রয় করে নতুন নতুন পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরছে, পাম্প শু ছেড়ে বুট ধরছে। ঠিক এরকম একটি সময়কে প্যারিচাঁদ বেছে নিয়েছিলেন। ইংরেজদের প্রশ্রয়ে জমিদার-তহসিলদার-জোতদার শ্রেণির উত্থান হচ্ছে। আর কিছু শ্রেণি গড়ে ওঠে ইংরেজদের আদালতকে ঘিরে। মহুরি, পেশকার, উকিলের সহকারী প্রভৃতি কয়েকটি পেশা।

এমনই একজন ছিলেন বাবুরাম বাবু। তার বিপুল বৈষয়িকতার মধ্যে তিনি ভুলে যান তার একমাত্র পুত্রকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে। পিতার এমন আদর ও ঔদাসীন্যে পুত্র মতিলাল বখে যায়। মতিলালই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তাকে কেন্দ্র করেই ঘটনা প্রবাহিত হতে থাকে। মতিলালকে বিভিন্ন উপায়ে শিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়ে বাবা তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাতেও মতি ফেরে না মতিলালের। বাবার মৃত্যুর পর পুরো বিষয়-আশয় করায়ত্ত করে মতিলালের ভোগবিলাসতা ও অসৎকর্মের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। চারদিকে অসৎ ও কুসঙ্গ নিয়ে মতিলাল পরিবেষ্টিত থাকে সর্বদা। তার মা-বোন তাকে ত্যাগ করে। একপর্যায়ে মতিলালের কাশী গিয়ে মতি ফেরে। সেখানে মা ও বোনের সাথে মিলন হয়।

রাধানাথ শিকদার; Image Source : thebetterindia
রাধানাথ শিকদার; Image Source : thebetterindia

সামাজিক সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়ে মূলত লেখক এটি রচনা করেছিলেন। তৎকালীন কলকাতার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাপারে জানা যায় এর মাধ্যমে। দেশে ফারসির চল ও ইংরেজির প্রতি নব আগ্রহ দেখিয়ে লেখক অপ্রত্যক্ষভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাংলার প্রতি উদাসীনতাকে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের কদর ও চাকরিতে অগ্রাধিকারের বিষয়ে যেন লেখকের ছিল কিঞ্চিৎ ক্ষোভ। আর দুর্নীতির বিষয়াদি তো উপন্যাসের একটি বড় আকর্ষণ। টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা সত্যে পরিণতকরণ দিয়ে যেন চিরপরিচিত সামাজিক সমস্যাগুলোই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন লেখক।

আনিসুজ্জামান সম্পাদিত “আলালের ঘরের দুলাল”-এর প্রচ্ছদ; Image Source : Amazon
আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর প্রচ্ছদ; Image Source : Amazon

উপন্যাসের চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করলেই সেসময়কার মানুষের স্বরূপের সন্ধান মেলে সহজেই। বাবুরাম বাবু, যিনি ছিলেন মতিলালের বাবা, দিবস-রজনী শুধু অর্থের পেছনেই ছুটেছেন। সন্তানকে অতি আদর ও বৈভবে রেখে নীতিহীন করেছেন। বাংলাদেশে এমন উঠতি ধনীরা খুব অপরিচিত নন। বাবুরাম বাবুর পুত্র মতিলাল। মাদকাসক্ত, চরিত্রহীন ও নীতিহীন এক কিশোর। ‘অতি আদরে বাঁদর’ প্রবাদের যথাযথ প্রয়োগের দেখা মেলে তার মধ্যে। মতিলালের মা ও বোনেরা সে যুগের অন্তঃপুরবাসিনীদের প্রতিনিধিত্ব করে। বোনদ্বয়ের সংলাপে স্পষ্টভাবে সে কথা বোঝা যায়।

বাবুরাম বাবুর শুভানুধ্যায়ী বেণীবাবু ও বেচারাম। যাদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় মতিলালের শিক্ষার। শেষে তারা ব্যর্থ হয়। বাবুরামকে বেণীবাবু পুত্রের শাসনের ব্যাপারে উপদেশ দেয়। তবুও বাবুরাম বাবুকে নির্বিকার দেখায়। আর আছে বাবুরাম বাবুর চারপাশের মোসাহেবের দল। এরা হাঁ তে হাঁ, না তে না মেলায় সর্বাবস্থায়। ধনীদের চৌকাঠের তলায় পরজীবী হয়ে বাঁচাই এদের ধর্ম। উপন্যাসের অপূর্ব চরিত্রটি হচ্ছে ঠকচাচা। যার পরামর্শে ও সাহায্যে বাবুরাম বাবু মিথ্যা মামলা জিতে ফেরেন। ঠকচাচার সাহায্যে লেখক তুলে ধরেছেন উপনিবেশিক যুগের প্রারম্ভিক সেই জোচ্চোর শ্রেণিকে, যারা দুর্নীতিকে গ্রহণ করেছিল পেশা হিসেবে।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ কোনো জটিল কাল বা মন বিশ্লেষণাত্মক উপন্যাস নয়। সরাসরি সুনীতি ও কুনীতির স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে এখানে। লেখক নিজেও মাঝে মাঝে উপদেশ প্রদান করেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, পঁচিশ বছর পর্যন্ত ছেলেদের বাবা-মায়ের প্রত্যক্ষ শাসনে রাখা উচিত। এমন করলে সারাজীবনেও সে সন্তান নীতিবিমুখ হতে পারবে না। বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেছেন। গুরুর প্রতি তার শিষ্যকে শাসন করতে বলেছেন কঠোরভাবে, যাতে শিষ্যের পরবর্তী জীবন উজ্জ্বলতর হয়। পুরো উপন্যাসেই এমন অসংখ্য উপদেশ লেখক প্রবেশ করিয়েছেন নির্দ্বিধায়।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে ৩০ টি অধ্যায়ে। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে শীর্ষে মূল ঘটনাগুলো কয়েকটি টীকা আকারে বলে দেওয়া হয়েছে। প্রথম অধ্যায় এমন করে বলা হয়েছে– 

বাবুরাম বাবুর পরিচয়, মতিলালের বাঙ্গালা, সংস্কৃত ফার্সী শিক্ষা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যার রচিত “দুর্গেশনন্দিনী”-কে প্রথম সার্থক উপন্যাসের তকমা দেওয়া হয়; Image Source : Wikieand
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যার রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’-কে প্রথম সার্থক উপন্যাসের তকমা দেওয়া হয়; Image Source : Wikieand

এভাবে ঘটনাগুলোকে তিরিশটি ভাগে ভাগ করে লেখা হয়েছে। দেখে মনে হবে, ছোট ছোট তিরিশটি গল্প। উপন্যাসটিকে হীরারাল মিত্র নাটকে পরিণত করে বেঙ্গল থিয়েটারে মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৮৭৫ সালে। উপন্যাসটিকে ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হয়েছে। এর ইংরেজি সংস্করণের নাম ‘দ্য স্পয়েন্ড চাইল্ড’। ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কে প্রথম উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া হলেও প্রথম সার্থক উপন্যাসের তকমাটি লেগেছে বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’-র গায়ে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্র নিজে আলালী ভাষার অনুরাগী ছিলেন। উপরন্তু, তিনি প্যারিচাঁদ মিত্রকে প্রথম উপন্যাসিক এবং ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কে প্রথম উপন্যাস বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তার ‘বেঙ্গল লিটারেচার’ শীর্ষক রচনায়।

আলালের ঘরের দুলাল বইটি কিনতে ভিজিট করুন রকমারি ডট কমে।

Related Articles