Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট: যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া এক প্রজন্মের গাথা

১৯৩৩ সালের ১০ই মে রাতের অন্ধকারে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। বইয়ের পাতা পুড়ছে, নাৎসি বাহিনীর লোকেরা আশপাশের বইয়ের দোকানগুলো থেকে বই খুঁজে নিয়ে এসে ছুড়ে দিচ্ছে আগুনের শিখায়। অবলীলায় হাজার হাজার বই হছে যাচ্ছে ছাই-ভস্ম। পুড়ে যাওয়ার তালিকা থেকে বাদ যায়নি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত এরিক মারিয়া রেমার্কের বেস্টসেলার উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। ‘হিটলার চিরজীবি হোন’ এই স্লোগানের আড়ালে চাপা পড়ে অনেকটা নীরবেই পুড়ে যাচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় লেখা এই কালজয়ী উপন্যাস।

পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি নাৎসিরা, নির্দেশ দেওয়া হলো কোনো দোকানে এই বই রাখা যাবে না, নতুন করে ছাপা হলে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। কারো বাড়িতে ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ কিংবা এর সিকুয়েল ‘দ্য রোড ব্যাক’ এর কোনো কপি থাকলে তা দ্রুত ‘গেস্টাপো’র কাছে জমা দিতে হবে। অন্যথায় নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।

নাৎসি বাহিনীর বই পুড়ানোর মহোৎসব; Image source: National Archives and Records Administration

কন্ঠরোধ করে দেওয়ার চেষ্টা হলো অনেক লেখকের। প্রতিবাদ করলেই তাকে দেওয়া হচ্ছে কঠিন সাজা। প্রাণের ভয়ে অনেকেই পালিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের দেশগুলোতে। এরিক মারিয়া রেমার্ককের খোঁজও শুরু হয়ে গেল। ইহুদী কিংবা কমিউনিস্ট কোনো দলেই নেই এই রেমার্ক। তারপরেও নাৎসিরা তার বাড়িতে হানা দেয়। কোনোরকম পালিয়ে রেমার্ক চলে গেলেন সুইজারল্যান্ড। কিন্তু কি এমন লিখেছিলেন এই ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ উপন্যাসে? কীসের জন্য এত তোলপাড়?

এরিক মারিয়া রেমার্ক; Image source: citaty.editmax.eu

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতা, ভয়াবহতা, সামরিক কিংবা মানসিক বিপর্যয় নিয়ে অনেক উপন্যাস আছে কিন্তু ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ছাড়িয়ে গেছে সবগুলোকে। বইয়ের ভূমিকাতেই রেমার্ক লিখেছেন,

এই বইটি কাউকে দোষারোপ কিংবা কারো বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি হিসেবে নয় বরং এটি যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি প্রজন্মের কিছু না বলা কথার সংকলন, যে কথাগুলো এখনো চাপা পড়ে আছে যুদ্ধের ভয়াবহ গোলার সামনে থেকে বেঁচে ফেরা মানুষগুলোর মাঝে।

‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Image source: Richard Levine

বইয়ের শক্তিশালী এই ছোট ভূমিকা পড়েই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে রেমার্ক কোন প্রজন্মের কথা বলতে চাইছেন? তিনি কিংবা তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো কার প্রতিনিধিত্ব করবে? হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মের মধ্যে তিনিও কি আছেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে একটু পেছন ফিরে তাকালেই। রেমার্কের বয়স সবেমাত্র আঠারো বছর। হেসে খেলে বেড়ানো এক জার্মান তরুণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামো বাজলো। স্কুল থেকে দলে দলে তরুণদের ডেকে পাঠানো হলো যুদ্ধে। যে বয়সে বই পড়া, কবিতা লেখা, প্রেম করা কিংবা পরিবারের সাথে নিরাপদ সময় কাটানোর কথা সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিলো সম্মুখ সমরের।

২৬ নভেম্বর ১৯১৬ সালে ১৮ বছরের তরুণ এরিক পল রেমার্কের ডাক পড়ে যুদ্ধে যাবার। ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ উপন্যাসের বর্ণনাকারী এবং প্রধান চরিত্রের নামও ছিল ‘পল’। তবে উপন্যাস প্রকাশ করার সময় রেমার্ক তার মায়ের স্মরণে নাম তার নামে ‘মারিয়া’ যুক্ত করে দিয়েছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই রেমার্ক যখন সম্মুখ সমরে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তখন তার মা মারা গিয়েছিলেন।

উপন্যাসের মূল চরিত্র পল ব্যমার, সে ছাড়াও সম্মুখ সমরে তার ক্লাস থেকে তার কয়েকজন সহপাঠী যোগ দিয়েছে। পলের সাথে একই কোম্পানিতে আছে তার ক্লাসের আলবার্ট ক্রপ, মুলার, জ্যাডেন, ফ্রাঞ্জ কেমেরিখ, লিয়ার এবং জোসেফ বেহম। এদের সবার বয়স আঠারো কিংবা উনিশের ঘরে। তবে তাদের দলে আছে স্ট্যানিলাস ক্যাটজিন্সকি। চল্লিশের কোঠায় থাকা এই তরুণকে সবাই ক্যাট বলেই ডাকে। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং পলের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।

উপন্যাসের বর্ণনা যত সামনে এগিয়েছে পল সামনে থেকে তার বন্ধুদের একে একে মরতে দেখেছে। যুদ্ধ মানুষকে কতটা স্বার্থপর করে তোলে তা চোখের সামনে ফুটে উঠেছে পলের বর্ণনায়। ভালো খাদ্য আর বাসস্থানের তীব্র সংকট যুদ্ধে সৈনিকদের মাঝে কি ক্ষোভের অবতারণা করে তাও ফুটে উঠেছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। কেমেরিখ তার মৃত্যু শয্যায়ও চুরি যাওয়া ঘড়ির কথা চিন্তা করছে আর মুলার তার কাছে চাইছে তার বুটজোড়া। কেমেরিখ দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়ার আগে মুলার দাবী জানায় বুটগুলো যেন তাকেই দিয়ে যায়। যুদ্ধের অভাব আর দুর্দশা নিষ্ঠুরভাবে অনুভূতি ভোঁতা করে দিয়েছে এই যোদ্ধাদের।

যুদ্ধের উপন্যাসে সাধারণত সৈনিকদের বীরত্ব, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে অনুপ্রেরণা তুলে ধরা হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রেমার্কে তার উপন্যাসে মৃত্যুকেই আসল শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পুরো উপন্যাসে ‘শত্রুপক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার খুব কমই ব্যবহার করেছেন, এর পরবর্তীতে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘অপর পক্ষ’। অপরপক্ষের সৈনিকেরাও তো তাদের মতই মানুষ এই অতি সাধারণ মানবিক ধারণাটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে উপন্যাসের নায়ক পলের কথায়।

কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী সমস্যা তাদের মতো দাঁড় করিয়েছে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে। একান্তই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে উপন্যাসের নায়ক পলের হাতে খুন হয় ফরাসী এক সেনা। নিহত সেই সেনা আর তার পরিবারের কথা চিন্তা করে পলের আকুতি স্পর্শ করে যাবে যেকোনো পাঠককে। কিন্তু পরমূহুর্তেই দেখা যাবে, সেনাবাহিনীর পেশাদার স্নাইপাররা দিনে কয়জন প্রতিপক্ষ খুন করছে সেই হিসেব নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে। এই উপন্যাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতছে যুদ্ধ উনিশ-বিশ বছরের তরুণের কাছে যা, একজন পেশাদার ত্রিশ কিংবা চল্লিশ বছরের সৈনিকের কাছে তা নয়।   

এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য; Image source: John Springer Collection

যুদ্ধের অমানবিক নৃশংসতা তরুণদের মনে কত গভীরভাবে দাগ কাটে তাও ফুটে উঠেছে উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ে। কথার ছলে যখন পলের এক বন্ধু হুট করে জিজ্ঞেস করে এখন যদি যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় তবে তারা কে কী করবে? এই প্রশ্নের উওর দিতে গিয়ে তারা হতবাক হয়ে যায়। দীর্ঘদিন যুদ্ধের এই গোলাবারুদ আর রক্তমাখা খেলা দেখে তারা কি আবারো সাধারণ জীবনে ফেরত যেতে পারবে? নাকি সারাটা জীবন তাদের তাড়া করে ফিরবে এই দুঃসহ সব স্মৃতি? মাঝবয়সী কিংবা যাদের স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়ে আছে তারা যুদ্ধের পরে আবারো তাদেরকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করবে কিন্তু এই তরুণেরা কী করবে?

যুদ্ধচলাকালীন সময়েই ঘটনাক্রমে পল এক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছুটি পায়। মায়ের সাথে দেখা করার জন্য তার উৎসাহ আর উদ্দীপনায় ভরে উঠে ট্রেন ভ্রমণের প্রতিটি মুহুর্ত। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছে যেন এক শূন্যতা ঘিরে ধরে পলকে। সারাক্ষণ যুদ্ধের মধ্যেই ডুবে থাকা পল হুট করে মুক্ত জীবনে এসে খাপছাড়া অনুভব করতে থাকে। মনে হতে থাকে জ্যাডেন, মুলার আর ক্যাটের কথা। 

এই উপন্যাসের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে স্বার্থপর এক যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাবারুদের মুখে গড়ে উঠা বন্ধুত্বের গল্প। একে একে পল মরতে দেখেছে তার বন্ধুকে। মৃত্যু পথযাত্রী বন্ধুর সাথে যুদ্ধের একেকটি মুহুর্তের স্মৃতি রোমন্থনের মুহুর্ত চোখে জল আটকে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। 

‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ সিনেমার পোস্টার; Image source: Universal Pictures

যুদ্ধের উপন্যাসগুলোতে যেখানে একপক্ষীয় বীরত্ব, শৌর্য-বীর্য দেখাতেই ঔপন্যাসিকেরা ব্যস্ত থাকেন সেখানে রেমার্কে যুদ্ধের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলেছেন। তাই ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’কে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস হিসেবেই গণ্য করা হয়। কালজয়ী এই উপন্যাস থেকে ১৯৩০ সালে তৈরি হয়েছে একই নামের সিনেমা। যেটি সেরা ছবির জন্য অস্কারেও পুরস্কৃত হয়েছে। পরবর্তীতেও অনেকবার এই উপন্যাস থেকে নির্মাণ করা হয়েছে অগণিত নাটক ও সিনেমা।

শান্তিকামী মানুষের জন্য চিরকাল আলোর মশাল হয়ে পথ দেখিয়ে যাবে ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’।  

ফিচার ইমেজ- theculturetrip.com

Related Articles