
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার মেসোপটেমিয়া। এর মধ্যে পড়ে সুমেরীয় সভ্যতা। আজ থেকে প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে গড়ে উঠা এই সভ্যতায় রচিত হয়েছিল বিখ্যাত এক গল্প। নাম গিলগামেশের মহাকাব্য। সেই গল্প কি আসলেই সত্য? নাকি কেবল নিছক কল্পনায় গড়ে ওঠা গল্প? নাকি অনেকটাই সত্যি যার সাথে কল্পনার মিশ্রণ দিয়ে গল্পটাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে?
সত্য মিথ্যা যা-ই হোক সব ছাপিয়ে গল্পের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে আছে উপভোগ করা। এ ধরনের গল্পগুলোকেই আমরা পৌরাণিক কাহিনী বা লোককাহিনী অথবা মিথ, মিথোলজি কিংবা মাইথোলজি নামেই চিনি এবং জানি। মিথোলজি শব্দটি মূলত দুটি আলাদা শব্দের সমন্বয়ে তৈরি। মিথোস বা মাইথোস শব্দটি থেকে মিথ শব্দটি এসেছে যার অর্থ দাঁড়ায় গল্প। আর একইভাবে লোগোস শব্দ থেকে এসেছে লজি শব্দটি যার অর্থ দাঁড়ায় বিশ্লেষণাত্মক বিবৃতি। শব্দ দুটি জোড়া দিলে মিথোলজির অর্থ দাঁড়ায় গল্পের বিশ্লেষণাত্মক বিবৃতি। আরো সহজ ভাষায় বললে, মিথ হচ্ছে ঐ সমস্ত গল্প যেগুলো সত্য-মিথ্যের ধার ধারে না কেবল বিশ্লেষণাত্মক বিবৃতি দেয়।
মিথের আরো সহজ বাংলা হচ্ছে পুরাণের কাহিনী অথবা পৌরাণিক কাহিনী, যাকে লোককাহিনীর একটা প্রাচীন প্রকারভেদও বলা যেতে পারে। পৃথিবীর অসংখ্য মিথের মতো বাংলাদেশেরও আছে অসংখ্য লৌকিক গল্প। কিছু হয়তো আমরা ছোটবেলায় দাদা-দাদী বা নানা-নানীর কাছে শুনেছে কিংবা রূপকথার গল্প বইতে পড়েছি। আবার কিছু হয়তো একদমই অজানা। সেরকম জানা-অজানা লৌকিক কিছু গল্পের সংকলন হচ্ছে বঙ্গদেশি মাইথোলজি নামক বইটি।
যা লোকে দেখে না তার কুৎসা রটনা করা সহজ। অজানা বিষয়ে মানুষ কুৎসা রটায় বেশি। জানা বিষয়ে মানুষ এত মিথ্যা ছড়াতে পারে না। - রাজীব চৌধুরী
বইয়ের গল্পগুলো পড়ার আগে মাথায় এটা রাখা উচিত যে, এই গল্পগুলো পড়ে কেবল আনন্দ উপভোগ করতে হয়; সত্য বা মিথ্যা কি না সেটা নির্ণয় করাটা বোকামি ব্যতিরেকে অন্য কিছুই না। এতে মোট ১৬টা লৌকিক গল্প আছে। ১৬টি লৌকিক গল্পের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়, তবে সবগুলো না হলেও উল্লেখযোগ্য কিছুর পরিচয় দেওয়া হলো।
বদর আউলিয়ার উপাখ্যান: বঙ্গদেশে যে ৩৬০ জন আউলিয়া এসেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন বদর আউলিয়া। জানা যায়, তিনি নোঙর করেছিলেন চাটগাঁয়ে; যেটা বর্তমানে চট্টগ্রাম। ইতিহাস আর ধর্ম বলে, এই অত্র এলাকার মানুষজনের ত্রাণকর্তা হিসেবে বদর আউলিয়াকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কী সেই ত্রাণের ঘটনা?
আলী সুড়ঙ্গ: চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে একটা জায়গার নাম আলীকদম। আর ঠিক সেখানেই আছে আলী সুড়ঙ্গ। অনেক অনেককাল আগে সেই সুড়ঙ্গে এক ডাইনী বাস করতো; যে কি না বিয়ে করেছিল এক মনুষ্যের সাথে এবং ডাইনীর কোল জুড়ে এসেছিল এক ফুটফুটে মানব সন্তান।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পুত্রকথা: মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। ইংরেজরা নবাবের পরিবার নির্বংশ করা শুরু করে। কিন্তু নবাবের পুত্রকে নিয়ে পালিয়ে যায় নবাবেরই আরেক সেনাপতি মোহনলাল। মুসলমান নবাবের সন্তান বেড়ে উঠে হিন্দু জমিদার বাড়িতে সকলের সামনেই, তবুও সকলের অগোচরেই।
বাকর খানির প্রেম: পুরান ঢাকার স্থানীয় ভাষায় সুখারুটি বলা এই রুটি মোঘল আমলের সময়কাল কিংবা তারও আগে থেকেই নিজের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে। কিন্তু এই বাকরখানি কি শুধুই রুটি নাকি এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত আর করুণ এক প্রেমের ইতিহাস। ইতিহাসের বুকে আগা বাকের আর খানি বেগমের প্রেমকে চিরঞ্জীব রাখার জন্যেই যেন এই বাকরখানির জন্ম হয়েছিল।
গানস অফ বরিশাল: বাংলাদেশে এখন অবধি যে কয়টা অমিমাংসিত রহস্য আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গানস অফ বরিশাল। হঠাৎ করেই রাত-বিরাতে কামানের গোলার আওয়াজ পাওয়া যেত। এমনকি স্বয়ং ইংরেজরাও এই রহস্যের কোনো সুরাহা করতে পারেনি। আর, কবি সুফিয়া কামাল তার স্মৃতিচারণমূলক বইতেও এই রহস্যের কথা অকপটে স্বীকার করে গেছেন।
ভাওয়াল রাজার গল্প: ভাওয়াল রাজার কথা কে না জানে? জমিদার রাজাকে মৃত ভেবে দশ বছর প্রজারা নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিয়েও নিজেদের জমিদারকে আবারো ফেরত পেয়েছিল। এমনকি দশ বছর পর ফিরে আসা সেই সাধুসন্ন্যাসী কি সত্যিকারের ভাওয়াল রাজা ছিলেন কি না সে নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়েছিল।
রাজীব চৌধুরী। নামটা কম-বেশি অনেকেরই পরিচিত। চট্টগ্রাম শহরে জন্ম নেওয়া রাজীব চৌধুরী বর্তমানে ঢাকার বাসিন্দা। নিজের পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই বসবাস করেন। পেশায় স্থপতি। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে- প্রেতসাধক নিশিমিয়া, নিশিমিয়া আধোচক্র ও মানুষখেকো। আর, বঙ্গদেশী মাইথোলজি লেখকের চতুর্থ ও স্বপ্রকাশিত গ্রন্থ।
সবার আগেই লেখকের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। বর্ণনাভঙ্গি বেশ সাবলীল আর প্রাঞ্জল। তবে বইয়ের বেশ কিছু জায়গায় পড়তে গিয়ে পড়ার গতিতে হোঁচট খেয়েছি পাঠক হিসেবে। লেখক রোমান্টিকতার স্বার্থে কিছু বাক্য উপস্থাপন করেছেন, যেগুলো আসলে গল্পের ভার আর গভীরতাকে খানিকটা হলেও ম্লান করে বলে মনে হয়েছে। আর ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ২/১টি গল্পের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি হয়তো আরো জোরালো করা যেত বলে মনে হয়েছে।
প্রতিনিয়ত আমাদের চিরচেনা গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কালের গহবরে আর যুগের তাড়নাতে। ছোটবেলায় আমরা শুনেছি রূপকথার গল্প, রাক্ষসের গল্প, শুনেছি আলীবাবা আর চল্লিশ চোরের গল্প; কিন্তু এখন? এখন আমরাই আমাদের বাচ্চাদের শোনাই থর আর লোকির গল্প, শোনাই জিউস আর প্রযুক্তিনির্ভর নতুন বিশ্বের গল্প। সময়ের প্রভাবে হয়তো এসব রাক্ষস, শাকচুন্নি, ডাইনি বুড়িরা হারিয়ে যাবে, হাপিয়ে উঠবে চাঁদের বুড়ি, উজ্জ্বল ঝলমলে আলোয় নিশ্চিহ্ন হবে নিশিডাকা ভূতেরা। আর ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে এসব গল্পও।
শুধু রয়ে যাবে কিছু মানুষের মুখের বুলি। অবিশ্বাসে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব গল্প শুনবে। যেমনটা ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে শহরের রাজপথে গভীর রাতে পাহারা দেওয়া অর্ধেক মানুষের শরীর আর বাকি অর্ধেক ঘোড়ার শরীরবিশিষ্ট এক অদ্ভুত জন্তুর গল্প, হারিয়ে গেছে অমাবস্যার রাতে নুপুর পায়ে নেঁচে বেড়ানো মায়াবতীর গল্প, হারিয়ে গেছে কানওয়ালা কিংবা বসন্ত বুড়ির গল্পগুলোও। রাজীব চৌধুরী চেষ্টা করেছেন সেরকম কিছু গল্পই তুলে ধরতে। সেজন্য প্রথমেই সাধুবাদ জানিয়েছি লেখককে।
বইয়ের নাম: বঙ্গদেশি মাইথোলজি: বাংলাদেশের লৌকিক গল্পের সংকলন || লেখক: রাজীব চৌধুরী
প্রকাশক: পেন্ডুলাম পাবলিশার্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম
This article is in Bangla language. It is about Bengali book Bongodeshi Mythology, written by Rajib Chowdhury.
Feature Image: Author