জুম কনফারেন্স হরর কিংবা জুম বেইজড হরর! চটকদার লাইন। পাঠকের দৃষ্টি কাড়তে পারার মতো। তবে উদ্দেশ্য সেটা নয়। এমন চটকদার লাইন ব্যবহারের যে উদ্দেশ্য, সেটাকে ঠাট্টা করাটাই মূল উদ্দেশ্য। যাক সে-কথা। উদ্দেশ্য হোক যেমন তেমন, তবে এ সিনেমার ক্ষেত্রে লাইনটা সত্য। করোনাকালের কোয়ারেন্টিন বাস্তবতায় জুম অ্যাপ অফিশিয়াল কাজকর্ম থেকে শুরু করে শিক্ষা কার্যক্রম, সোশাল গ্যাদারিং; সবক্ষেত্রেই গোটা বিশ্বে একটা প্রয়োজনীয় যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'হোস্ট' এই সময়কেই ধরেছে, যার কারণে সিনেমাটার সাথে অতি সহজে সম্পৃক্ত হওয়া যায়।
লকডাউনের শুরুর দিকেই নির্মিত হয় সিনেমাটি। এর গল্প, চিত্রনাট্য, শ্যুটিং সব এই লকডাউনেই। ভার্চুয়ালেই গোটা কাজ। এবং দেখতে গেলে, করোনার সময়েই করোনা পরিস্থিতিকে নির্ভুলভাবে তুলে ধরে নির্মিত হওয়া গুটিকয়েক সিনেমার মাঝে 'হোস্ট' এগিয়ে থাকবে। হরর সিনেমা হওয়ায় আবেদনটাও অন্যরকম। করোনার বাস্তবতাই তো একটা হরর!
আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পাঁচ বান্ধবীর একটা সাপ্তাহিক জুম কলকে ঘিরে সিনেমার গল্প। বান্ধবীদের মাঝে হোস্ট হলো, হেইলি। লকডাউনে ঘরে বসে বসে রোজকার এক রুটিনে নির্জীব আর বিরক্ত হয়ে পড়ায় সময়টাকে মজাদার করে তুলতেই সপ্তাহান্তে তাদের জুম মিটিং। একেক সপ্তাহে একেক বিষয় নিয়ে হাজির হয় তারা। এ সপ্তাহে বান্ধবীদের জুম মিটিংয়ে হেইলি আমন্ত্রণ জানিয়েছে একজন 'মাধ্যম'কে, যে আত্মা ডাকতে পারে। একমাত্র সে ছাড়া বাকিরা জিনিসটাকে খুব বেশি 'সিরিয়াস' হিসেবে নিচ্ছে না। হাসি-তামাশা করছে নানান কিছু নিয়ে। মহামারির আতঙ্ক মাথা থেকে ক্ষণিক দূরে রাখতে তাদের এই হিহি-হোহো অস্বাভাবিক বা বিরক্তি উদ্রেককর কিছুই না যদিও।
তবে হেইলির কথায় সকলেই একটু দম ধরল ওই আত্মা ডাকতে পারা নারীকে সম্মান জানানোর অর্থে। নারীটি নির্দেশনা দিল, চোখ বন্ধ করে একে অপরের হাত ধরেছে মনে করে নিতে এবং প্ল্যানচেটে ব্যবহৃত হওয়া সেই ওইজা বোর্ড বা স্পিরিট বোর্ডটাকে চোখের সামনে কল্পনা করে নিতে। তারপর তার কথাগুলো তারা সবাই সমস্বরে বলল। একটু পর সে জিজ্ঞেস করল, তাদের কেউ কোনো উপস্থিতি টের পাচ্ছে কি না। বা তাদের কারো মাথায় কোনো নাম প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কি না। জেমা বলল, তার মাথায় একটা নাম বারবার আসছে। স্কুলে থাকতে ছেলেটা তাকে একবার সাহায্য করেছিল। পরে আত্মহত্যা করেছিল ছেলেটা। সবাই নড়েচড়ে বসল।
কিন্তু একটু পর জেমা ফাঁস করল, পুরোটাই একটা মিথ্যা গল্প। সে স্রেফ মজা করেছে। তবে, বিপদ যা ঘটার ঘটে গেছে। মাধ্যম হিসেবে আসা ওই নারী জানালো, আত্মাদের খোলা আমন্ত্রণ জানানোর পর জেমার এমন মিথ্যা গল্পে যা হলো, এই কল্পিত গল্পের ভিত্তিতেই একটা বাস্তব চরিত্রের আত্মার মুখোশ তৈরি হয়ে যাবে। এবং তার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে যেকোনো আত্মা। ভালো আত্মা হলে তো ভালোই। আর খারাপ হলে কী হবে, তা কল্পনাতীত। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেল এবার। এবং একথার সত্যতা প্রমাণেই বেশকিছু ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেলো বান্ধবীদের মধ্যে দু'জনের সাথে। বুঝতে পারা গেল, ওই চরিত্রের মুখোশে একটা খারাপ আত্মাই ঢুকে পড়েছে এবং ইতোমধ্যেই সেই আত্মা ওয়েবের মাধ্যমে কম্পিউটার স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে একে একে সব বান্ধবীর ঘরের অন্ধকার কর্নারে।
Image Source: Shudder
'হোস্ট' সম্পূর্ণটাই একটা কম্পিউটার স্ক্রিনে ধারণ করা। 'ফাউন্ড ফুটেজ' জঁনরার সিনেমা এটাকে বলা হচ্ছে। কিন্তু পুরোপুরি তা নয়। ফাউন্ড ফুটেজে ক্যামেরাটা সিনেমারই একটা চরিত্রের হাতে ধরে থাকা ক্যামেরা, তার দৃষ্টিকোণ ধরে এগিয়ে চলে। ফাউন্ড ফুটেজের উদ্দেশ্যই হয়, অজানা কোনো কিছু আবিষ্কার বা হারিয়ে যাওয়া কিছুর সন্ধান করা। তো হোস্ট এসব বৈশিষ্ট্যে আঁটছে না। তবে হোস্টকে নির্দ্বিধায় যে সাব-জঁনরায় ধরা যায়, তা ফাউন্ড ফুটেজেরই 'ব্রেইনচাইল্ড' বা মস্তিষ্কপ্রসূত সন্তান। 'কম্পিউটার স্ক্রিন ফিল্ম' এই সাব-জঁনরার সিনেমা হোস্ট। ২০১৮ সালের 'সার্চিং' সিনেমাটা এই সাব-জঁনরাকে আরো প্রসারিত এবং পরিচিত করেছে। হোস্টের আগে সর্বশেষ ভারতের মালায়ালি সিনেমা 'সি ইউ সুন' (২০২০) এ টেকনিক প্রয়োগ করেছে সফলভাবে। এছাড়া এ টেকনিকে সুপরিচিত হরর সিনেমা 'আনফ্রেন্ডেড' (২০১৪), জঁনরা বিচারে হোস্টকে টানা যায় এ সিনেমার সাথেই।
হোস্ট তার সেটিংয়ে অভাবনীয় কিছু করে হয়তো দেখায়নি, তবে কম্পিউটার স্ক্রিন ফিল্ম হিসেবে দর্শককে সরাসরি সংযুক্ত করেছে তার ন্যারেটিভের সাথে। এই জুম মিটিংয়ে দর্শক যেন আরেকজন পার্টিসিপেন্ট। দর্শকের কম্পিউটার স্ক্রিনের জুম অ্যাপেই যেন চলছে সব ঘটনা। জুম অ্যাপের লেআউট এবং বেঁধে দেওয়া সময়টাও স্ক্রিনের এককোণে দেখানো এবং একদম ঠিক সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া- এসকল ছোট্ট এবং সূক্ষ্ম বিবরণ নিখুঁতভাবে তুলে নিয়ে পুরো ৫৬ মিনিটের অভিজ্ঞতাকে আরো জীবন্ত করেছে 'হোস্ট'। পরিচালক রব স্যাভেজ ধূর্ততা, তীক্ষ্ণতাতেই সিনেমাটিকে এই সেটিংয়ের বাকি সিনেমাগুলো থেকে বিজড়িত করেছেন।
Image Source: Shudder
হোস্টের বড় শক্তির জায়গা হলো সঠিক সময়ের প্রাসঙ্গিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। আর বড় দক্ষতার জায়গা হলো কোনোকিছু অতিরিক্ত না করতে চাওয়া। জেমা হার্লিকে সাথে নিয়ে রব স্যাভেজ সবকিছুই খুব মিনিমাল রেখে বুদ্ধিদীপ্ত আর একদম মেদহীন একটি চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং শক্ত আর দক্ষ হাতে সেটাকে পরিচালনা করেছেন। এ ধরনের সিনেমাগুলো বেশিরভাগই অতিরিক্ত এক্সপোজিশনে ভোগে। আর এ দিকটিকেই সতর্কতার সাথে পরিহার করতে পেরেছেন রব। যেহেতু শুধুমাত্র একটি সিঙ্গেল স্ক্রিনেই সব চলছে, তাই এখানে বিবরণ হতে হবে সূক্ষ্ম এবং পরিমিত। রব স্যাভেজের প্রতিটি বিবরণ সুচারু। ছোট ছোট বিবরণ থেকেই তিনি ভয়টাকে জাগিয়েছেন। বাঁধাধরা স্পেসের নিখুঁত ব্যবহার করে ভয়টাকে একদম প্রান্তে রেখেছেন। সে কারণেই জাম্প স্কেয়ারগুলো এতটা সংবেদী আর অভিঘাতী হয়েছে।
Image Source: Shudder
চিত্রনাট্যে সংলাপগুলো লেখা হয়েছে এমনভাবে আর চরিত্রদের মিথস্ক্রিয়া এত সহজাতভাবে হয়েছে যে চরিত্র গঠনে আলাদা কোনো সময় ব্যয় করতে হয়নি। তাদের একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া কেমন হচ্ছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় ছিল, এবং সেটাতেই পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। একে অপরের সাথে কথা বলার মাধ্যমেই তাদের চরিত্রের অগ্রসরমানতা প্রকাশ পেয়েছে। এক্ষেত্রে সকলের অভিনয় অবশ্যই বড় ভূমিকা পালন করছে। তাদেরকে শুধু অভিনয়ই নয়, সাথে ক্যামেরার সঠিক প্লেসমেন্ট; লাইটিং ঠিক রাখা; সে অর্থে সেট না হলেও মোটামুটি কিছু জিনিসের সুচিন্তিত অবস্থানান্তর; এ কাজগুলোও করতে হয়েছে। এবং বলাই বাহুল্য, অভিনয়শিল্পীরা কাজটা নিখুঁতভাবেই করেছেন। তাই এদিক থেকে ফলাফল বিবেচনায়, হোস্ট ভিন্ন একটা অবস্থান আর উদাহরণ তৈরি করেছে।
অভিনয়শিল্পীদের আসল নামই ব্যবহার করা হয়েছে সিনেমায় এবং অভিনয়েও যতটুকু সম্ভব অভিনয় না করে, একদম বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যেমন হয়, তেমনটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা। আর এ বিষয়টাতেই ফাউন্ড ফুটেজ'কে, 'জঁনরা' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা 'দ্য ব্লেয়ার উইচ প্রজেক্ট' সিনেমাকে স্মরণ করে এই সিনেমা।
হোস্ট তার ৫৬ মিনিটের ব্যাপ্তিতে ভয় আর উত্তেজনাকে সমানতালে দৌড়িয়ে নিয়ে গেছে। আটকা পড়ার যে অসহায় অনুভূতি এই সিনেমা প্রদান করেছে, তা যে একদম বাস্তব এই করোনাকালে। সে কারণেই ভয়টা আরো অমোঘ রূপ ধারণ করেছে। সিনেমার ওই হরর আর বাস্তবের চলমান হরর; দুটোর প্রকৃতি ভিন্ন হলেও বিপন্নতার দিকে এসে দুটোই যে এক। ফলাফলেও এক। মোক্ষম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে, সময়টাকেই রূঢ়ভাবে উপস্থাপন করায় 'হোস্ট' উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।
This article is a Bengali review of the film 'Host' (2020), directed by Rob Savage. It's the first horror film or in general, film, to based on Corona and that also, in the times of corona. The whole film shot on the Computer screen. It's one of the finest horror films of 2020.
Featured Image: Shudder