Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ এবং কিছু বিহ্বল অনুভূতি

‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’-এর শুরু হয়েছে ‘একটি কাঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প’ দিয়ে। খুব সাধারণ একটি কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প। কী করে যেন তাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কাঁঠাল পাতা মাটির ঢেলাকে বলেছিল, বৃষ্টি এলে আমি তোমাকে ঢেকে রাখব। মাটির ঢেলা বলেছিল, ঝড় এলে আমি তোমাকে আটকে রাখব। কিন্তু একদিন বৃষ্টি এল, সাথে করে ঝড়কেও ডেকে নিয়ে এল। শেষ হলো কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার বন্ধুত্ব। তারা মিলিয়ে গেল অজানায়। শেষ হয়ে গেল তাদের বন্ধুত্ব।

গল্পে লেখক বলেছেন, বিভ্রান্ত অসন্তুষ্ট সন্তান পিতামাতার দিকে ছুঁড়ে দেয় ক্ষুদ্ধ প্রশ্ন, ‘কী দিয়েছ আমাকে?’ ধরণীকে দ্বিধা হতে বলে বাকরুদ্ধ পিতামাতা। বলতে পারে না, ‘দিয়েছি জীবন।’ মানুষের এইসব প্রহেলিকায় স্মৃতিভারাক্রান্ত চোখ রেখে যার আয়ু থেকে ঝরা পাতার মতো খসে খসে পড়ে পুরনো বছর, এ গল্পটি সেই মানুষের জন্য। একটি পাতা আর মাটির টুকরো নিয়ে গল্প হতে পারে, তাও এত সুন্দর! ভাবিইনি।

Image Credit: অসংজ্ঞায়িত

‘অ-গল্প’ শিরোনামের গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। এ আরেক অভাবনীয় লেখার কারসাজি। লেখক গল্প লিখবেন লিখবেন ভাব করে বলে ফেললেন গোটা কয়েক গল্প। পাঠককে ভাবালেন, কাঁদালেন, অভিভূত করলেন। শেষমেশ বললেন, গল্পটি আমি লিখবো না বলেই মনস্থ করলাম। গল্পে গল্পে লেখক জানিয়ে দিলেন কিছু চরম সত্য। রক্ত ঝরানো মুক্তিযুদ্ধ কী করে হয়ে গেল নিছক সাহিত্যচর্চার উপলক্ষ্য? কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের গল্পের গায়ে রক্ত মাংস চড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল একদল লেখক? এই গল্পটি লেখক তুলে ধরলেন ভিন্নভাবে। কেমনভাবে? অভাবনীয়ভাবে। 

তৃতীয় গল্প ‘ক্যালাইডোস্কোপ’। একই ঘরের কয়েকজন চরিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন এখানে। সবাই ভিন্ন ভিন্ন। একেকজন একেক চিন্তা, একেক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সবচেয়ে কনিষ্ঠ চরিত্র শুভ্র তখন সদ্য ভিসিআর চালানো শিখেছে। সে ভিসিআরে একটা সিডি দিয়ে ভাবল, এটাতে বোধহয় টম এন্ড জেরির কার্টুন আছে। কিন্তু সে সিডি চালু করে যা দেখে, তা সে বোঝে না। তার আম্মুকে জিজ্ঞেস করতেই সবগুলো চরিত্র সেদিকে মনোযোগী হয়। তারা যা দেখে, তা দেখে তাদের বলার কিছু থাকে না। তারা নিশ্চুপ হয়ে থাকে, যেন তাদের মাথার উপর দিয়ে পরী উড়ে গেছে। 

প্রচ্ছদ; Image Credit: BDNews24

এরপরের গল্পের নাম ‘মৌলিক’। গল্পের নায়ক যাচ্ছিলেন বরিশাল, এক বিশাল লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের যাত্রী হয়ে। পথমধ্যে চরে আটকে যায় লঞ্চ, আটকে থাকে পুরো দিন। লঞ্চের ভিআইপিদের খাবার শেষ হয়ে যায়। লঞ্চের কিছু খাবে না বলে পণ করা লেখক অবশেষে ডেকে অবস্থান করা নিম্নবিত্ত লোকদের খাবার খেতে বাধ্য হন, তার অবাধ্য ক্ষুধার তাড়নায়। শুধু ভাত আর ডাল জোটে অবশেষে। ভাতের প্লেট নিয়ে বসেন ময়লা টেবিলে। সামনে সেই গেঞ্জি, লুঙ্গি পরা গায়ে ঘামের গন্ধ যুক্ত লোকটি, যাকে দেখে বিরক্ত হতেন তিনি। সে হেসে হেসে বলল, সুদা ভাত খাইবেন কেমনে? একটা কাঁচামরিচ লন।

এই এক গল্প। থেকে থেকেও শেষ হয় না যার রেশ। ক্ষুধা এমন এক দানবের নাম, যার কাছে আভিজাত্য মূল্যহীন, একেবারেই মূল্যহীন। এ গল্প থেকে তা খুব ভাল করেই উপলব্ধি হয়। ইতঃমধ্যে এই গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘কমলা রকেট’।

Image Credit: IMDb

‘ডোডো পাখির জন্য নস্টালজিয়া’ গল্পে লেখক বর্ণনা দিয়েছেন এক পাখিপ্রেমিক যুবক মাহবুব আর আরেক পাখিপ্রেমিক পোস্টমাস্টার যতীন বাবুর কথা। যতীন বাবু মাহবুবকে পাখি বিষয়ক কথা জানান, যা মাহবুব এর আগে কখনো শোনেনি। একদিন যতীন বাবু বলেছিলেন, ‘যদি কখনো দেখেন, একটি বক আরেকটি বকের বুকের পালক ঠিকঠাক করে দিচ্ছে, বুঝবেন ওদের ডিম পাড়ার সময় হয়ে এসেছে।’ আরো কত নানা অজানা অবাক করা তথ্য।

মাহবুব ঠিক করে, সে পাখিদের সংগ্রহশালা বানাবে। প্রথমে সে পেঁচা সংগ্রহ করার কথা বলে যতীন বাবুকে। কিন্তু পেঁচা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় গেল পেঁচারা? গল্পের শেষে পেঁচারা একটি কথা বলে,

‘তোমাদের কৌতুহল চমৎকার, কিন্তু তার রাশ টেনে ধরো। তোমাদের এইসব লাগামহীন কৌতুহলেরই বলি হয়েছে আমাদের আত্মীয় অপরূপ ডোডো পাখির দল। তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আমাদের জন্যও কি সেই একই পরিণতি ডেকে আনতে চাও তোমরা?’

শেষটায় লেখক বুঝিয়ে দিলেন, এই যে আমরা খাঁচায় বন্দি করে পশুপাখি পুষে নিজেদের প্রেমিক বলি, তা কি আদৌ প্রেম, নাকি ধ্বংসের আগের আয়োজন?

‘হারুনের মঙ্গল হোক’ গল্পে লেখক গতানুগতিক ধারায় বর্ণনা করেছেন ইতিহাসে এম.এ. করা হারুনের জীবন। ইতিহাস জানা ছেলের চাকরির বাজারে দাম নেই। তার চাকরি হয় বেসরকারি এক এনজিও সংস্থার জুনিয়র অফিসার হিসেবে। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলে তাদেরকে কনডম ব্যবহারে উৎসাহী করা। একজন দরদ দেখিয়ে হারুনকে বলেছিল,

‘আরেকটু কষ্ট কইরা মেট্রিক পাশ করলে আপনের এত কষ্ট কইরা আমাগো দুয়ারে দুয়ারে ঘুরনের ছোড চাকরি করোন লাগতো না।’

এরপরের আরেক অভাবনীয় গল্প ‘মিথ্যা তুমি দশ পিপড়া’। গল্প জুড়ে তিনটি চিঠি। তিনটি চিঠির মাঝে তিনটি কাল, তিনটি সময়। একটি মায়ের কাছে, একটি প্রেমিকার কাছে, শেষটি বন্ধুর কাছে। শেষটাতে শুরুর দিকের তুলনায় অচিন্তনীয় পরিবর্তন। অদ্ভুত নামটার সাথে গল্পটার অসম্ভব মিল। কীভাবে? 

লেখক শাহাদুজ্জামান; Image: Golpo Path

‘ক্ষত যত, ক্ষতি যত’ রবীন্দ্রনাথের গানের কলি দিয়ে শিরোনাম। বইটির অন্যতম, অথবা শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটা মমতাজের। কী ঘটেছিল মমতাজের? কোথায় থাকে? কী করে? দেখতে কেমন? মমতাজ বরাবরই কি এমন নীরব? আর মমতাজের সংসার? আরো গুটিকয়েক প্রশ্ন আর প্রশ্নের উত্তরজুড়েই গল্পের পরিব্যপ্তি। অসাধারণ এবং অসাধারণ, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। 

‘জ্যোৎস্নালোকের সংবাদ’ সাধারণের খোলসে অসাধারণ এক গল্প। কয়েকদিন আগে বাড়ি ফেরা রঞ্জুর কাছে হঠাৎ টেলিগ্রাম আসে, ‘Come Home’। এই দু’টি শব্দ কাঁপন ধরিয়ে দেয় রঞ্জুর বুকে। ভালো সংবাদের ধারাবাহিকতা থাকে, কিন্তু খারাপ সংবাদ আসে আকস্মিক। রঞ্জুর মনে হতে থাকে, কোনো খারাপ সংবাদ না তো? প্রথমেই মনে আসে মৃত্যুর কথা। মনে পড়ে তার মা, বাবা, ছোট বোন মমতার মুখ। ওদের কারো মৃত্যু সংবাদ কল্পনা করতে পারে না রঞ্জু। গল্পের আরেক চরিত্রের নাম মঞ্জু, রঞ্জুর ভাই, যে স্বপ্ন দেখে। এমন এক দেশের স্বপ্ন, যেখানে সবাই অধিকার পাবে।

কী সেই আকস্মিক সংবাদ? জানতে হলে পড়ে ফেলুন।

‘খিয়াল করেছেন মঞ্জু ভাই, আপনি গিরামে আলেই আকাশে খুব জোসনা হয়।’

এই একটা বাক্য যেন ধারণ করে আছে শত শত কিংবা হাজার হাজার কিংবা সংখ্যা যা ধারণ করতে পারে না, এমন অসংখ্য ভালোবাসা।

‘স্যুট টাই অথবা নক্ষত্রের দোষ’ একজন রফিকুল ইসলামের গল্প। যার কোনো কারণে কোথাও চাকরি টেকে না। কীসের দোষে? তার আরেক দোষ আছে, দূরমনস্কতা। বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণবিতরণকারী এক সংস্থার অস্থায়ী চাকরী পায় সে। বন্যা শেষ হওয়া পর্যন্ত যার মেয়াদ। তাকে কাজের বিবরণ দিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বলা হয়। তবে সে শুনেছে, বস মুগ্ধ হলে অস্থায়ী চাকরি স্থায়ী হতে পারে। সে খুব যত্নের সাথে বিবরণ দেয়। শেষে এসে তাকে ঘিরে ধরে দূরমনস্কতা। সে বলতে শুরু করে অন্য কথা, বন্যাদুর্গত মানুষের অসহায়ত্বের কথা। 

‘কারা যেন বলছে’ গল্পটি সমসাময়িক এক প্রসঙ্গের। ১৯৯৬ সালে লেখা গল্পগ্রন্থটির সময়েরও একই প্রসঙ্গ। ছাত্ররাজনীতির বিভীষিকা এমন চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন, যার বর্ণনা দিতে এই পাঠক সঠিক শব্দচয়নে ব্যর্থ।

‘কতিপয় ভাবুক’ এটিকে অন্যতম গল্প বললে ভুল হবে না। অভিনব এক গল্প। গল্পটি এক প্রেমিক অথবা প্রেমিকার, অথবা প্রেমিকের বন্ধুর, অথবা এক বৃদ্ধের, অথবা এক মাঝির। সবকিছু ছাপিয়ে বোধের গল্প, ভাবনার গল্প, বুদ্ধিজীবী মানুষের বুদ্ধির মতানৈক্যের গল্প। 

‘কিছু শিরনামা’ শিরোনামে লিখেছেন খণ্ড খণ্ড চমৎকার কয়েকটি গল্প। সাহিত্যের সুনিপুণ ব্যবহার ঘটেছে যেখানে। 

শেষ গল্পটির নাম ‘মারাত্মক নিরুপম আনন্দ’। শুরুতেই টি.এস. এলিয়টের বিখ্যাত “The Love Song of J. Alfred Prufrock”-এর দু’টি লাইন।

‘There will be time, there will be time

To prepare a face to meet the faces that you meet’

মানুষের কি আসলেই অপরের উপযোগী মুখমণ্ডল প্রস্তুত করা প্রয়োজন, যেমনটি বলেছেন টি. এস. এলিয়ট? গল্পের শেষে পাবেন এর উত্তর। এ গল্পটি লেখা সাধুভাষায়, কথোপকথনের ভঙ্গিতে। গল্প নয়, যেন পুরো জীবন এঁকেছেন ক্যানভাসে সুনিপুণ এক শিল্পী। গল্পে গল্পে তিনি দেখিয়েছেন মানুষের জীবনটা অনেকটা মৃত বৃক্ষের মতো। তাতে ক্ষণিকের তরে এসে বসে বাহারী পাখির দল। তাতেই মনে হয়, জীবন বর্ণাঢ্য। পাখি উড়ে গেলে বেরিয়ে আসে তার মৃত কঙ্কাল।

বইয়ের নাম: কয়েকটি বিহ্বল গল্প || লেখক: শাহাদুজ্জামান

প্রকাশনী: মাওলা ব্রাদার্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি 

This article is in Bangla language. It is a review on a book namely 'Koyekti Bihwal Golpo' by Shahaduzzaman. This book consists of 14 stories, each more interesting than others.

Featured Image: BSMS

RB-AS/SM

Related Articles