
‘ক্রাচের কর্নেল’ কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের একটি অনবদ্য সৃষ্টি। ৩৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে একজন কর্নেল তাহেরের জীবন মানচিত্র অঙ্কন ছাড়াও লেখক পাক-ভারত দেশবিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধকালীন ও তার পরবর্তী সময়ের জানা-অজানা অনেক পরিপ্রেক্ষিত এবং নায়ক-খলনায়কের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে উপজীব্য করে রচিত এ উপন্যাসটি পেয়েছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
মুক্তিযুদ্ধে পা হারানোর পর ক্রাচে ভর দিয়ে চলেছেন একজন মানুষ, যিনি বাংলাদেশকে দেখতে চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক সোনার বাংলা হিসেবে। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন তার প্রাণের মাতৃভূমির সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের। কৈশোর থেকে নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করেছেন ক্ষুদিরামের পথের এই অভিযাত্রী। তার পুরো পরিবার ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি মিনি সেক্টর, তিনি ছিলেন সেই সেক্টরের অকুতোভয় কমান্ডার।
কর্নেল তাহেরের ঘটনাবহুল জীবন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশের টানে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদান করা, জননী আশরাফুন্নেসার নেতৃত্বে এবং ভাইদের সহায়তায় ব্রাদার্স প্লাটুন তৈরি করা, সহধর্মিণীকেও বিপ্লবী জীবনযাপনে সহজাত করে তোলা, পরিবার ছেড়ে নিজের আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে সত্যিকারের সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন দেখা, মাথা উঁচু রেখে একটি পা নিয়েই পুরো দেশে টহল দিয়ে মুক্তিকামী অভ্যুত্থানের আয়োজন করা আর ক্ষুদিরামের মতো কবিতা আবৃত্তি করে সদর্পে মৃত্যু আলিঙ্গন করা তাহের অনেকখানিই জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে।
বিপ্লবমুখী চেতনা গ্রাস করেছে চে গুয়েভেরা এবং কর্নেল তাহের দুজন নায়ককেই। দুজনেই ব্যর্থ অথচ আত্ম-বিসর্জিত বিপ্লবের পথিকৃৎ। তাদের মৃত্যুদণ্ডের মাঝে এত মিল যে দেখলেই তা স্পষ্টভাবে চোখে ধরা দেয়। তাহের বুঝতে পেরেছিলেন তার জন্ম হয়েছে বড্ড ভুল সময়ে। ক্ষমতার লালসা আর কুৎসিত রাজনীতির কাছে অচিরেই মার খায় তার সমস্ত স্বপ্ন। বইটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের এই দুর্ভাগা সূর্যসন্তানের কথা। দেশসেবায় নিজের অনেক কিছু বিলিয়ে দেয়া বিপ্লবী এই মানুষটির ভাগ্যে জায়গা করে নিয়েছিল অপ্রত্যাশিত করুণ পরিণতি। ব্যক্তি আবু তাহেরের জন্য চোখ ভিজে উঠবে বইটি পড়ে।
শুধু কর্নেল তাহেরই নন, পাশাপাশি উঠে এসেছে অগণিত ঐতিহাসিক চরিত্রের কীর্তি ও কুকীর্তির কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে বাঙালির অজানা থাকবার কথা নয়। ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসে আমরা এই বীরকে আবারও দেখতে পাই, কালের চক্রে যিনি বরণ করেছিলেন নির্মম মৃত্যু।
এছাড়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সুকাঠামোবদ্ধ করেছিলেন, দেশের ঘূর্ণায়মান হাল ধরেছিলেন সাহসের সাথে, তিনি হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনিই বঙ্গবন্ধুর পেছনে ফাইল হাতে দাঁড়ানো সেই 'নটোরিয়াস' লোকটি। উপন্যাসে যদিও তার কথা খুব কমই বলা হয়েছে।
তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে উঠে, যদি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে এই সাদামাটা অথচ নটোরিয়াস লোকটির পরিচয় ঘটতো, তবে আমাদের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতে পারত। অথবা যদি বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে তার তোষামোদকারীদের কথায় কান ভারী না করে তাজউদ্দীনের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন, তবে বাংলাদেশের ইতিহাস কিছু করুণ অধ্যায়ের সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা পেত। কিন্তু কলঙ্কজনক ইতিহাসে এই নটোরিয়াস ব্যক্তিকেও সম্মুখীন হতে হয়েছিল নির্মম মৃত্যুর। জাতীয় বাকি তিন নেতার সাথে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় যিনি মারা যান।
যুদ্ধপরবর্তীকালে এই দেশের ক্রমাগত রাজ্যভার বদল এবং দখলের অনেক কিছুই অজানা আমাদের কাছে, যার চিহ্ন পাঠ্যবইয়েও নেই। আমরা জাসদ, সর্বহারা পার্টিসহ বাকশাল ও বিশেষ করে ১৫ই আগস্টের পরবর্তী তিন মাস নিয়ে যে ধোঁয়াশায় ডুবে থাকি, তা নিবৃত্তে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় এই বইটি থেকে।
একটি অবিদিত চরিত্র বিশেষভাবে নজরে এসেছে, তিনি কর্নেল তাহেরের মা আশরাফুন্নেসা। একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যিনি প্রতিটি সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করেছেন। ফলশ্রুতিতে পরিবারের সকলেই দেশের জন্য লড়েছেন সংঘবদ্ধভাবে। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে দেশের জন্য আদর্শ বলা যেতে পারে। আর পুরো একটা পরিবার নিজেদের ভালো থাকাটা বিসর্জন দিয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য, এমনটাও বিরল। উপন্যাসের আরো একটি চরিত্র হলো কর্নেলের সহধর্মিণী লুৎফা তাহের। তাহেরের সকল কর্মকাণ্ডে অর্ধাঙ্গিনীর মতোই নীরবে সবসময় সমর্থন ছিল তার।
বাংলাদেশের মননশীল কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ব্যাপারে বইপ্রেমীদের অজানা থাকবার কথা না। কর্মজীবনে অধ্যাপনা ও গবেষণামূলক কাজের পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চায়ও তার প্রতিভার ছাপ রেখে চলেছেন।
উপন্যাস পাঠক হিসেবে বলব সব বই নিঃশ্বাস রোধ করে রেখে পড়া সম্ভব না। কিছু বই পড়তে গেলে কাহিনীর পরতে পরতে মন ডুবে যায়। আর সেটা বাস্তব কাহিনীকে উপজীব্য করে চমৎকার লেখা হলে তো কথাই নেই, নিজেকেই উপন্যাসের প্রত্যক্ষদর্শী মনে হয়।
শাহাদুজ্জামান তার পর্যবেক্ষণ, গবেষণা আর অনুভূতির সন্নিবেশ ঘটিয়ে চমৎকার একটি আবহ তৈরি করেছেন, যার ফলশ্রুতিতে 'ক্রাচের কর্নেল' বইটি আমার মনে ঠিক এমনই এক জীবন্ত অনুভূতি রেখে গেছে। কালের স্রোতে ইতিহাস অক্ষত থাকে না, এর রঙ কখনো ফিকে হয়, কিংবা বদলে যায়। অনেকের কাছে বইয়ের লেখা নিরপেক্ষ দর্শানুপাত মনে হবে। আবার অনেকের কাছে লেখকের পক্ষপাতিত্ব আছে বলে মনে হবে, সেক্ষেত্রে বলবো এটা কম-বেশি সবারই একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
ইতিহাসভিত্তিক বই পড়ার প্রতি যাদের বিশেষ আগ্রহ নেই, তাদেরও এই বইটি ভালো লাগবে আশা করি।
বইয়ের নাম: ক্রাচের কর্নেল || লেখক: শাহাদুজ্জামান
প্রকাশনী: মওলা ব্রাদার্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম
This Bangla article is a review of 'Kracher Kornel' by Sahaduzzaman.
Featured Image: goodreads.com
RB-RF/SM