Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাই লেফট ফুট: ড্যানিয়েল ডে-লুইসের অবয়বে এক বিশেষ শিল্পীর জীবন

১০ বছর বয়সী ক্রিস্টি যখন এক টুকরো চক দিয়ে মেঝেতে ‘মা’ শব্দটা লিখে, তখন আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে তার বাবা ও পুরো পরিবার। আপনি হয়তো এখন ভাবছেন, দশ বছর বয়সের একজন কিশোর ছেলের জন্য ‘মা’ এর মতো অতি সহজ একটা শব্দ লেখা আর এমন কীইবা বিশাল ব্যাপার হতে পারে? তাহলে বলছি শুনুন, কেন ক্রিস্টির এমন সামান্য কীর্তি তার পরিবারের চোখে অসাধ্য সাধনের তৃপ্তি এনে দিয়েছিল। 

ক্রিস্টি ব্রাউন। ১৯৩২ সালে আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের এক অতি সাধারণ পরিবারে জন্মেছিল সে। ক্রিস্টির মায়ের কোল পরিপূর্ণ করে তেইশ জন শিশু পৃথিবীতে আসলেও শেষমেশ টিকে থাকা তেরো জনের একজন ছিল ক্রিস্টি। তবে ক্রিস্টির অন্যান্য ভাইবোনদের তুলনা ক্রিস্টি ছিল কিছুটা আলাদা। যে দশ জন অকালে বিদায় নিয়েছে, তারা তো চিরতরে হারিয়েই গিয়েছে। কিন্তু বাকি তেরো জনের মধ্যে বারো জন সুস্থ সবল হলেও ক্রিস্টি ছিল সেরিব্রাল পেলসি নামক রোগের শিকার। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো সে হাঁটাচলা, কথাবার্তা কিংবা কাজকর্ম করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

যেহেতু পরিবারে মোটমাট পনেরোজন সদস্য, আবার আর্থিকভাবেও ব্রাউন পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তাই ক্রিস্টির উন্নত চিকিৎসা কিংবা তাকে বিশেষভাবে দেখাশোনা করে তাকে লালন পালন করা কোনোটাই তাদের দ্বারা হয়ে উঠেনি। একমাত্র ক্রিস্টির মা ছাড়া পুরো পরিবারের সবার কাছে সে ছিল নির্বোধ ও বোঝা। এমনকি তার বাবাও তাকে ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে হীনমন্যতায় ভুগতেন। কিন্তু ক্রিস্টি মা সবসময় দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তার ছেলে বুদ্ধিশুদ্ধিতে অন্য আট-দশটা এ বয়সী ছেলে থেকে কম না বরং বেশি। আর মায়ের মন বলে কথা। তাই তো মায়ের কথাকে শতভাগ সত্য প্রমাণ করতে একদিন নিজের সমস্ত শারীরিক শক্তি ও মানসিক জোর একীভূত করে শুধু বাম পায়ের প্রয়োগ করে অপটুভাবে লিখে ফেলে মাত্র একটি শব্দ, ‘মাদার’। আর তারপরেই ঘুরে যায় ক্রিস্টি ব্রাউনের জীবনের মোড়। তার সাদামাটা ও অবহেলিত জীবনে কাছের মানুষদের ভালোবাসা ও সহমর্মিতা নতুন আশার আগমনী বার্তা নিয়ে উদয় হয়। 

বাস্তবের ক্রিস্টি ব্রাউন ; Source: Pinerest

তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাবার গল্প নেই। তার জীবনে একের পর এক নতুনত্বে সাজানো অধ্যায়েরা এসেছিল, যা তাকে প্রতিনিয়ত মানুষ হিসেবে করে তুলেছিল বিস্ময়কর। একটি মাত্র শরীরের অঙ্গ, নিজের বাম পাকেই কেবল পুরোপুরিভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করার সামর্থ্য ছিল তার। আর সেই বাম পা দিয়েই এমন সব সৃজনশীল খাতে নিজের নাম লেখায় যা অনেক মানুষ শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও বুদ্ধিমত্তার পূর্ণ ব্যবহার করেও জীবদ্দশায় অর্জন করতে পারে না।

শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি অগাধ প্রেম ও আরাধনা থেকে  প্রথমে তিনি একজন চিত্রশিল্পীতে ও পরবর্তীতে একজন লেখক রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। আর তার ফলস্বরূপ নিজের মনের জমানো কথা ও না বলা গল্পকে স্থায়ীভাবে আগলে রাখতে লিখে ফেলেন আত্মজীবনী মূলক বই ‘মাই লেফট ফুট’।

এখানে মূলত ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত সেই বই অবলম্বনে নির্মিত একই নামের সিনেমা নিয়ে  আলোচনা করা হবে। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সে জীবনী বিষয়ক সিনেমাটিতে ক্রিস্টি ব্রাউনের জন্মকালীন গল্প থেকে শুরু করে তার সমাজে নিজ নাম ও গুণে প্রশংসিত হবার সময় পর্যন্ত বেশ সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পর্দার ছোট্ট ক্রিস্টি ও তার স্নেহময়ী মা; Source: Thinking Cinema

আইরিশ সিনে নির্মাতা জিম শেরিডানের নির্মাতা হিসেবে ‘মাই লেফট ফুট’ সিনেমাটির মধ্য দিয়েই অভিষেক ঘটান। তিনি নিজে ও শেন কনাটন (Shane Connaughton) মিলিতভাবে বইয়ের পাণ্ডুলিপিকে সিনেমার উপযোগী  চিত্রনাট্যে রূপান্তরিত করেন।

সিনেমার প্লট ও কাহিনী উপরে বর্ণিত ক্রিস্টির জীবনের গল্পের সাথে মিলে যায়। তবে সিনেমাটি যে বিশেষ দুটি কারণে এ যাবত বানানো সব জীবনী সংক্রান্ত সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য হবে, সেগুলোর প্রথমটি হলো মূল চরিত্রের নিখুঁত ও জীবন্ত অভিনয়শৈলী। 

ক্রিস্টি ব্রাউনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দুজন অভিনয়শিল্পী। তাদের একজন হলেন  হিউ ও’কনর, যিনি  বাল্যকালের ক্রিস্টিকে সিনে পর্দায় মেলে ধরেছেন। আর ক্রিস্টির যৌবনকালকে পর্দার সামনে উপস্থাপনের দায়িত্বে ছিলেন এ যুগের অনবদ্য সেরা অভিনেতা ড্যানিয়েল ডে-লুইস। আর তারা দুজনেই নিজ নিজ চরিত্রায়নে একদম যথাযথ ছিলেন। ক্রিস্টির ছোটকালের ভূমিকাতে হিউকে যে কতটা শ্রম দিতে হয়েছে ও কী পরিমাণ কসরত দেখাতে হয়েছে, দর্শকেরা সিনেমার শুরুর দিকের একটা দৃশ্য দেখেই উপলব্ধি করে ফেলবেন।

যুবক ক্রিস্টি চরিত্রে ড্যানিয়েল ডে-লুইস; Source: The Belcourt Theatre

সে দৃশ্যে দেখা যায় যে, বাড়িতে ক্রিস্টি ও তার মা ছাড়া আর কেউ না থাকা অবস্থায়, ক্রিস্টির গর্ভবতী মা অসুস্থতা অনুভব করে হঠাৎ করে সিঁড়ি থেকে উল্টে নিচে পড়ে যান। উপরতলায় থাকা ক্রিস্টি তা টের পেয়ে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে তারপর শোয়া অবস্থায় নিজের শরীরটাকে ঠেলে ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোনোমতে বাড়ির মূল দরজা পর্যন্ত পৌঁছায়। এরপর দরজাতে বাম পা দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি দিতে থাকলে আশেপাশে থাকা মানুষজন তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এভাবে ছোট ক্রিস্টি তার মা ও আগত সহোদরের প্রাণ বাঁচিয়ে থাকে।

এ দৃশ্য দেখার পর, হিউর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে মনে হয় না কোনো দর্শকের মনে কোনো প্রশ্ন থাকবে। এছাড়াও চক দিয়ে মেঝেতে ‘মা’ লেখার দৃশ্যতেও হিউ ছিল দুর্দান্ত। পর্দায় যতক্ষণ কিশোর ক্রিস্টিকে দেখানো হয়েছে, ততক্ষণ ক্রিস্টির বেশে শিশুশিল্পী হিউ দর্শকদের মনকে নাড়া দিতে বাধ্য। 

এভাবেই পরিবারের ভালোবাসায় মিশে ছিলেন ক্রিস্টি; Source: The Ace Black Blog

ড্যানিয়েল ডে-লুইসকে আগে থেকে না চিনলে যে কেউ ভেবে বসতে পারে, তিনি বাস্তব জীবনেও শারীরিকভাবে একজন প্রতিবন্ধী। তার মুখভঙ্গি, কথা বলার ধরন, শরীর নড়াচড়া করার কসরত দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে তিনি নিছক অভিনয় করছেন। ড্যানিয়েলকে ক্রিস্টিকে চরিত্রে দেখে দর্শকদের অনেকের ‘ফরেস্ট গাম্প’ সিনেমার টম হ্যাঙ্কসের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। ফরেস্ট চরিত্রটিকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপে ফুটিয়ে তুলতে হ্যাঙ্কস যতটা সফল হয়েছেন, ড্যানিয়েল কোনো ক্ষেত্রেই তার চেয়ে কম যাননি।

তবে এখানে একটা বলে  রাখা ভালো যে, ক্রিস্টি ফরেস্টের মতো মোটেও সরল- সহজ ও নরম মনের মানুষ ছিলেন না। ক্রিস্টি ছিলেন একজন একগুঁয়ে, চরম জেদি ও বদরাগী মানুষ। আচার-আচরণের ক্ষেত্রে তার অনেক খারাপ দিক ছিল। তিনি বেপরোয়া ও উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আর এমন চরিত্রে ধার ও গুরুগাম্ভীর্যের ছাপ থাকা চেহারা বিশিষ্ট কাউকে কল্পনা করলে ড্যানিয়েলের পরিপূরক আর কেউ হতে পারতো বলে মনে হয় না। 

পর্দার বাইরে বর্তমানের হিউ, ড্যানিয়েল ও শেরিডান; Source: Zimbio

ক্রিস্টি ব্রাউন মানুষটা অত্যন্ত সৃজনশীল ও গুণসম্পন্ন হলেও তার ব্যক্তিত্ব ছিল জটিলতায় আছন্ন। তাই ‘মাই লেফট ফুট’ সিনেমাকে অন্যান্য বেশিরভাগ বায়োগ্রাফিক্যাল সিনেমার যেগুলোতে সিনেমার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তির দোষ কিংবা বাজে দিকগুলো ঢেকে রেখে তার গুণকীর্তন গাওয়া হয়, সেগুলোর সাথে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপাটা ভুল হবে। কারণ ক্রিস্টি যেমন বাস্তবে খটমটে স্বভাবের মানুষ ছিলেন, সিনেমাতেও সেভাবেই তার চরিত্রকে অংকন করা হয়েছে। তার চরিত্রকে কোনো সাধু কিংবা সর্বগুণ সমৃদ্ধ মানুষ হিসেবে দেখিয়ে মিথ্যা ছলনা না করে, তিনি যেমন ছিলেন সেই সত্যিকারের মানুষটাকেই পর্দায় চিত্রায়িত করা হয়েছে।

তাই দর্শক সিনেমাটি দেখার সময় ক্রিস্টিকে আদর্শ মেনে যেমন অনুকরণ করতে সংকল্পবদ্ধ হবেন না। তেমনি তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি যে কাঁটা ভরা পথে এতদূর হেঁটে গিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তা দেখিয়ে যাওয়া পথ অনুসরণে উৎসাহী হবেন। অন্যদিকে, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার কিশোর ক্রিস্টির প্রতি দর্শকদের হৃদয়ে যেমন জন্ম দেবে দরদ, তেমনই প্রাপ্তবয়স্ক ক্রিস্টির প্রতি দর্শকদের চোখে করুণা থেকে বেশি জায়গা করে নেবে বিস্ময়।।

অস্কার হাতে ড্যানিয়েন ও ব্রেন্ডা; Source: independent.ie

‘মাই লেফট ফুট’ সিনেমাটি মুক্তির পর সমালোচক গোষ্ঠীর মাঝে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। ড্যানিয়েলের জাদুকরী অভিনয় তাকে দর্শক ও সমালোচক উভয় শ্রেণির কাছ থেকে এনে দেয় অভাবনীয় প্রশংসা ও ভালোবাসা। জিম শেরিডানের প্রথম পরিচালিত সিনেমা তাকে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের মতো বড় পরিসরে সেরা পরিচালকের মনোনয়ন এনে দেয়। ড্যানিয়েল সে বছর ক্রিস্টি চরিত্রের জন্য হাতে তুলে নেন সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কার। ক্রিস্টির মা চরিত্রে থাকা ব্রেন্ডা ফ্রিকারও তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে অস্কার জিতে নেন। এছাড়া অস্কারে আরও কয়েকটি শাখাতে মনোনয়ন জিতে নেয় সিনেমাটি।

This article is a review of a film named 'My Left Foot'. It is written in bengali. This film is about an artist named Christy Brown.

Feature Image Source: IMDB

Related Articles