Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সহজ পাঠ: রবি ঠাকুরের ভোজন রসিক মন

হিমানীশ গোস্বামী তার মজার অভিধান ‘অভিধানাইপানাই’-তে ‘Solar cooker’ এর বাংলা করেছিলেন রবি ঠাকুর! 

রবীন্দ্রনাথ একবার তার ভক্ত আর ছাত্রছাত্রীদের সামনে গাইছেন, “হে মাধবী, দ্বিধা কেন?” তখন ভৃত্য বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনমালী ভাবছে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন, এ সময় বিরক্ত হবেন কি না কে জানে। গুরুদেব বনমালীর দিকে তাকিয়ে গাইলেন, “হে মাধবী, দ্বিধা কেন?”

বনমালী আইসক্রিমের প্লেট গুরুদেবের সামনে রেখে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ পরক্ষণেই বললেন, “বনমালীকে যদিও মাধবী বলা চলে না। তবে তার দ্বিধা মাধবীর মতোই ছিল। আর আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে দ্বিধা করা মোটেই ভালো নয়।”

রবীন্দ্রনাথের আইসক্রিম প্রীতি বোঝা যায় কর্মফল পড়লে, “ও সতীশ, শোন শোন; তোর মেসোমশায় তোকে পেলেটির বাড়ি থেকে আইসক্রীম খাইয়ে আনবেন, তুই ওঁর সঙ্গে যা।”

রবি ঠাকুর; Image Source: Wikimedia Commons

নাজিমউদ্দিন এর রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি থ্রিলার উপন্যাসটি সম্প্রতি বেস্ট সেলার হয়েছে। নামকরণের সময় ঔপন্যাসিক কেন রবীন্দ্রনাথের নামই বাছলেন? রবীন্দ্রনাথ যে ‘ঠাকুর’ই- এটা বলা নেই ঠিকই, তবুও ‘খাওয়া’ আর ‘রবীন্দ্রনাথ’ এই দুই শব্দ যখন পাশাপাশি বসালেন, তখন কি তিনি জানতেন যে রবিবাবু খুবই ভোজনরসিক ছিলেন? লুচি নিয়ে গান্ধীজিকে অবধি খোঁচা দিতে ছাড়েননি!

রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে শুরু করেই বাজিমাত করেছিলেন। ছোটবেলার এই কবিতাটি এখনো অমর। কেননা এ যেন চমৎকার গন্ধসমেত একদম থ্রিডি চিত্রকল্পই, “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে— হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ, পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।”

তার পেটে ও পিঠে, ইঁদুরের ভোজ, গল্পের মিঠাইয়ের ঝুড়ি, পয়লা নম্বর গল্পের মাছের কচুরি আর আমড়ার চাটনি (যেটি খাইয়ে অনিলা চরম শোধ তুলেছিল), বিনি পয়সার ভোজ এর –

“কী বললি? বাবু হোটেল থেকে খাবার কিনে আনতে গেছেন? বলিস কী রে! আজ তবে তো রীতিমত খানা! খিদেটিও দিব্যি জমে এসেছে। মটন-চপের হাড়গুলি একেবারে পালিশ করে হাতির দাঁতের চুষিকাঠির মতো চক্‌চকে করে রেখে দেব। একটা মুর্গির কারি অবিশ্যি থাকবে— কিন্তু, কতক্ষণই বা থাকবে! আর দু-রকমের দুটো পুডিং যদি দেয় তা হলে চেঁচেপুঁচে চীনের বাসনগুলোকে একেবারে কাচের আয়না বানিয়ে দেব। যদি মনে ক’রে ডজন-দুত্তিন অয়্‌স্টার প্যাটি আনে তা হলে ভোজনটি বেশ পরিপাটি রকমের হয়। আজ সকাল থেকে ডান চোখ নাচছে, বোধ হয় অয়্‌স্টার প্যাটি আসবে।”

এগুলো ভোলা যায়? কাব্যি করেছেন আমসত্ত্ব-দুধ আর সন্দেশ নিয়ে, আর খেতেন নিমপাতার শরবত। তবে শুধু নিমপাতার শরবতই নয় কিন্তু। 

১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেশভ্রমণে বেরোন। তারপর বাকি জীবন ধরে বহু দেশ ঘুরেছেন। আর নানা দেশের ভালো লাগা খাবারগুলো সময়-সুযোগমতো ঠাকুরবাড়ির হেঁশেলে চালু করে দিতেন! ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ডিশের একরকম ফ্রুট স্যালাড ঠাকুরবাড়িতে চালু করেছিলেন তিনি।

একসময় ঠাকুরবাড়িতে সবাইকে নিয়ে কবিগুরু একসঙ্গে খেতে বসতেন। কবি জাপানি চা পছন্দ করতেন। কেবল তা-ই নয়, সঙ্গে তাদের চা খাওয়ার রেওয়াজও ছিল তার পছন্দের। তাই তিনি জাপানে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তার জন্য ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করতেন গুণমুগ্ধরা।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি; Image Source: Times of India

১৯১৩ সালে কবি নোবেল পুরস্কার পেলেন। এর আগের বছর ১৯১২ সালে লন্ডনে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সেদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি, লন্ডন। সেদিনের খাদ্য তালিকা হয়েছিল কবির পছন্দে। এই তালিকায় ছিল গ্রিন ভেজিটেবল স্যুপ, ক্রিম অব টমেটো স্যুপ, স্যামন ইন হল্যান্ডেন সস এ্যান্ড কিউকামবার, প্রি সলটেড ল্যাম্ব উইথ গ্রিন ভেজিটেবল, রোস্ট চিকেন, ফেঞ্চ ফ্রাই, গ্রিন স্যালাড ও আইসক্রিম।

বাইরে এ ধরনের খাবার খেলেও বাড়িতে তিনি কম তেল-মশলাযুক্ত খাবার খেতেন। কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার হাতের রান্না খেতে সবাই খুব পছন্দ করতেন, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন।

ঠাকুরবাড়িতে প্রায়শই খামখেয়ালি সভা বসতো। সেই সভায় কবি থাকতেন মধ্যমণি। সেই খামখেয়ালিপনা থেকেই হয়তো তিনি রাত দুটোর সময় মৃণালিনী দেবীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন। শোনা যায়, এই ঘটনা প্রায়শই ঘটত, আর মাঝরাতে মৃণালিনী দেবী রান্না করে রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াতেন।

কবি দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। এছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব ও চিকেন কাবাব নোসি। কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে মৃণালিনী দেবীর সেই রান্নাঘর।

কবি কাঁচা আম খেতে ভালবাসতেন। আচারও খেতেন। কাদম্বরী দেবী কবিকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁচা আম এনে দিতেন। এখানেই শেষ নয়, কবিগুরু ছিলেন পানের ভক্ত। তার নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালিনী তাকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও ঠাকুরবাড়িতে রক্ষিত আছে।

ঠাকুরবাড়ির রান্নায় বেশি করে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। গরম মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হতো। রান্নার তালিকায় প্রতিদিনই দীর্ঘ পদ থাকত। আর তাতে নিয়মিত অবশ্যই থাকত সুক্তো আর দইমাছ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইজি প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী খুব ভালো রান্না করতেন। তার রান্না খেয়ে গুরুদেব অনেক প্রশংসা করেছেন। এঁচোড় দিয়ে খাসির যে মাংস প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবী গুরুদেবকে রান্না করে খাইয়েছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে থাকা শিক্ষকদের স্ত্রীরা অনেকটা প্রতিযোগিতা করে তার জন্য রান্না করতেন। প্রতিদিন সকালে উঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গ্লাস নিমপাতার রস খেতেন। আশ্রমের শিক্ষক অনিল চন্দের স্ত্রী রানী চন্দ প্রায়ই রান্না করে আনতেন। পায়েস বা বাদামজাতীয় মিষ্টি রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন।

এসব লিখতে গেলে আস্ত রিসার্চ পেপারই দাঁড়িয়ে যাবে! বরং একটা মজার জিনিস নিয়েই আলোচনা করা যাক। এহেন ভোজন রসিক একজন ব্যক্তির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যতবারই গেছি, অত্যন্ত খারাপ খাইয়েছেন উদ্যোক্তারা! লুচি,বোঁদের উপরে প্রোমোশনই হ’ল না কোনোদিন। আজব!

আমরাই বোধহয় শেষ জেনারেশন, যারা বুঝেছি সহজ পাঠ কী জিনিস। একটা বাচ্চাকে কিছুদিন সহজ পাঠ পড়িয়েছিলাম, সে একটা কথাই বলেছিল – “রবীন্দ্রনাথ কি পেটুক ছিল? শুধু খাওয়া আর খাওয়া!”

তখন আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু পরে ব্যাপারটা স্ট্রাইক করে। আরে, সত্যিই তো! কথাটা তো ভুল নয়। কতবার ঐ বই পড়তে গিয়ে খিদে চাগিয়ে উঠেছে!

শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

“বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা-কিছু নিতান্ত অবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু বিকাশলাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে; কিন্তু আহারটি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়া দরকার। তেমনি একটা শিক্ষাপুস্তককে রীতিমত হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের সাহায্যে আবশ্যক। আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে শক্তি অলক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে; গ্রহণশক্তি, ধারণাশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বললাভ করে।”

বুদ্ধকে নিয়ে একটা গল্প চালু আছে যে, তিনি একদিন যখন উপদেশ দিচ্ছিলেন, তখন এক শিষ্য ঘেমে-নেয়ে এলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে কিছু আহার করে নিতে বলেন। আর আমাদের এক প্রিয় মহাপুরুষ তো বলেছেনই, “খালি পেটে কী যেন একটা হয় না!”

ছোটবেলায় বহু টিচারের কাছে, এমনকি অনেকেরই বাড়িতে গিয়ে পড়ার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আমার আছে। অনেক সময় দিনভর পড়ে মুখ লাল করে বাড়িতে ফিরলে মা জিগ্যেস করতেন- “কি রে,কিছু খেতে দেয়নি?” আর এক টিচার ছিলেন, তাকে আমরা যা বেতন দিতাম, সেটা দিয়ে আমাদের নানা লোভনীয় খাবার খাইয়ে দিতেন।

পড়তে পড়তে খাওয়া নিয়ে কেউ বোকার মতো ছুঁৎমার্গ দেখান, কেউ বা উদার মনে বলেন খাওয়া সেরে নিলে মন ভালো হবে, পড়াটাও হৃষ্ট-চিত্তে হবে, পুষ্ট হবে মনটাও। খাওয়া নিয়েই তো যাবতীয় ঝামেলার সূত্রপাত! কান টানলে আসে মাথা, খাবার দিয়ে টানলে পাওয়া যায় মন। তাই তো মিড ডে মিল। আমরা উল্টোটাও করেছি। গৃহশিক্ষকের মন পেতে দারুণ সব খাওয়াতাম তাকে রোজ।

সত্যজিৎ রায়ের বঙ্কুবাবুকে মনে আছে তো? যেসব ছাত্রদের তিনি ভালোবাসতেন, তাদের বাড়িতে ডেকে এনে বাটি ভরে মুড়কি খেতে দিয়ে গল্প বলতেন। আমার তো মনে হয় রবিবাবু ছোটদের মন বুঝতেন দারুণ। নইলে একটা পেটে ও পিঠে লেখা তার পক্ষে সম্ভব হতোই না। তিনি বুঝেছিলেন, খাবার-দাবারের গন্ধেই অর্ধভোজন হয়ে যাবে। বুকে অনেকটা নির্মল হাওয়া ভরে যাবে। এবার চোখ বোলানো যাক সহজ পাঠ-এ।

সহজপাঠ প্রথম খণ্ড; Image Source: ittadishop

প্রথম ভাগেই খাবারের ছড়াছড়ি-

“হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ

বসে খায় ক্ষীর খই”,

“বাটি হাতে এ ঐ

হাঁক দেয় দে দৈ” 

“ডাক পাড়ে ও ঔ

ভাত আনো বড় বৌ”,

“ত থ দ ধ বলে, ভাই

আম পাড়ি চল যাই”

প্রথম পাঠে আছে- “পাতু পাল আনে চাল”, “খুদিরাম পাড়ে জাম”, “দীননাথ রাঁধে ভাত”

দ্বিতীয় পাঠে আছে-

থালা ভরা কৈ মাছ, বাটা মাছ। সরা ভরা চিনি ছানা। গাড়ি গাড়ি আসে শাক লাউ আলু কলা। ভারী আনে ঘড়া ঘড়া জল। মুটে আনে সরা খুরি কলাপাতা। রাতে হবে আলো। লাল বাতি। নীল বাতি। কত লোক খাবে।

আহা, আয়োজন! তৃতীয় পাঠে আছে-

মামা আনে চাল ডাল। আর কেনে শাক। আর কেনে আটা। দাদা কেনে পাকা আতা, সাত আনা দিয়ে। আর, আখ আর জাম চার আনা। বাবা খাবে। কাকা খাবে। আর খাবে মামা। তার পরে কাজ আছে। বাবা কাজে যাবে। দাদা হাটে যায় টাকা হাতে। চার টাকা। মা বলে, খাজা চাই, গজা চাই, আর ছানা চাই। আশাদাদা খাবে।

চতুর্থ পাঠে আছে পাখির খাবারের কথা। অসুস্থ রাণীদিদি তাকে খাওয়ায়-

এ যে টিয়ে পাখী। ও পাখী কি কিছু কথা বলে? কী কথা বলে? ও বলে রাম রাম হরি হরি। ও কী খায়? ও খায় দানা। রানীদিদি ওর বাটি ভ’রে আনে দানা।

তার ঠিক পরের কবিতাতেই যত্ন করে বর্ণনা দেওয়া রয়েছে-

হরিমুদী বসেছে দোকানে।
চাল ডাল বেচে তেল নুন,
খয়ের সুপারি বেচে চুন,
ঢেঁকি পেতে ধান ভানে বুড়ী,
খোলা পেতে ভাজে খই মুড়ি।
বিধু গয়লানী মায়ে পোয়
সকাল বেলায় গোরু দোয়।
আঙিনায় কানাই বলাই
রাশি করে সরিষা কলাই।

পঞ্চম পাঠে আছে-

আজ বুধবার, ছুটি। নুটু তাই খুব খুসি। সেও যাবে কুলবনে। কিছু মুড়ি নেব আর নুন। চড়ি-ভাতি হবে। ঝুড়ি নিতে হবে। তাতে কুল ভ’রে নিয়ে বাড়ি যাব।

সপ্তম পাঠে দেখা যায় শৈলর পৈতের আয়োজন। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও চলছে – “ওরে কৈলাস দৈ চাই। ভালো ভৈষা দৈ আর কৈ মাছ। শৈল আজ খৈ দিয়ে দৈ মেখে খাবে।” নবম পাঠে আছে আবার মুখশুদ্ধির কথা- “গৌর, হাতে ঐ কৌটো কেন? ঐ কৌটো ভ’রে মৌরি রাখি। মৌরি খেলে ভালো থাকি।” শেষ হয়েছে আবার খাওয়া দিয়েই- “চলো, এবার খেতে চলো। সৌরিদিদি ভাত নিয়ে ব’সে আছে।”

যেন পড়তে পড়তে খাওয়া। প্রথম ভাগকে উপাদেয় খাদ্যের বিবরণ দেওয়ার দিক দিয়ে যেন একদম হারিয়ে দিয়েছে সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগ। একেবারে রাজকীয় খাওয়া থেকে মাটির দাওয়ায় খাওয়া- সব আছে চমৎকারভাবে!

লেজেন্ড হয়ে যাওয়া কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি কবিতাতেও ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ছবি মেলে- “উচ্ছে বেগুন পটল মূলো”, “সর্ষে ছোলা ময়দা আটা” , “কিংবা কলসি-ভরা এখো গুড়ে”। তৃতীয় পাঠ-এর পঙ্গপালগুলো বেদম ছোঁচা- কপির পাতা খেয়ে একদম সাফ করে দিয়েছে! ঐখানে মা পুকুরপাড়ে কবিতায় দেখি খই খাওয়ার বেলা হরিণ আর ধান খাওয়ার বেলায় কাঠবিড়ালির একেবারেই অরুচি নেই-

আঁচলেতে খই নিয়ে তুই
যেই দাঁড়াবি দ্বারে
অম‍্‌নি যত বনের হরিণ
আসবে সারে সারে।

কিংবা,

কাঠবেড়ালি ল্যাজটি তুলে
হাত থেকে ধান খাবে।’

মনে পড়ে ‘পাখির ভোজ’ কবিতা-

‘ভোরে উঠেই পড়ে মনে,
মুড়ি খাবার নিমন্ত্রণে
আসবে শালিখ পাখি।
চাতালকোণে বসে থাকি,
ওদের খুশি দেখতে লাগে ভালো।
স্নিগ্ধ আলো
এ অঘ্রানের শিশির-ছোঁওয়া প্রাতে,
সরল লোভে চপল পাখির চটুল নৃত্য-সাথে
শিশুদিনের প্রথম হাসি মধুর হয়ে মেলে —
চেয়ে দেখি সকল কর্ম ফেলে।

জাড়ের হাওয়ায় ফুলিয়ে ডানা
একটুকু মুখ ঢেকে
অতিথিরা থেকে থেকে
লাল্‌চে-কালো সাদা রঙের পরিচ্ছন্ন বেশে
দেখা দিচ্ছে এসে।

খানিক পরেই একে একে জোটে পায়রাগুলো,
বুক ফুলিয়ে হেলে-দুলে খুঁটে খুঁটে ধুলো
খায় ছড়ানো ধান।

ষষ্ঠ পাঠ-এ আছে-

পথে যদি জল নামে মিশ্রদের বাড়ি আশ্রয় নেব। সঙ্গে খাবার আছে তো? সন্দেশ আছে, পান্তোয়া আছে, বোঁদে আছে। আমাদের কান্ত চাকর শীঘ্র কিছু খেয়ে নিক্‌। তার খাবার আগ্রহ দেখি নে। সে ভোরের বেলায় পান্তা ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। তার বোন ক্ষান্তমণি তাকে খাইয়ে দিলে।

সপ্তম পাঠ-এ দেখি বেশ আহ্লাদ করে রাঁধার তোড়জোড়-

শ্রীশকে বোলো, তার শরীর যদি সুস্থ থাকে সে যেন বসন্তর দোকানে যায়। সেখান থেকে খাস্তা কচুরি আনা চাই। আর কিছু পেস্তা বাদাম কিনে আনতে হবে। দোকানের রাস্তা সে জানে তো? বাজারে একটা আস্ত কাতলা মাছ যদি পায়, নিয়ে আসে যেন। আর বস্তা থেকে গুন্তি ক’রে ত্রিশটা আলু আনা চাই। এবার আলু খুব সস্তা। একান্ত যদি না পাওয়া যায়, কিছু ওল অনিয়ে নিয়ো। রাস্তায় রেঁধে খেতে হবে, তার ব্যবস্থা করা দরকার। মনে রেখো— কড়া চাই, খুন্তি চাই জলের পাত্র একটা নিয়ো।

নোটো রাজমিস্ত্রীর কাঠফাটা রোদে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতে মন চলে যায় অন্যদিকে- “সুর ক’রে ঐ হাঁক দিয়ে যায়, আতাওয়ালা নিয়ে ফলের ঝোড়া।”

নবম পাঠ-এ চির পরিচিত বাচ্চাভোলানো কৌশল আছে- “সঞ্জীবকে ব’লে দেব, তোমার জন্যে মিষ্টি লজঞ্চুস এনে দেবে।”

দশম পাঠ-এর মতো বাঙালিয়ানা খুব কম জায়গায় আছে – “বাঞ্ছাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দাও। বাঞ্ছা শীঘ্র আমার জন্যে চা আনুক আর কিঞ্চিৎ বিস্কুট।”
রবি ঠাকুর, বিবেকানন্দ, সুভাষ বোস- কে না চায়ের ভক্ত ছিলেন! চায়ের জন্য কত যুদ্ধ হয়ে গেল এ দুনিয়ায়!

সহজপাঠ দ্বিতীয় খণ্ড; Image Source: readbengalibooks

একাদশ পাঠ অতি উপাদেয়। খাওয়ার বর্ণনায় চমৎকার ক্লাসিফিকেশন এখানে আছে। এটা পড়লেই আমার মনে পড়ত রোববারের খাওয়ার কথা- “শক্তিবাবু বললেন, এইখানে একটু বিশ্রাম করি। সঙ্গে ছিল লুচি, আলুর দম আর পাঁঠার মাংস। তাই খেলেন। আক্রম খেলো চাট‍্‌নি দিয়ে রুটি।”

বনের মধ্যে পথ হারানো শক্তিবাবু আর আক্রমের নানা বিপদ পেরোনোর পর সমাপ্তিটাও মন ভালো করা-

“কাঠুরিয়ারা শক্তিবাবুকে আক্রমকে যত্ন ক’রে খেতে দিলে। তালপাতার ঠোঙায় এনে দিলে চিঁড়ে আর বনের মধু। আর দিলে ছাগলের দুধ। নদী থেকে ভাঁড়ে ক’রে এনে দিলে জল।”

ত্রয়োদশ পাঠে নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উদ্ধব বিশাল এক রুইমাছ ধরে ফেলে! পরে নানান টানাপোড়েনের পর কাত্যায়নী দেবীর কৃপায় –

পরদিন গোধূলিলগ্নে নিস্তারিণীর বিবাহ। বেলা যখন চারটে, তখন, পাঁচজন বাহক উদ্ধবের কুটীর প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত। কেউ বা এনেছে ঝুড়িতে মাছ, কেউ বা এনেছে হাঁড়িতে দই, কারও হাতে থালায় ভরা সন্দেশ।

দেখলাম খুব ভুল বলেনি ছেলেটা!

রবিবাবুর বিখ্যাত “কাল ছিল ডাল খালি আজ ফুলে যায় ভরে/ বল দেখি তুই মালী হয় সে কেমন করে” নিয়ে একটা মজার গল্প শুনেছিলাম…
তাঁর খাওয়ার আয়োজনে গতদিন রবিবাবু দেখেছিলেন শুধু ডাল আর ডাল! পরদিন দেখেন ফুলে ভরে গেছে! বক ফুল, কুমড়ো ফুল ইত্যাদি। অবাক হয়ে ভৃত্য বনমালীকে ডেকে তিনি বলেন- “বল দেখি তুই মালী, হয় সে কেমন করে!”
এভাবেই নাকি কবিতাটার জন্ম! এখন এ গল্প সত্যি কি মিথ্যে জানি না, গবেষকগণ উত্তর দিতে পারবেন। হ্যাঁ… এই কবিতাটাও সহজ পাঠেরই!

বইয়ের নাম: সহজ পাঠ  ||  লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রকাশক: বাংলাপ্রকাশ  ||  অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম

This article is in Bengali Language. This is a review of the book Sahajpath written by Rabindranath Tagore.

Featured Image: thebetterindia.com

RB-TI

 

Related Articles